রবীন্দ্রনাথের গানের অনন্য শিল্পী: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

রবীন্দ্রনাথের গান দিনুদার কন্ঠে যেন মূর্ত হয়ে উঠত। রবীন্দ্রসঙ্গীত বলতে কি বোঝায় তা দিনুদার মুখে একবার শুনলেই কারও বুঝতে বাকি থাকত না”- বলেছিলেন সাহানা দেবী। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পৌত্র। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে তাঁর জন্ম। পিতা দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অত্যন্ত সুরসিক ও মজলিশি। লোকজনকে খাওয়াতে তিনি খুব ভালোবাসতেন। দিনেন্দ্রনাথের মা সুশীলা দেবী ছিলেন বরিশালের লাখুটিয়া অঞ্চলের জমিদার কন্যা। সুগায়িকা ও সুঅভিনেত্রী। ইন্দিরা দেবীর স্মৃতিকথায় আছে, “জ্যাঠামশার পুত্রবধূ (দিনুর মা) সুশীলা দেবী তার (বিবাহ উৎসব নামে নাটকের) নায়ক সেজে বেশ সুন্দর গান ও অভিনয় করতেন"।

 

প্রফুল্লময়ী দেবীও বলেছেন, যে কোনো গানই তিনি এমন ভাব দিয়ে গাইতেন যে শ্রোতা মুগ্ধ না হয়ে পারত না। পিতা-মাতার গুণগুলি পুত্র দিনেন্দ্রনাথেও সঞ্চারিত হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘদিনের একান্ত সচিব সুধাকান্ত রায়চৌধুরী লিখেছিলেন, “তাঁহার মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতরাজ্যে যে অভাব ঘটিয়াছে সে অভাব পূরণ হইবার নহে এবং শান্তিনিকেতনেও তাঁহার আসন অধিকার করিবার মানুষ আর মিলিবে না"।

 

কী ছিল দিনেন্দ্রনাথের গানে? তাঁর ব্যক্তিত্বে? গান গাইবার ক্ষমতা ছিল তাঁর সহজাত। সব ধরনের গানেই ছিল তাঁর সমান দক্ষতা। খুব ছোট থেকে শুনে শুনেই অনেক গান শিখেছিলেন তিনি। ইন্দিরা দেবী লিখেছিলেন, “দিনু (জ্যাঠামশার নাতি দিনেন্দ্র) এ রকম তিন বছর বয়স থেকে নাকি গেয়ে বেড়াত নিবারো নিবারো প্রাণের ক্রন্দন, কাটো হে কাটো হে এ মায়াবন্ধন"। আর একবার জ্যাঠামশার রচিত এক গান ‘শয়ন ভিজিল নয়নজলে’ আড়াল থেকে শুনে জ্যাঠামশায় তাকে ডেকে খুব ধমকেছিলেন। বললেন, ‘খবরদার এ গান আর কখনো গেয়ো না’। চার বছর বয়েসেই দিনেন্দ্রনাথ ‘সত্যমঙ্গল প্রেমময় তুমি’ গানটি অনায়াসে গাইতেন। গাইতেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের হাসির গানও। অমিতা সেনের স্মৃতিকথায় আছে যে দিনেন্দ্রনাথ শৈশবেই এত ভালো গান গাইতেন যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তাঁকে নিয়ে বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে নিজের গান শোনাতেন।

কাশিয়াবাগান স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষার পর সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে অল্প দিন পাঠগ্রহণ করে শেষে সিটি স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে দিনেন্দ্রনাথ প্রেসিডেন্সি কলেজে আইএসসি'তে ভর্তি হন। কিন্তু সে পড়া তিনি শেষ করেননি। এই সময়ে তাঁর গানের খ্যাতি জোড়াসাঁকোর ৬ নম্বর বাড়ির সীমা ছাড়িয়ে ৫ নম্বর বাড়িতেও পৌঁছে গিয়েছিল। গগনেন্দ্রনাথ-সমরেন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথদের মা সৌদামিনী দেবী তাঁর গান শুনতে ভালোবাসতেন। পূর্ণিমা ঠাকুরের স্মৃতিচারণায় আছে, “বাবা কাকারা তিনটের সময় ঘুম থেকে উঠে দিদিমার কাছে হলে গিয়ে বসতেন। তখন দিনু দাদার ডাক পড়ত। সে দিদিমাকে গান গেয়ে শোনাত। দিনুদাদা পান খেতে খুব ভালোবাসত। গানের পরে তাই দিদিমার মশলা দেওয়া পান বখশিস হত”। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বিনয়নী দেবীর বড় মেয়ে বীণাপাণি দেবীর বিবাহ হয়েছিল। "ছোট পিসীর বড় মেয়ে বীণাপাণির সঙ্গে দিনু দাদার বিয়ে হয় ১৩০৬-০৭ সালে।…বছর দুই বাদে বড়দিদি ডিপথিরিয়া হয়ে মারা যায়। তাঁর কোনও ছেলেমেয়ে হয়নি”।

আইন পড়ার জন্য একাধিকবার লন্ডনে গেলেও ব্যারিস্টার হওয়া দিনেন্দ্রনাথের হয়নি। যদিও এই বিদেশবাসের সময় পাশ্চাত্য সঙ্গীতে তিনি জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। ১৯১৯ সালে সঙ্গীতভবন স্থাপিত হলে প্রথম অধ্যক্ষ হন দিনেন্দ্রনাথ। পরে ১৯২৮ সালে তিনি আবার অধ্যক্ষ হন। পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় তিনি সঙ্গীতভবনে শিক্ষকতা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গানকে তিনিই রবীন্দ্রসঙ্গীত আখ্যা দিয়েছিলেন। দিনেন্দ্রনাথের গান বিষয়ে বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়িকা সাহানা দেবী বলেছিলেন, “দিনুদা একাই ছিলেন একশ। কি গলা! যেন গভীর অতল থেকে গম্ভীর ধ্বনি উঠত”। এমনই ছিল তাঁর গায়ন যে দ্বিধাহীন ভাষায় সাহানা দেবী বলেছিলেন, “এখনকার রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে তাই আমাদের মন তৃপ্তি পায় না। মনে হয় তাতে কি যেন হয় না, কি যেন নেই। হারিয়ে গেছে কোথায়"।

দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের দিকপাল শিল্পীরা শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। সাহানা দেবী, রমা কর, অমিতা সেন (খুকু), সাবিত্রী কৃষ্ণান, মেনকা ঠাকুর, অনাদি দস্তিদার, শান্তিদেব ঘোষ প্রমুখ প্রখ্যাত শিল্পীদের পাশাপাশি বহু সাধারণ শিক্ষার্থীরাও দিনেন্দ্রনাথের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতে তালিম নিয়েছেন। কীভাবে তিনি গান শেখাতেন তার বর্ণনা শোনা যাক অমিতা সেন (খুকু)র স্মৃতিচারণা থেকে-“….. গান শেখাবার সময়ে দিনেন্দ্রনাথ সাধারণত কোনও যন্ত্র ব্যবহার করতেন না। গান গেয়ে যেতেন, আমরা দুই-একবার শুনে পরে তাঁর সঙ্গে ‌সঙ্গে গানটি গাইতাম। যতক্ষণ পর্যন্ত গানের সুরের প্রত্যেকটি সূক্ষ্মতম কাজ আমাদের সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত না হত, ততক্ষণ কিছুতেই তিনি নিরস্ত হতেন না। সকল ছেলেমেয়ের শেখবার ক্ষমতা সমান ছিল না। কিন্তু কখনও তাঁর ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে দেখিনি। কিছুতেই যেন তাঁর বিরক্তি হত না, কেবল একটি বিষয় ছাড়া- সে আর কিছু নয়, ভুল সুর তাঁর কানে গেলে তিনি সইতে পারতেন না। যতক্ষণ সেটাকে শুধরে ঠিক সুরে গাওয়াতে না পারতেন, ততক্ষণ যেন শিশুর মতোই চঞ্চল হয়ে পড়তেন। গানে তাঁর ক্লান্তি কখনও দেখিনি। ”সময়জ্ঞান ও নিয়মানুবর্তিতার বোধ ছিল তাঁর অসাধারণ"। জানিয়েছেন অমিতা সেন, "দুপুরবেলা কলাভবনে একটার সময় দিনদার রিহার্সেল নেবার কথা। আমরা সব কে কোথায় আছি একটু দিবানিদ্রার চেষ্টায় - ঠিক সেই সময়ে রৌদ্রের ঝাঁজ মাথায় করে দিনদা এসে উপস্থিত। আর এসেই হাঁকডাক শুরু করে দিতেন। ভয়ে ভয়ে আমরা তাড়াতাড়ি খাতাপত্র হাতে এসে জুটলে গান শুরু হত। প্রত্যেকের খাতায় গানগুলি ঠিকমতো তুলে নেওয়া চাই; ফাঁকি দিয়ে কাজ ফেলে রেখে, এর কাঁধের উপর দিয়ে, ওর পিঠের উপর দিয়ে দেখে কোনোমতে কাজ সারলে চলবে না। পঁচিশ তিরিশজনকে একসঙ্গে গান শেখাতে বসেও দিনদার কান পড়ে আছে সুরের নিখুঁত টানের উপরে- কোনো কোণায় কে এতটুকু বেসুর করে ফেলল তৎক্ষণাৎ ধরে ফেলতেন"।

স্বরলিপি নির্মাণেও দিনেন্দ্রনাথের অসামান্য দক্ষতা ছিল। “তিনি কোনোরকম যন্ত্রের সাহায্য না নিয়া অথবা গুণগুণ পর্যন্ত না করিয়া চিঠি লেখার মতো স্বরলিপি লিখিয়া যাইতেন এবং আমাদের করা স্বরলিপি ঐ ভাবে সংশোধন করিতেন”। জানিয়েছেন অনাদি দস্তিদার। দিনেন্দ্রনাথের জন্যই শান্তিনিকেতনের প্রথম দিকে রবীন্দ্রনাথের রচিত গানগুলি যথাযথভাবে সংরক্ষিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও সেকথা জানতেন - “তাঁর চেষ্টা না থাকলে আমার গানের অধিকাংশই বিলুপ্ত হতো।…. আমার ফুলগুলিকে রক্ষা করা এবং যোগ্য এমনকি অযোগ্য পাত্রকেও সমর্পণ করা তাঁর যেন একাগ্র সাধনার বিষয় ছিল"। দিনেন্দ্রনাথের অনন্য সুরজ্ঞানেরও উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। ছোটবেলায় সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়ার সময়ই পিয়ানো বাজানোয় দক্ষতার কারণে তিনি পুরস্কৃত হয়েছিলেন। পরবর্তী কালে এসরাজেও তিনি অপূর্ব সুরসৃষ্টি করেছেন।

অপূর্ব কন্ঠমাধুর্য, সুগভীর সুরজ্ঞান, সুমধুর এসরাজবাদন এবং স্বরলিপি নির্মাণে অসামান্য দক্ষতা দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের এক ব্যতিক্রমী শিল্পী করে তুলেছিল। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতে তাঁর ছিল সুগভীর পান্ডিত্য। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণেই তিনি ব্যারিস্টারি পড়া শেষ করতে পারেননি। দিনেন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে স্থায়ীভাবে বসবাস রবীন্দ্রনাথের গান রচনার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিজের দেওয়া গানের সুর রবীন্দ্রনাথের মনে থাকত না। স্বরলিপি করতেও তাঁর আগ্রহ ছিল না। যেজন্য “গানে সুর দিয়েই তিনি দিনু বাবুকে ডেকে পাঠাতেন - কখনো কখনো তিনি নিজেই গানের খাতা হাতে করে, গানের সুর গুণগুণ করতে করতে দিনু বাবুর বাড়িতে হাজির হতেন”। শান্তিনিকেতনের প্রথম যুগের শিক্ষক তেজেশচন্দ্র সেনের এই স্মৃতিকথনের সঙ্গে রাখা যেতে পারে সাহানা দেবীর ১৯২৭ সালের অভিজ্ঞতা, “…সময়-অসময় নেই, যখন দিনুদাকে তাঁর বাড়ির দিকে থেকে কবির বাড়ির দিকে হন্ হন্ করে আসতে দেখা যেত বুঝতে বাকি থাকত না যে কবির কোনও নতুন গান তৈরী হয়েছে তা শিখে নেবার জন্যে দিনুদার ডাক পড়েছে"।

দিনেন্দ্রনাথ ১৯০৭ সাল থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত শান্তিনিকেতনে ছিলেন। সেই সময়কালে রবীন্দ্রনাথ যে বিপুল সংখ্যক গান রচনা করেছেন তার স্বরলিপিকার মূলত দিনেন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের প্রায় দু হাজার গানের মধ্যে সাতশো গানের অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশ গানের স্বরলিপি দিনেন্দ্রনাথের করা। যদিও এই স্বরলিপিগুলি নিয়ে নানা সময়ে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও দিনেন্দ্রনাথের ওপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে পারেননি। তিনি একবার বলেছিলেন, “দিনু মাঝে মাঝে করে (স্বরলিপি) কিন্তু আমার বিশ্বাস সেগুলো বিশুদ্ধ হয় না”। ইন্দিরা দেবীর সঙ্গে এ বিষয়ে মতভেদ অনেক দূর বিস্তৃত হয়েছিল। এক সাক্ষাৎকারে ইন্দিরা দেবী বলেছিলেন, “দিনুর সঙ্গে রবি কাকার গানের সুর সম্বন্ধে আমার তর্ক হলে এই চুক্তি ছিল যে নতুন গানের সুর সম্বন্ধে তার কথা মানব কিন্তু পুরোনো গানের নয়"।

অভিনয় ও আবৃত্তিতেও দিনেন্দ্রনাথ ছিলেন অনন্য। তেজেশচন্দ্র সেন জানিয়েছেন, “দিনুবাবুর মুখে আমরা শুনতুম শেলি ও কিটস্। যাঁরা তাঁর মুখ থেকে কবিতাপাঠ শুনেছেন তাঁরাই জানেন তিনি কী সুন্দর করেই কবিতা পড়তেন”। অভিনেতা দিনেন্দ্রনাথও ছিলেন অতুলনীয়। ‘বিসর্জন’ নাটকে রঘুপতির ভূমিকায় তাঁর অসামান্য অভিনয়ের স্মৃতি দর্শকদের মনে চির জাগরূক ছিল। সাহানা দেবী এই নাটকের রিহার্সাল সম্বন্ধে জানিয়েছেন, যাদের অভিনয় করে দেখানো কবি প্রয়োজন মনে করতেন তাদের নিজে অভিনয় করে দেখিয়ে দিতেন। কিন্তু "দিনুদাকে কখনও কিছু দেখিয়ে দিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। অভিনয়ক্ষমতা ওর দেখেছিলাম সহজাত।.. দিনুদার অভিনয়ের রবীন্দ্রনাথ খুব প্রশংসা করতেন। খাদের সেই মোটা দানাবাঁধা কন্ঠস্বরে যেন আগুন জ্বলে উঠত ব্রাহ্মণের ( রঘুপতির) দম্ভ ও তেজ..।"
‘বাল্মীকিপ্রতিভা’-য় বাল্মীকি ও প্রথম দস্যুর ভূমিকায়, 'রাজা’ নাটকে পাগল, ‘তপতী’ নাটকে দেবদত্ত, ‘অচলায়তন’- এ পঞ্চকের ভূমিকায় তাঁর অভিনয় দর্শকচিত্ত জয় করেছিল। ' বিসর্জন' রিহার্সালের সময় একদিন মৃত জয়সিংহের দেহের ওপর রঘুপতির আছাড় খেয়ে পড়ার পর "কবি সেই সময় একদিন উঠে দিনুদার দিকে এমন অদ্ভুত করে তাকিয়ে, বললেন-'দিনু তুই ভুলে যাস আমি বেঁচে থাকি।' একথা শোনা মাত্র সবাই উচ্চরবে হেসে উঠলেন। দিনুদাও।'


সর্বতোভাবে আত্মপ্রচারবিমুখ এই মানুষটি কবিতা ও গান রচনা করেছেন। অথচ সর্বজনসম্মুখে তা তুলে ধরেননি। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “দিনেন্দ্রনাথের কন্ঠে আমার গান শুনেছি কিন্তু কোনোদিন তাঁর নিজের গান শুনিনি।….চিরজীবন সে অন্যকেই প্রকাশ করেছে নিজেকে করেনি”। ‘বীণ’ নামে একটিমাত্র কবিতার বই তিনি প্রকাশ করেছিলেন, যদিও প্রচার করেননি। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর লেখা গান, কবিতা এবং তাঁর সম্পর্কে স্মৃতিচারণা মিলিয়ে 'দিনেন্দ্র রচনাবলী’ প্রকাশ করেছিলেন তাঁর পত্নী কমলা দেবী।

সংস্কৃত, মৈথিলি ও ফার্সী ভাষাতে দখল ছিল দিনেন্দ্রনাথের। পরিণত বয়েসে তিনি হাফেজের কবিতার বাংলা অনুবাদ করে সুরসংযোগ করেছিলেন। তাঁর দাদামশায়ের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও হাফেজের কবিতার প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল। ইতিহাস এবং ভূগোলেও তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল।

নানা গুণে গুণী দিনেন্দ্রনাথ ছিলেন গানের রাজা। ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর মতো আন্তরিক, রসিক ও অকপট স্নেহশীল মানুষ নিতান্ত বিরল। শান্তিনিকেতনের প্রথম যুগের ছাত্রী বীণাপাণি সান্যাল বলেছিলেন, “যে সময় বালক বালিকারা পিতা-মাতার স্নেহের ছায়ায় মানুষ হইয়া উঠে, সেই সময়েই আমরা তাঁহাদের নিকট হইতে অনেক দূরে। কিন্তু কোনোদিনের জন্যও তাঁহাদের অভাব বোধ করিবার সুযোগ দিনদা দেন নাই। তিনি আমাদের নিজের কন্যার ন্যায় স্নেহ করিতেন”। জানিয়েছেন তেজেশচন্দ্র সেনও, “যেমনি আশ্রমের শালশ্রেণীর নীচে তাঁর বিপুল, বিরাট দেহ দেখা দিত, অমনি আশ্রমের ছাত্র শিক্ষক সকলেই খুশী হয়ে উঠত"। তিনি যে ঘরে বসতেন সেখানেই জমে উঠত মজলিশ। ছোটদের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজতে, বড়দের সঙ্গে বর্ষাদিনে গানের আসরে কখনও এসরাজে সুর বেঁধে, কখনও খালি গলার গানে তিনি শান্তিনিকেতনে সুরপ্রবাহ বইয়ে দিতেন। আশ্রমের পিকনিক তাঁকে ছাড়া চলত না। ছোট থেকে বড় সবাইকে কখনও কালোর দোকানে, কখনও ভোলার দোকানে অথবা নিজের বাড়িতে খাওয়াতে তাঁর জুড়ি ছিল না।

এহেন আনন্দময় গুণী ব্যক্তি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে শান্তিনিকেতন থেকে জোড়াসাঁকোয় চলে এসেছিলেন ১৯৩৩ সালে। এর পর তিনি আর বেশিদিন বাঁচেননি। ১৯৩৫ সালের জুলাই মাসের ২১ তারিখে, শ্রাবণদিনে চিরকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুরের ধারা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...