রবীন্দ্রনাথের গানের অনন্য শিল্পীঃ অনাদিকুমার দস্তিদার

“একদা শান্তিনিকেতন আশ্রমে সংগীতের কর্ণধার ছিলেন-অবশ্য কবিগুরুকে বাদ দিয়ে- দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পন্ডিত ভীমরাও শাস্ত্রী। পরম শ্রদ্ধেয় মমাগ্রজসম শ্রীযুত অনাদিকুমার দস্তিদার ( শতং জীব, সহস্রং জীব)তখন ছাত্র। কিন্তু আমি তাঁকে কখনো ছাত্র বলে ভাবতেই পারিনি।...শ্রীঅনাদি ছিলেন অনেক উঁচুতে; দুই গুরুর আদেশ নির্দেশ শিক্ষাদান ব্যবস্থা প্রভৃতি সর্বকর্মের অব্যবহিত প্রধান।”

যাঁর সম্বন্ধে শান্তিনিকেতনের প্রাক্তনী সৈয়দ মুজতবা আলী এই মন্তব্য করেছিলেন, তিনি অনাদিকুমার দস্তিদার

১৯০৩ সালে সিলেটে জন্মগ্রহণ করেছিলেন অনাদিকুমার। ১৯১২ সালে, যখন তাঁর বয়স মাত্র নয় বছর তখন তিনি ব্রহ্মচর্যাশ্রমের ছাত্র হয়ে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। ১৯২০-তে এন্ট্রান্স পাশ করার পর দীর্ঘ পাঁচ বছর রবীন্দ্রনাথ ও দিনেন্দ্রনাথের কাছে রবীন্দ্রসংগীত শিখেছিলেন। শাস্ত্রীয় সংগীতে তিনি তালিম নিয়েছিলেন পন্ডিত ভীমরাও শাস্ত্রী ও নকুলেশ্বর গোস্বামীর কাছে শান্তিনিকেতনে এবং রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামীর কাছে কলকাতায়।

শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন তাঁর কাজের পরিধি কীরকম ছিল তাঁর বর্ণনা আছে মুজতবা আলীর লেখায়- “অভিজ্ঞজনমাত্রই জানেন এক সংগীতসাধনাই মানুষকে অজগরের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে, তদুপরি তাঁর স্কন্ধে চাপানো হল বিশ্বভারতীর 'সাহিত্যসভা'-র সম্পূর্ণ কর্মভার। ...... গুরুদেব আশ্রমে থাকলে সর্বদাই এর অনুষ্ঠানাদির সভাপতিত্ব করতেন। একে তো অধিকাংশ আশ্রমবাসী, সহজেই অনুমেয় কারণে, গুরুদেবের সম্মুখে প্রবন্ধ পাঠ করতে সংকোচ এমন কি, কিঞ্চিৎ শঙ্কা অনুভব করতেন, তদুপরি গুরুদেবের নিয়মনিষ্ঠা, সময়ানুবর্তিতা, রুচিসম্মত পদ্ধতিতে সভার আয়োজন করা যে কোনো.......বিভাগের ছাত্রদের পক্ষেই নিঃসন্দেহে সুকঠিন কর্মরূপে বিবেচিত হত এবং অনাদিদা ওই সময়ে যুগপৎ অভ্যাস করছেন শাস্ত্রীয় ও রবীন্দ্রসংগীত, তদুপরি নবাগতদের সংগীত শিক্ষাদান, এবং স্বরলিপি রচনায় প্রচুর কালক্ষেপণ। ইতিমধ্যে যদি বাইরে কোনো কলেজ থেকে ক্রিকেট বা ফুটবল টিম খেলার নাম করে শান্তিনিকেতনের 'চিড়িয়াখানা' দেখতে আসত অনাদিদার উপর-ই ভার পড়ত সন্ধ্যাবেলায় তাদের জন্য সংগীতামোদের ব্যবস্থা করা।”

এই বিস্তৃত কর্মকান্ড অনায়াসে সম্পন্ন করার শক্তি রাখতেন অনাদিকুমার। অজাতশত্রু স্বল্পভাষী এই ব্যক্তি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের পরম আস্থাভাজন। স্বয়ং গুরুদেব, দিনেন্দ্রনাথ, পন্ডিত ভীমরাও শাস্ত্রী তাঁকে অশেষ স্নেহের চক্ষে দেখতেন। ছাত্রদের মধ্যে তিনি যে রবীন্দ্রসংগীতের ভান্ডারী,  কার্যত সেটা বারবার স্বীকার করেছেন তাঁরা।

রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি তৈরির ক্ষেত্রে অনাদিকুমার ছিলেন অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তিনি একাধিক রবীন্দ্রসংগীতের স্বরলিপি করেছিলেন। সংগীতভবন প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই অর্থাৎ ১৯১৯ সাল থেকেই তিনি এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রসংগীতের যথার্থ স্বরলিপি তৈরি ও সেগুলির প্রকাশ, অপ্রকাশিত স্বরলিপি প্রকাশ ইত্যাদিতে ছিল তাঁর আন্তরিক আগ্রহ। স্বরবিতান প্রথম খন্ড ভাদ্র ১৩৪২ সনে প্রকাশিত হয়েছিল। স্বরবিতানের দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশিত হয় ১৩৫৪-র ভাদ্র মাসে। এই সংস্করণের মুখ্য দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর।

 ১৯৪৮ সালে রথীন্দ্রনাথ ও ইন্দিরা দেবীর উদ্যোগে ‘স্বরলিপি সমিতি’ তৈরি হলে অনাদিকুমার সমিতির সম্পাদক হন। ১৯৪৯ সালে কলকাতায় বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগে স্বরলিপি সমিতির সম্পাদক পদে তিনি যোগ দেন। ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রসংগীতের সমস্ত স্বরলিপি সম্পাদনার দায়িত্ব তিনি দায়িত্ব সহকারে পালন করেছেন। তাঁর ওপর রবীন্দ্রনাথের কতখানি আস্থা ও আশা ছিল তার প্রকাশ আছে একটি চিঠিতে- “বীণকর ওখানে যদি না থাকেন তবে তুমি গোঁসাইজীর কাছ থেকে সুরবাহার অভ্যাস করো- এবং বিশেষ যত্ন করে স্বরলিপি শিখো। ..........দিনুর কাছ থেকে ইংরেজী সংগীতের স্টাফ নোটেশন শিখে নিও।.........তুমি আমাদের বিশ্বভারতীতে একদা সংগীতাচার্য হবে, এই আমার মনে আছে।”

 রবীন্দ্রনাথ যাঁর ওপর এতখানি আশা করেছিলেন তিনি যে সর্বতোভাবে ব্যতিক্রমী তা দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়। শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন তিনি সকালবেলার বৈতালিকের পুরোভাগে থাকতেন- মারাঠি সংগীতজ্ঞ স্বর্গীয় ভীমরাও শাস্ত্রী তখন সকালবেলার বৈকালিক লিড করতেন। তাঁর কিছুদিন পরে শ্রীযুক্ত অনাদি দস্তিদার।

শাস্ত্রীয় কন্ঠসংগীতের পাশাপাশি তাঁর তালিম ছিল যন্ত্রসংগীতেও। পিঠাপুরমের রাজসভার শিল্পী পন্ডিত মঙ্গলেশ্বর শাস্ত্রীর কাছে তিনি বীণা বাজাতে শিখেছিলেন। বীণাবাদনে তাঁর দক্ষতা এতটাই ছিল যে উদয়শঙ্করের ট্রুপে তিনি কিছু দিন বীণা বাজিয়েছিলেন। ১৯৩৩ সালে উদয়শঙ্করের সঙ্গে তাঁর ইউরোপ যাবার কথা থাকলেও পিতৃবিয়োগজনিত কারণে তিনি যেতে পারেননি। সে যুগের শান্তিনিকেতনের উদার আবহে সংগীতচর্চার যে ব্যাপ্তি ছিল অনাদিকুমার তা সর্বাংশে গ্রহণ করেছিলেন। 'নটীর পূজা'-তে তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষুর অভিনয়ও করেছিলেন।

আর্থিক কারণে ১৯২৫ সালে তিনি কলকাতায় চলে এসে রবীন্দ্রসংগীত শেখাতে শুরু করেন। প্রথমে 'সংগীত সম্মেলনী' ও 'বাসন্তী বিদ্যাবীথি'-তে ও পরবর্তী সময়ে 'গীতবিতান' প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ও দিনেন্দ্রনাথকে বাদ দিলে শান্তিনিকেতনের বাইরে রবীন্দ্রসংগীতের প্রথম শিক্ষক তিনিই। অনাদিকুমারের আর্থিক প্রয়োজন রবীন্দ্রনাথের অজানা ছিল না। তিনি তাঁকে একটি সার্টিফিকেট লিখে দিয়েছিলেন। পরিবার সহ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে থাকার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গান তখন নিতান্তই ছোট এক গন্ডিতে আবদ্ধ ছিল। তাই সেই গান শিখিয়ে সংসার নির্বাহ কত কঠিন তা রবীন্দ্রনাথের অজানা ছিল না। আদর্শবান এই ছাত্রটির প্রতি কবির অন্তরের ভালোবাসা ছিল।

তখনকার কলকাতায় কোনো অনুষ্ঠানে বা সম্মেলন হলে সংগীত পরিবেশন ও পরিচালনার জন্য ডাক পড়ত অনাদিকুমারের। ১৯২৮ সালে কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশন হয়েছিল। সেখানে সংগীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন অনাদিকুমার দস্তিদার। শোনা যায়, মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির অধিবেশন যে ঘরে হচ্ছিল তার পাশের ঘরে অনাদিকুমারের নেতৃত্বে গানের মহলা চলছিল। গানের সুরে ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের উতলা হতে দেখে গান্ধীজী অধিবেশন বন্ধ করে গান শুনেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথের নাতি সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, জোড়াসাঁকোর ১১ই মাঘের অনুষ্ঠানে ইন্দিরা দেবী, মেনকা ঠাকুর ইত্যাদির সঙ্গে অনাদি কুমার দস্তিদারও গান গাইতেন।

বেতারকেন্দ্র, চলচ্চিত্র, থিয়েটার এবং রেকর্ড কোম্পানি সর্বত্র তিনি রবীন্দ্রনাথের গানের শিক্ষক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। শান্তিনিকেতনের আর এক প্রাক্তনী, রবীন্দ্রস্নেহধন্য সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী বলেছিলেন, "রবীন্দ্রসংগীত আজ সিনেমা, বেতার এবং বহুতর স্কুলের কল্যাণে বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতেছে, এটি বহু অভাব অভিযোগক্লিষ্ট বাঙালি সমাজের পক্ষে একটি স্বর্গীয় আশীর্বাদ। এই কল্যাণব্রতের গোড়ার দিকে অনাদির নাম। কাজেই বাঙালি সংস্কৃতির এই দিকটার আদিযুগে অনাদির দান ও প্রচেষ্টা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।" রাইচাঁদ বড়াল তাঁকে নিউ থিয়েটার্সে নিয়ে গিয়েছিলেন।

তিনি যুক্ত ছিলেন বম্বে টকিজের সঙ্গেও। কৃষ্ণচন্দ্র দে, কে. এল. সায়গল, কানন দেবী, সুপ্রীতি ঘোষ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীরা তাঁর পরিচালনায় রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাহিনি অবলম্বনে " দৃষ্টিদান" ও "নৌকাডুবি" ছবিতেও তিনি সংগীত পরিচালনা করেছিলেন। সেকালে বেশিরভাগ রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড তাঁর নির্দেশনাতেই হত। তাঁরই আগ্রহে থিয়েটারেও রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহৃত হতে লাগল। শিশিরকুমার ভাদুড়ির ‘চিরকুমার সভা’ ও ‘শেষরক্ষা’ নাটকে অনাদিকুমার সংগীত পরিচালনা করেছিলেন। পরে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন স্টার থিয়েটারের সঙ্গে। সেখানেও একাধিক নাটকে তিনি সংগীত পরিচালনা করেছিলেন। রেডিয়োয় রবীন্দ্রসংগীতের ব্লক প্রোগ্রামও তাঁর প্রচেষ্টাতে শুরু হয়।

রবীন্দ্রনাথের গানের গায়কী বিষয়ে তাঁর বক্তব্য ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। রবীন্দ্রনাথের রাগাশ্রয়ী গানের গায়কী সম্বন্ধে তিনি বলেছেন, “কিছুদিন যাবৎ উচ্চাঙ্গ রবীন্দ্রসংগীত নামে একটি জিনিষ শুনতে পাই। অর্থাৎ ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল বা টপ্পা জাতীয় রবীন্দ্রসংগীতগুলি ঠিক ঠিক মার্গসংগীতের ঢং-এ বাট, দুন, তান প্রভৃতি যোগে গাওয়া হয়ে থাকে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এর প্রয়োজন দেখিনা।.........দরকার হলে রবীন্দ্রনাথ নিজেই তান, বাট যোগ করে দিতে পারতেন। কোন কোন গানের অংশবিশেষে তিনি সেরূপ করেছেনও। সুতরাং আমার অনুরোধ রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকে কেউ শোধরাবার অথবা ‘ইম্প্রুভ’ করার চেষ্টা না করেন।" কীভাবে গাওয়া হবে রবীন্দ্রনাথের গান? অনাদি কুমারের মতে, “আজকাল রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার খুবই বেড়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু রবীন্দ্রপ্রতিভার সূক্ষ্ম সুর এবং ঢং- এর বিশুদ্ধতার প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা হচ্ছে বলে মনেহয় না। সা রে গা মা ঠিক রেখে গান গাইলেই তো সবসময় গান হয় না। সেটার স্বর গাওয়া হয়।.........বরং দরদ দিয়ে ঢংটি বজায় রেখে গাইলে সা রে গা মা একটু ইতরবিশেষ হলেও কিছু আসে যায় না। যতদূর সম্ভব পরম্পরালব্ধ গায়কী স্মরণ রেখে স্বরলিপিকে অনুসরণ করাই উচিত।”

রবীন্দ্রনাথের গানের প্রচারে তাঁর অসাধারণ নিষ্ঠা ছিল। রবীন্দ্রসংগীতের যথার্থ শিক্ষার জন্য ১৯৪১ সালে ‘গীতবিতান শিক্ষায়তন’ স্থাপনেও তিনি উদ্যোগ ছিল উল্লেখযোগ্য। তাঁর সমস্ত জীবন ছিল রবীন্দ্রসংস্কৃতির জন্য উৎসর্গীকৃত। কর্মময় জীবনে অর্থ ও যশের অভাব তাঁর হয়নি। কিন্তু ধনের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল না। নিরহঙ্কার, আত্মপ্রচারবিমুখ, কৌতুকপ্রিয় ও সত্যভাষী অনাদিকুমার শেষ জীবনে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন। স্মৃতিভ্রম হয়ে বিদ্যাসাগর স্ট্রিটের বাড়িতে শুয়ে স্ত্রীকে বলতেন, “তাড়াতাড়ি করো। দিনদা রিহার্সাল শুরু করে দিয়েছেন,  গুরুদেব এসে পড়েছেন। এটা তো ঠাকুরবাড়ি আমায় ফিরতে হবে শান্তিনিকেতনে।”

১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখে অনাদিকুমার দস্তিদার সেই দেশে পাড়ি দিলেন, যেখানে চিরদিনের আবাসে তাঁর দিনদা ও গুরুদেব তাঁরই প্রতীক্ষা করছিলেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...