তাঁর 'ডেকো না মোরে ডেকো না’ গানটির রেকর্ডের অনুমতি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “পাসড উইথ অনার্স” -তিনি কনক দাস।
১৯০২ সালের নভেম্বরের ৩ তারিখে কলকাতায় জন্ম কনক দাসের। তাঁর মা সরলা দেবী ছিলেন সুগায়িকা। ছোট মাসি সুবলা আচার্য ও মেসোমশাই প্রাণকৃষ্ণ আচার্যের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের গানের চর্চা ছিল। কনক দাসের মাতামহ কালীনারায়ণ গুপ্ত ব্রহ্মসঙ্গীত লিখতেন। সুরও দিতেন। সঙ্গীতের এই আবহে বড় হয়ে উঠেছিলেন কনক। পরবর্তী সময়ে নিজের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, “ছোটবেলা থেকেই গান এসে গেছে আমাদের। চেষ্টা করতে হয় নাই”।
জন্ম কলকাতায় হলেও কনক দাসের কৈশোর কেটেছে ঢাকায়। সেখানকার ইডেন হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে কনক আসেন কলকাতায়। ভর্তি হন বেথুন কলেজে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনন্য শিল্পী সাহানা দেবী ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া। তিনিই কনককে নিয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। লজ্জায় কবিকে প্রথম দিন গান শোনাতে পারেননি কনক। পরে অবশ্য শুনিয়েছেন অনেক গান। গান শেখার সুযোগ ও পেয়েছেন কবির কাছে।
সাহানা দেবীর সূত্রে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ গড়ে ওঠে। সেখানকার একাধিক অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন। ‘বর্ষামঙ্গল’ উৎসবে কনক গেয়েছিলেন 'অশ্রুভরা বেদনা দিকে দিকে’। ১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথের ৭০ বছরের জন্মদিনের উৎসবেও সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন।
কনক দাস রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, দিনেন্দ্রনাথ, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী প্রমুখের কাছে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নিয়েছিলেন গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী, সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং যামিনীরঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। সুরসাগর হিমাংশু দত্তের কাছেও গান শেখার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। সাহানা দেবীর সূত্রে দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। তাঁর কাছেও গান শিখেছিলেন কনক। এভাবে নানা গুণীজনসঙ্গ কনক দাসের গায়কীকে সমৃদ্ধ করেছিল।
১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে কনক দাসের প্রথম রেকর্ড ‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে’ এবং 'কবে তুমি আসবে বলে’ প্রকাশিত হয়। এর পর তিনি অনেক রেকর্ড করেন। তাঁর সমকালে তাঁর চেয়ে বেশি গানের রেকর্ড কারও ছিল না। তাঁর রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়াও সুরসাগর হিমাংশু দত্ত এবং অতুলপ্রসাদের বেশ কিছু গানের রেকর্ডও তিনি করেছিলেন। ১৯৪৩ সালে দেবব্রত বিশ্বাসের দাদা অজয় বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়।
কেমন শিল্পী ছিলেন কনক দাস?
যাঁর গানের সঙ্গে অর্গান বাজিয়েছেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী আর পিয়ানো বাজিয়েছেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা সুজাতা দেবী তিনি যে শিল্পী হিসেবে স্বতন্ত্র মর্যাদার অধিকারী তা সহজেই অনুমেয়। তবে একজন শিল্পীর যথার্থ মূল্যায়ন একজন শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব। সেই কারণেই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে দেবব্রত বিশ্বাসের বক্তব্য। “তাঁকে বিয়ের আগে ডাকতাম 'বুঁচিমাসী’, এখন তিনি আমার বৌদি। বুঁচিমাসীর গানের গলায় মিষ্টত্ব তো ছিলই, আবার 'জোয়ারী’ বলে একটি মজার ব্যাপারও ছিল। মনে পড়ে বহু বৎসর আগে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের কোনো একটি উৎসবের দিনে বুঁচিমাসীর সঙ্গে 'হে মোর দেবতা’ গানটি দ্বৈতভাবে গাইতে হয়েছিল। তখনকার দিনে ব্রাহ্মসমাজের মন্দিরে মাইক্রোফোনের ব্যবহারের প্রচলন হয়নি। দুজনে তো গানটি শুরু করলাম। গানটির অন্তরার আগে যখন চড়ার দিকে গাইছিলাম, বুঁচিমাসীর গলার আওয়াজের 'জোয়ারী’ শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিতে লাগল। আমার গলায় গান বন্ধ হয়ে গেল। চোখ বুজে শুনছিলাম বুঁচিমাসীর গান-হঠাৎ তাঁর কনুই-এর ধাক্কায় চমকে উঠলাম। আবার তাঁর সঙ্গে গান ধরতে হল। কিন্তু তখন আমি গাইব কি? কোনোমতে গানটি শেষ করলাম”। কনক দাসের গান শোনা ছিল সেকালের কলকাতার অন্যতম 'স্ট্যাটাস সিম্বল’। “তখনকার দিনে রুচিসম্পন্ন অবস্থাপন্ন রবীন্দ্র- ভক্ত ব্যক্তিদের বাড়িতে অন্যান্য রেকর্ডের সঙ্গে সাহানা দেবী, কনক দাস ও সতী দেবীর রেকর্ড বাজতই’। এরা দুজনেই ছিলেন কনক দাসের আত্মীয়।
কনক দাসের নিজের একাধিক রেকর্ড তো ছিলই তাছাড়া দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গে দ্বৈতকন্ঠেও বেশ কিছু গানের রেকর্ড ছিল। হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, ওই ঝঞ্ঝার ঝংকার ঝংকারে, ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা, সংকোচের বিহ্বলতা ইত্যাদি। কনক দাসের গাওয়া কোথা বাইরে দূরে যায় রে উড়ে, সখী প্রতিদিন হায়, বাজিল কাহার বীণা, সকরুণ বেণু বাজায়ে, সেদিন আমায় বলেছিলেন, ডেকো না মোরে ডেকো না, তোমার আমার এই বিরহের অন্তরালে ইত্যাদি গান অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের গানের প্রথম যুগের যে সব শিল্পীর গানে আদি যুগের গায়কী ধরা আছে তাদের অন্যতম কনক দাস। অবশ্য এই রেকর্ডের পিছনে ছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ভাই প্রফুল্লচন্দ্র মহলানবিশ- ‘বুলা’ নামেই ছিল তাঁর পরিচিতি। মূলত তাঁরই উদ্যোগে কনক দাসের গানের রেকর্ড করা হয়েছিল। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে বেলজিয়ামের রাণীর জন্য যে অনুষ্ঠান হয়েছিল সেখানে কনক আর বিজয়া দাস দ্বৈতকন্ঠে গেয়েছিলেন ‘বন্ধু রহো রহো সাথে’। রবীন্দ্রনাথ একবার তাঁকে চিঠিতে লিখেছিলেন, “শিগগির চলে এসো। নতুন গান শিখবে। দেখো যেন বৃষ্টিতে ভিজে আবার অসুখ বাঁধিয়ে বোসো না”। এই চিঠির পর যে গানটি শিখে ছিলেন কনক তা হল “ধরণীর গগনের মিলনের ছন্দে ছন্দে”। কনক দাসের গানকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন কবি স্বয়ং। একবার শান্তিনিকেতনে বর্ষার গানের এক আসরে কনক দাস প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “এবার যিনি গান শোনাবেন তাঁর নামের ঘোষণার প্রয়োজন নেই, তাঁর কন্ঠ তাঁর পরিচয় বহন করে”।
সেকালে রবীন্দ্রনাথের গানকে বলা হত 'রবিবাবুর গান’। সে গানের গন্ডিও ছিল সীমায়িত। আজ রবীন্দ্রসঙ্গীতের যে বিপুল শ্রোতৃসমাজ তা সেদিন ছিল না। যাঁদের গানে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল এই শ্রোতৃমন্ডলী তাঁদের অন্যতম কনক দাস। ১৯৩৫ সালে কনক দাসের “মনে রবে কি না রবে আমারে” এবং “কাছে যবে ছিল পাশে হল না যাওয়া”- রেকর্ডটিতেই সম্ভবত প্রথম ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ শব্দটির ব্যবহার হয়। গায়িকার পরিচিতি দেওয়া হয়েছিল এই ভাবে-“কনক দাস আধুনিক সঙ্গীতে মহিলা শিল্পীদের মধ্যে রাণীর মহিমায় প্রতিষ্ঠিত। রবীন্দ্রসঙ্গীতে ইনি অতুলনীয়া”।
“অতুলনীয়া”-ই ছিলেন কনক দাস। শুধু গান গাওয়াতেই সীমাবদ্ধ করে রাখেননি নিজেকে। রবীন্দ্রনাথের গানকে সবার কাছে পৌঁছে দেবার গুরুভার দায়িত্বও পালন করেছেন। ১৯৪১-এর ৮ ডিসেম্বর শুরু হল 'গীতবিতান সঙ্গীত শিক্ষায়তনে’র পথ চলা। প্রথম থেকেই এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অজয় বিশ্বাস। কনক দাসও যুক্ত হন। পরে তিনি 'গীতবিতান’- এর অধ্যক্ষও হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গানের বিশুদ্ধতা রক্ষা, গায়কীর বৈশিষ্ট্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে কনক দাসের প্রচেষ্টা ছিল আন্তরিক। রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচার, প্রসার এবং শুদ্ধতা রক্ষার ক্ষেত্রে শৈলজারঞ্জন মজুমদার ও নীহারবিন্দু সেনের মতোই উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব কনক দাস। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন।
১৯৮৮ সালের ৩১ অগাস্ট শিশুমঙ্গল হাসপাতালে প্রয়াত হন কনক দাস।