রবীন্দ্রনাথের গানের অনন্য শিল্পীঃ সতী দেবী

"গুরুদেবের  স্নেহ আমার জীবনে ঈশ্বরের বরদান"- বলেছিলেন সেকালের প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়িকা সতী দেবী। প্রখ্যাত অভিনেত্রী ও গায়িকা রুমা গুহঠাকুরতার মা সতী দেবীর জন্ম ১৯১১ সালে, পাটনায়।  তাঁর  বাবা ব্যারিস্টার চারুচন্দ্র দাস ও মা দেশবন্ধুজায়া বাসন্তী দেবীর ছোট বোন মাধুরী দেবী। চারুচন্দ্র দাস ছিলেন সঙ্গীতরসিক ও অসাধারণ গাইয়ে। 

তাঁর  চার মেয়ের মধ্যে  সতী ও বিজয়া ছোট থেকেই গান গাইতেন। সেকালের  প্রখ্যাত  রবীন্দ্রসঙ্গীত  গায়িকা অমলা দাসের কাছে গান শেখার সৌভাগ্য হয়েছিল সতী দেবীর। তিনি বলেছেন, "....আমি একদিন আপন মনে শ্যামাসঙ্গীত গাইছিলাম, আমি বুঝতে পারিনি মাসিমা( অমলা দাস)  চৌকাঠে দাঁড়িয়ে  শুনছিলেন। আমার গান শুনে উনি কেঁদে  ফেলেছিলেন। এরপর মাসিমাই উদ্যোগী হয়ে প্রমথবাবুর কাছে আমায় গান শেখার ব্যবস্থা করে দিলেন।" চারুচন্দ্র  দাসের মামাতো বোন ছিলেন সাহানা দেবী।  তাঁর কাছেও গান শিখেছেন  সতী দেবী।

রবীন্দ্রনাথের কাছে  কীভাবে গিয়েছিলেন তিনি ?  সেকথা শোনা যাক  সতী দেবীর ছোট বোন বিজয়া রায়ের স্মৃতি  থেকে – " দিনু ঠাকুর 'মায়ার খেলা'-র জন্য  ‘শান্তা’  খুঁজছিলেন। কী করে মেজদির   সঙ্গে  যোগাযোগ হল সে আমার জানা নেই।কিন্তু হয়েছিল, এবং  মেজদির গান শুনেই  উনি ওঁকে  শান্তার জন্য নির্বাচন করেন।" এ প্রসঙ্গে সতী দেবী বলেছেন," ১৯২৬ সাল- সরলা দেবী ' মায়ার খেলা' অভিনয়ের জন্য আমাকে  শান্তা আর অমিয়া ঠাকুরকে প্রমদার ভূমিকার জন্য  নির্বাচন  করলেন। কয়েকদিন রিহার্সালের পর উনি আমাদের দুজনকে জোড়াসাঁকোয় নিয়ে গেলেন কবিকে আমাদের গান শোনাবেন বলে।" তারপর? সে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা।

সতী দেবী  জানিয়েছেন,  সেদিনটার কথা আজও ভুলতে পারিনি। বোধহয় জীবনের শেষ  দিন অবধি, যতক্ষণ চেতনা থাকবে ভুলব না। এমন আনন্দময় মুহূর্ত সারাজীবনে একাধিকবার  আসে না ত। আমরা দুজনে কম্প্রবক্ষে, উৎসুক নেত্রে অপেক্ষা করে বসে আছি কখন তিনি আসবেন।.... কবি এলেন...... আর সঙ্গে  এল নন্দনকাননের পারিজাত গন্ধ...কবি চোখ বুজে  শুনছিলেন। আমি গাইবার সময় কোনোদিকে তাকাইনি। রানু(অমিয়া ঠাকুর) যেই শুরু করল একবার চট করে ওঁর মুখে চোখ বুলিয়ে দেখলাম-বেশ খুশি খুশি ভাব। গান শেষ হবার পর ওঁর সেই অনুকরণীয় মোলায়েম মিহি গলায় বললেন, "হ্যাঁরে সরলি, তুই এত সব সুন্দর সুন্দর গলা কোথা থেকে যোগাড় করলি রে?-নাঃ এত প্লেন সুর এঁদের গলায় বেমানান, সুরের মধ্যে আর একটু খোঁজ-খাঁজ জুড়তে হবে।" এরপর রবীন্দ্রনাথ নিজেই আমাদের গান শেখালেন- "তারপর আমাদের গাওয়াতে গাওয়াতে গানগুলির কোথায় কোথায় আরো সূক্ষ্ম মীড়, শ্রুতি কিংবা ছোট্ট একটু তানের মতো গিটকিরি দিলে ভালো হয় দেখিয়ে দিলেন।" এই হল শুরু। তারপর যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তাঁর স্নেহ থেকে কোনওদিন বঞ্চিত হইনি।"

কেমন হয়েছিল সেই 'মায়ার খেলা'? চিত্রা দেবকে অনুসরণ করে বলা যায়, "দীর্ঘদিন রিহার্সাল চলার পর 'রক্সি' সিনেমা হলে যে সেই 'মায়ার খেলা'-র অভিনয় দেখেছে সেই শুধু বলতে পারে কী  সুন্দর অভিনয় হয়েছিল। শান্তা সেজেছিলেন রুমা গুহের মা সতী দেবী।"এই অভিনয় সতী দেবীর জীবনের আর এক অধ্যায়েরও সূচনা করেছিল। জানিয়েছেন বিজয়া রায়, "কলকাতায় 'মায়ার খেলা' ও মেজদির গান শুনে মন্টিদা ওঁর প্রেমে পড়ে যান। বন্ধুবর পালোয়ানদার সাহায্যে আমার বাবা-মার কাছে বিয়ের প্রস্তাব করেন।.......মেজদির বয়স তখন ১৭।" সতী দেবী বলেছিলেন, "এই 'মায়ার খেলা'র রিহার্সালের সময়ই রুমার বাবার সঙ্গে পরিচয়। ওঁর বিরাট গাড়ি করে আমাদের প্রতিদিন রিহার্সালে নিয়ে যেতেন আবার বাড়ি পৌঁছে দিতেন। আমার গান শুনে উনি মুগ্ধ। তারপরই আমাদের বিয়ে হল। বিয়ের পর ওঁরই আগ্রহে অমূল্য মুখার্জির কাছে গান শেখার শুরু।" ১৯২৮ সালে সতী দেবীর সঙ্গে  সত্যেন  ঘোষের বিয়ে হল। এই প্রসঙ্গে অমিয়া ঠাকুর বলেছেন, "মায়ার খেলার পরই আমাদের সবার বিয়ে হয়ে গেল। ইন্দিরাপিসি ( ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী) ঠাট্টা করে বলেছিলেন, দেখলি তো? 'মায়ার খেলা' করার পরই সব ঝপাঝপ কেমন বিয়ে হয়ে গেল।"

 

Sati1

 

সতী দেবীর প্রথম রেকর্ড 'হে ক্ষণিকের অতিথি'। গানটি রেকর্ড করার কথা ছিল কনক দাসের ( বিশ্বাস)। তিনি ছিলেন সতী দেবীর ছোট পিসি। "কিন্তু উনি বড্ড ভীতু আর লাজুক ছিলেন। একলা গ্রামোফোন কোম্পানিতে রেকর্ড করতে যাবেন না। আমাকেও সঙ্গে যেতে হল। সেখানে গিয়েও কিছুতেই আগে গাইতে রাজি হলেন না। সেই এক জেদ, বুড়ী আগে গাক। ও না গাইলে আমি গাইব না। ভয়কাতুরে শিশুর মতো আমায় ঠেলা দিলেন। 

আমার গান শুনেই ওখানকার সাহেব রেকর্ডিস্ট বললেন, মে আই টেক ইয়োর রেকর্ড?" তারপর? কেমন ছিল সেকালের রেকর্ডিং পদ্ধতি? "প্রথমটায় রেকর্ড করতে আমার মতো দুর্দান্ত সাহসী মেয়েরও একটু দ্বিধা জেগেছিল। চোঙার ভেতর মুখ ঢুকিয়ে গাইতে হবে। সাহেব দুহাতে মাথা ধরে থাকবেন। উঁচু পর্দায় গলা তোলবার সময় হ্যাঁচকা টানে মাথাটা বাইরের দিকে সরিয়ে নিয়ে পিচ কন্ট্রোল করবেন। আবার নীচু পর্দায় গাইবার সময় মাথাটা ধরে চোঙার দিকে এগিয়ে দেবেন"। 

এই ভয়ঙ্কর পদ্ধতিতেও প্রথম টেকেই উতরে গেলেন সতী। "........সাহেব হাঁকলেন, পার্ফেক্টলি অলরাইট"। এরপর হিমাংশুকুমার দত্তের সুরে তাঁর প্রথম রেকর্ড "সাগরপাড়ের বন্ধু আমার"। এই রেকর্ডের পর হিমাংশু দত্তের ট্রেনিং-এ প্রায় পনেরোটি গান তিনি রেকর্ড করেন। প্রতিটি গানই হিট হয়। " আঁখিতে ভরিয়া জল" গানটি সবার মুখে মুখে ফিরেছিল"। সতী দেবীর ছোটবোন বিজয়াও ভালো গাইতেন-"বিজয়া (সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রী), আমি, ছোট পিসি প্রায়ই নানা ঘরোয়া আসরে একসঙ্গে গাইতাম। আমাদের বাড়িতেই একটা শিল্পীমন্ডলী গড়ে উঠেছিল বলেই গানটা জীবনে এতবড় হয়ে উঠতে পেরেছে আর গানকে ঘিরেই দল মেলেছিল আমাদের যৌবনের আশা- আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের কিরণ বিলাসী কুঁড়িগুলি"- বলেছেন সতী দেবী।

বাংলা গানের আর এক দিকপাল অতুলপ্রসাদ সেন ছিলেন সতী দেবীর জ্যাঠামশাই। তাঁর কাছেও গান শেখার সৌভাগ্য হয়েছিল সতী দেবীর। অতুলপ্রসাদের অনেক গান তিনি রেকর্ডও করেছিলেন। "প্রথম রেকর্ডের গান বোধহয় 'তুমি যখন গাওয়াও গান'। লাস্ট রেকর্ড ওঁর সুরে করি, রুমা তখন ১০ মাসের"। একবার এলাহাবাদ মিউজিক কনফারেন্সে সতী দেবী অতুলপ্রসাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন "সেখানে ভাতখন্ডের 'বন্দেমাতরম্'  শুনে স্পেলবাউন্ড হয়ে গিয়েছিলাম।"

ঘনিষ্ঠতা ছিল উদয়শঙ্করের সঙ্গে ও।নিউ এম্পায়ারে উদয়শঙ্করের 'শো' দেখেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন সতী দেবী। পরে এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে আলাপ হয় উদয়শঙ্করের সঙ্গে। সতী দেবীর গান শুনে উদয়শঙ্কর অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন। এরপর ডায়মন্ডহারবারে উদয়শঙ্কর আয়োজিত এক মুনলাইট পার্টিতে তিনি সতী দেবীকে গান গাইবার জন্য আহ্বান করলেন। "উদয়শঙ্করের অনুরোধেই গাইলাম 'চাঁদিনী রাতে কে গো আসিলে' আর 'জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে'।"গানের জগতে যথেষ্ট নামডাক থাকলেও সতী দেবীর ব্যক্তিগত জীবন কেটেছে অত্যন্ত সমস্যায়। বিজয়া রায় লিখেছেন, "মেজদি তখন 'ইন্দিরা' সিনেমার পাশে একটা বাড়ি ভাড়া করে ছিলেন। মন্টিদা তাঁর ধনসম্পত্তি প্রায় সব নিঃশেষ করে এনেছিলেন। মেজদি গান শিখিয়ে সংসার চালাতেন। 

কিন্তু মুখের হাসিটি লেগে থাকত। কোনও কিছুতে দমবার পাত্রী ছিলেন না"। 'ইন্দিরা' সিনেমা হলের পাশে ইন্দ্র রায় রোডে 'সুরবিতান' নাম দিয়ে তিনি গানের স্কুল খুলেছিলেন "...... রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাবার উদ্দেশ্যে"। তা ছাড়া শঙ্কর কীর্তনালয়, কমলা গার্লস স্কুলেও তিনি গান শিখিয়েছেন। " কি প্রচন্ড পরিশ্রম। রিকশা থেকে যখন নামতাম, রাত ১০টা হয়ে যেত"। এইসময় লাহোর রেডিও স্টেশন থেকে প্রচারিত সতী দেবীর গান 'তোমায় আমায় মিলন হবে' শুনে উদয়শঙ্কর লিখলেন, "আপনি ইমিডিয়েটলি আলমোড়ায় চলে আসুন। আমার বিয়ে। আপনার গান না হলে চলবে না"। আলমোড়ায় উদয়শঙ্করের ট্রুপে যোগ দিলেন সতী দেবী। গান শেখাবার পাশাপাশি মেয়েদের হোস্টেলের দায়িত্বও ছিল তাঁর ওপরে। কাছেই থাকতেন আনন্দময়ী মা। তাঁকেও সতী দেবী শোনাতেন ভজন 'ঠুমক চলত' ইত্যাদি।

পৃথ্বীরাজ কাপুরের 'পৃথ্বী থিয়েটারে' যোগ দিয়ে মুম্বইতেও ছিলেন সতী দেবী। 'শকুন্তলা'য় প্লে- ব্যাকের জন্য তিনি এসেছিলেন, তারপর শকুন্তলার রোলে অভিনয়ও করেছেন। মুম্বাইতে সতী দেবী অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন এবং প্রতিটি নাটকই জনপ্র্রিয় হয়েছিল। হিন্দি, উর্দূ, পুশতু ও পাঞ্জাবি ভাষায় তিনি নাটক করেছেন। সতী দেবী 'পৃথ্বী থিয়েটারে' মিউজিক ডিরেক্টারের কাজও করেছেন। তিনি ছিলেন ভারতের প্রথম মহিলা সঙ্গীত পরিচালক। বিজয়া রায়ের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, "মেজদি বেশিদূর লেখাপড়া করেননি। কিন্তু ভাষার ওপর একটা অদ্ভুত দখল ছিল। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি তিনটি ভাষাই বেশ ভালো বলতে পারতেন। কাজেই কাজ পেতে অসুবিধা হল না। তার ওপর অভিনয়টা তো রীতিমতো ভালো করতেন"।

বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ছিল সতী দেবীর জীবন। যদিও এত কিছুর পরেও রবীন্দ্রনাথ ও দিনেন্দ্রনাথের সঙ্গে কাটানো দিনের স্মৃতিই তাঁর জীবনে সবচেয়ে আনন্দের বলে তিনি মনে করতেন। "রেকর্ড করবার আগে জোড়াসাঁকোতে গুরুদেবের কাছে গান তোলা আর লাভলক প্লেসে দিনুদার কাছে শেখা সে এক উদ্দীপনার দিন গেছে"। শান্তিনিকেতনের দিনগুলিও সতী দেবীর স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে বিরাজ করত। "সৌম্যদা আমাকে ও ছোটপিসিকে রোজ কবির কাছে নিয়ে যেতেন উনি গান রচনা করার সঙ্গে সঙ্গেই দিনুদা স্বরলিপি করে দিতেন। 

একটা গান সকালে হয়ত ভৈরবীতে সুর দিলেন, আবার বিকেলে গাইবার সময় গাইলেন খাম্বাজে। দিনুদা সকালের সুর শোনাতেন। বলতেন, দিনু তুই ভুল সুর করছিস। অমনি লাগত। দিনুদা সঙ্গে সঙ্গে স্বরলিপি দেখিয়ে দিতেন। আর কবি ছেলেমানুষের মতো অপ্রস্তুত মুখ করে বসে থাকতেন।" রবীন্দ্রনাথের ফেলে দেওয়া ছবি সতী দেবী বাস্কেট থেকে তুলে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সেই ছবিটি দিতে চান নি। কিন্তু সতী দেবী না- ছোড়-" অনেক ঝগড়াঝাঁটি করে ওঁর অপছন্দের ছবিখানিই আদায় করে নিলাম। কিন্তু উনি সই দিতে নারাজ"। তাও আদায় করলেন ঝগড়া করেই।

 সে ছবি সতী দেবীর কাছে ছিল আজীবন। একবার 'আনমনা আনমনা' গানটিতে সামান্য একটু অলঙ্কার বেশি দিয়েছিলেন বলে রবীন্দ্রনাথ রেকর্ডটি নাকচ করে দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে তর্ক করেও কবিকে সিদ্ধান্ত থেকে সরিয়ে আনতে পারেন নি সতী। যদিও এসব তুচ্ছ করে সতী দেবীর কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের নিবিড় স্পর্শ চিরসত্য হয়ে উঠেছিল-"এক হিসেবে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ভারতীয় সঙ্গীতের সূচীপত্রও বলা যায়। প্রতিটি গানের কথার সঙ্গে সুরের স্টাইলের কি নিবিড় সখ্য এ জিনিস আর কোথাও মেলে না"।

অতুলপ্রসাদের বাড়িতেই সতী দেবীর আলাপ হয়েছিল সায়গলের সঙ্গে। "প্রথম আলাপেই বলেছিলেন, ' দিদি আপনার মতো অত ভালো গাইতে না পারলেও আমিও রবীন্দ্রনাথের গান গাই।.... তারপর আমারই অনুরোধে গেয়ে শোনালেন, 'কবে তুমি আসবে বলে.......'। তেমন কন্ঠ তেমনই প্রাণকাড়া গাইবার স্টাইল"। সেকালের নামজাদা গায়িকা- নায়িকা কানন দেবীর একটি ফিল্মেও প্লে- ব্যাক করেছিলেন সতী দেবী। গানটি হল "তোমায় আমায় মিলন হবে বলে"।  

কানন দেবীর ফ্যারেনজাইটিস হওয়ায় গান গাইতে সমস্যা ছিল। " রাইবাবু আমায় আমন্ত্রণ জানালেন,'আপনি গাইলে আমি ভরসা পাই'। তখন কানন দেবীর ও তাঁর গানের অত নামডাক, গ্ল্যামার। ওঁর প্লে-ব্যাক করব শুনে নেচে উঠলাম। গ্রামোফোন কোম্পানিতে গিয়ে অনেক অনুনয় বিনয় করলাম 'প্লিজ একটা গান অন্য কোম্পানিতে ( কানন দেবী তখন মেগাফোনের আর্টিস্ট) করতে অনুমতি দিন। এ চান্স মিস করলে আমার একটা আফশোষ থেকে যাবে। ওঁরা অনুমতি দিলেন"।

কংগ্রেসের কনফারেন্সেও গান গেয়েছিলেন সতী দেবী। "প্রত্যেক বছর কংগ্রেসের কনফারেন্সে আমি উদ্বোধন সঙ্গীত গাইতাম।গয়া কংগ্রেসে মেসোমশাই ( চিত্তরঞ্জন দাস) প্রেসিডেন্ট ছিলেন, সেখানে গেয়েছি। একবার এক ঘটনা ঘটেছিল- "সুভাষদা( সুভাষচন্দ্র বসু) মাসিমাকে 'মা' বলতেন। উনি বললেন- 'সতী, এবছর আমার সেশনে ওপেনিং সং গাইবে তুমি। আমি রাজি হয়ে গেলাম। ১৯৩৯ সাল সেটা। ওদিক থেকে সরোজিনী নাইডু বললেন- সতী বি রেডি। এবার কংগ্রেসের কনফারেন্সে আবুল কালাম আজাদ আসছেন। তুমি গাইছ ওপেনিং সং। কিন্তু আমার তখন সুভাষদাকে কথা দেওয়া হয়ে গেছে। সেবার কংগ্রেস ফাংশনে গাওয়া আর হল না"।

কলকাতার সর্বপ্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার প্রতিষ্ঠান ছিল 'গীতালি'। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ছোট ভাই প্রফুল্লচন্দ্র মহলানবিশ, যিনি 'বুলা' নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথের কাছে যাঁর অবারিত দ্বার ছিল, তিনি বলেছিলেন, "গীতালিই সর্বপ্রথম কলকাতায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষায়তন হয়েছিল। ..... গীতালির উদ্বোধনে কনক দাসের একক কন্ঠে গান 'আমার নাই বা হল পারে যাওয়া' এবং সোমেন গুপ্ত ও সতী দেবীর যুগ্ম কন্ঠে ' জানি জানি হল যাবার আয়োজন' গান দুটি সকলের কাছে অনবদ্য মনে হয়েছিল। কবি স্বয়ং এই তিনজনকে কাছে ডেকে এনে আশীর্বাদ করেছিলেন"। রবীন্দ্রনাথ যখন মুম্বাইতে ' তাসের দেশ' ও 'শাপমোচন'- এর জন্য শান্তিনিকেতনের দল নিয়ে গিয়েছিলেন তখন তিনি সেখানে সতী দেবীর খোঁজ করেছিলেন। " আমিও সেই উৎসবে গেয়েছি ওঁরই ইচ্ছেয়। উনি প্রথমে আবৃত্তি করলেন 'যেথায় থাকে সবার অধম' তারপর আমি সেইটেই গাইলাম"। রুমা গুহঠাকুরতা মুম্বাই থাকার সময় একাধিকবার রবীন্দ্রজয়ন্তী করেছিলেন সেখানেই শেষবার প্রত্যক্ষ মঞ্চে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন সতী দেবী। গানগুলি ছিল 'আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে' আর 'তোমার নাম জানি নে সুর জানি'।

সতী দেবী এমন একজন গায়িকা ছিলেন যাঁর সম্বন্ধে প্রফুল্লচন্দ্র মহলানবিশ বলেছিলেন, " ..... মহিলা শিল্পীদের কয়েকজন, যাঁদের মধ্যে সতী দেবী, কনক দাস প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। বলতে গেলে এঁরা দুজনেই আজকালকার মেয়েদের রেকর্ডে গান দেবার পথপ্রদর্শক"।

মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন  সতী দেবী? লিখেছেন বিজয়া রায়, "মেজদি খানিকটা কাকার মতো ছিলেন। জানাশোনা লোককে বিপদে পড়তে দেখলেই নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিতেন"। গান, অভিনয় ছাড়াও রান্নাতেও তাঁর দক্ষতা ছিল।

১৯৭৯ সালের ১৪ আগস্টে, রাতে ঘুমের মধ্যেই প্রয়াত হলেন সতী দেবী।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...