১৯৬২-র মে মাসের ৪ তারিখ। আবু সয়ীদ আইয়ুব এক চিঠিতে লিখলেন কুড়ি বছর আগের এক সকালের কথা। লিখলেন রবীন্দ্রনাথের গানের এক অনন্য গায়িকা রাজেশ্বরী দত্তকে। "Sudhin just introduced you as Miss Vasudeva and after a few minutes I asked you if Rajeswari Vasudeva was any relation of yours. Her very beautiful recording of আজি তোমায় আবার চাই শুনাবারে had recently come out and I had played it so many times that I felt I know this Vasudeva very well. I wonder why I didn't connect you with her immediately perhaps because I found it difficult to believe that I was meeting such a wonderful (at least to me) singer face to face. She was only a voice, only a name on a gramophone record". যাঁর গান শুনে আইয়ুবের মতো বিদগ্ধজন এত উতলা, তাঁর স্বাতন্ত্র্য তো সহজবোধ্য।
রাজেশ্বরীর জন্ম ১৯১৮( মতান্তরে ১৯২০)-র ১৭ এপ্রিল। তাঁরা ছিলেন তিন ভাই ছয় বোন। তাঁর বাবা অর্জুনদাস বাসুদেব ছিলেন লাহোর কোর্টের বিচারক। লাহোরের সেক্রেড হার্ট কনভেন্ট স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন রাজেশ্বরী। তারপর সংস্কৃতে অনার্স নিয়ে গভর্নমেন্ট কলেজ ফর উইমেন থেকে ১৯৩৮ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক পেলেন তিনি। ছোট থেকে গান শেখার সুযোগ পাননি। কিন্তু আগ্রহ ছিল। নিতান্ত অল্পবয়সেই তিনি জানতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের কথা- যেখানে মেয়েরা অনায়াসে গান শিখতে পারে। টান অনুভব করেছিলেন। এতটাই প্রবল ছিল সেই টান যে সুদূর লাহোর থেকে অজানা অচেনা বাংলার শান্তিনিকেতনে পাড়ি জমাতে দ্বিধা করেননি। স্বাভাবিকভাবেই বাড়িতে সম্মতি পাওয়া সহজ ছিল না। কিন্তু রাজেশ্বরী যে অন্য ধাতুতে গড়া। ১৯৩৮-এ তিনি এলেন শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথের তখন পড়ন্ত বেলা।
১৯৩৮ থেকে ১৯৪২- রাজেশ্বরী ছিলেন শান্তিনিকেতনে, সঙ্গীত ভবনের ছাত্রী হয়ে। কেমন ছিল তাঁর সময়কার শান্তিনিকেতনের সঙ্গীতশিক্ষা? জানিয়েছেন রাজেশ্বরী, "At Santiniketan (I) did full four year course (1938-1942) in Theory and Practice (Vocal) of Indian Classical Music and Tagore Music. No degrees were awarded then, full recognition as a musician by Tagore himself and teach of music being sufficient. (I) was given special recognition by Tagore. In addition pursued higher studies in Sanskrit and Bengali under distinguished teachers while at Santiniketan".
শান্তিনিকেতনে রাজেশ্বরীর সঙ্গীত শিক্ষা যাঁদের কাছে তাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রে আছেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং, আছেন অমিতা সেন, ইন্দুলেখা ঘোষ, শান্তিদেব ঘোষ, শৈলজারঞ্জন মজুমদার প্রমুখ। সুধীরচন্দ্র করের স্মৃতিকথায় আছে, “একদিনকার কথা মনে পড়ে। উদয়নের একতলার সামনের চাতালে দক্ষিণ- পশ্চিম কোণে বসে গান শেখাচ্ছেন সংগীতভবনের ছাত্রী রাজেশ্বরী দেবীকে। গেয়েই চলেছেন। কন্ঠে আকুলতা কূল মানছে না। পুরানো গান- ‘আমার পরাণ লয়ে কী খেলা খেলাবে।’
“রাজেশ্বরী প্রসঙ্গে উচ্ছ্বসিত অরুন্ধতী দেবী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “...রাজেশ্বরীদি যখন গান শিখতেন তাঁর কাছে বসেও অনেক গান শেখা হয়ে যেত। এই রাজেশ্বরীদি এক আশ্চর্য চরিত্র। পঞ্চনদের মেয়ে অমন রূপ, প্রতিভা, বৈদগ্ধ্য, কন্ঠ কিন্তু সে সম্বন্ধে কী এতটুকুও উগ্রতা বা সচেতনতা আছে, না কোনওদিন ছিল?
প্রকৃতিতে উনি কী কোমল, কী মধুর। সবচেয়ে বড় কথা- যে কথা শৈলজাদা বলেছেন..... অ-বাঙালী হয়েও রবীন্দ্রসঙ্গীত তথা বাঙালী সংস্কৃতিকে এমন করে আপনার করে নিয়েছেন যেন এইটেই ওঁর ধর্ম। উনি তো ইচ্ছে করলে খেয়াল, ভজন প্লেব্যাকে গজল বা যা ইচ্ছে গেয়ে ফ্যানটাসটিক নাম করতে পারতেন, কিন্তু উনি রবীন্দ্রসঙ্গীতকেই আপনার গান হিসেবে বেছে নিয়েছেন এবং সেখানেও একটি অনন্য স্থান করে নিয়েছেন। রাজুদি ইজ এ গ্রেট গ্রেট আর্টিস্ট।”
রাজেশ্বরী যখন রবীন্দ্রসঙ্গীতের জগতে নিজের স্থান করে নিচ্ছেন তখনই শুরু হল তাঁর জীবনের নতুন এক পর্ব। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের আত্মীয় সুমন্ত্র মহলানবিশের বাড়িতে রাজেশ্বরী দত্ত গেয়েছিলেন, ‘ফুল বলে ধন্য আমি’। সে গান শুনে আকুল হয়ে উঠলেন কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। সেটা ১৯৩৯ সাল। সুধীন্দ্রনাথ তখন বিবাহিত। কিন্তু স্ত্রী ছবি দত্তের সঙ্গে সম্পর্ক তখন টালমাটাল। রাজেশ্বরীর ব্যক্তিত্ব ও গান ছুঁয়ে গেল সুধীন্দ্রনাথকে। যুক্তিবাদী কবি ভেসে গেলেন আবেগের স্রোতে। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ চলল চিঠিপত্র আদান-প্রদান। ১৯৪১-এ হিন্দুস্থান রেকর্ড থেকে বেরোল রাজেশ্বরীর প্রথম রেকর্ড। সুধীন্দ্রনাথ তখন চল্লিশের মধ্যবয়সী, বিবাহিত আর রাজেশ্বরী একুশের তরুণী। পারিবারিক সম্মতি থাকা সম্ভব ছিল না। কিন্তু প্রেম আর কবে কোন নিষেধের বেড়াজাল মেনেছে! ১৯৪৩-র ২৯ মে লাহোরে বিয়ে হল রাজেশ্বরী- সুধীন্দ্রনাথের। রাজেশ্বরী বাসুদেব হলেন রাজেশ্বরী দত্ত, যে নামে সূচনা হল রবীন্দ্রসঙ্গীতের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের।
কী ছিল রাজেশ্বরীর গানে? সুরের সূক্ষ্মতা, শব্দ উচ্চারণের শুদ্ধতা ও গভীরতা, লয়ের যথার্থতা-সব কিছুর পরেও এক আশ্চর্য উদাসীনতা যা ব্যাখ্যার অতীত। টপ্পাঙ্গের গানে তাঁর অনায়াস চলন। আবার ‘আজি যে রজনী যায়’ বা ‘চিরসখা হে’র আর্তি আকুল করে প্রাণ। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত রাজেশ্বরী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী এবং যামিনীনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬০ শিখলেন গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষার পাশাপাশি শিখলেন ফরাসি ও ইতালীয় ভাষা। ১৯৫৭- ১৯৫৮ সালে সুধীন্দ্রনাথ যখন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘World of Twilight’ লিখছেন, তখন রাজেশ্বরী শিখলেন জার্মান। আর এই সব ভাষাশিক্ষার অনবদ্য ফসল ফলল অচিরেই। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে যুগ্মভাবে অনুবাদ করা একগুচ্ছ বিদেশি কবিতা প্রকাশিত হল ‘কবিতা’ পত্রিকার শততম সংখ্যায় ১৯৬০-র জানুয়ারিতে।
রাজেশ্বরীর গানে তাঁর কণ্ঠসম্পদ আর তালিমের প্রভাব তো থাকতই, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকত তাঁর বৈদগ্ধ্য। ‘দিন যায় রে বিষাদে’ তাঁর কন্ঠে যেন প্রাণ পেয়ে উঠত। ‘এ মোহ আবরণ’ তো তাঁরই গাইবার অধিকার। শব্দে ও সুরে রবীন্দ্রনাথের গান যে উত্তুঙ্গতা স্পর্শ করেছিল, সে গান গাইতে গেলেও তো সেই গভীরতাকে অনুভব করতে হয়। শব্দকে অনেক গভীরে অনুভব করলে তবেই তো তার ধ্বনি জেগে ওঠে। তাঁর ‘তুমি কিছু দিয়ে যাও’ যাঁরা শুনেছেন তাঁরা অনুভব করেছেন কিভাবে তিনি নিছক শব্দকে ব্রহ্মে পরিণত করতে পারেন।অনুভবের সেই গভীরতায়, ভাবপ্রকাশের ব্যঞ্জনায় রাজেশ্বরী ছিলেন অতুলনীয়া।
বিবাহ পরবর্তী জীবনে বড় আনন্দিত ছিলেন এই দম্পতি। যদিও প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ না করে রাজেশ্বরীকে বিবাহ করায় সুশোভন সরকার ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু সুধীন্দ্রনাথের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে প্রমুখের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল নিবিড়। বুদ্ধদেব কন্যা মীনাক্ষী জানিয়েছেন, সুধীন্দ্র-রাজেশ্বরী আর আইয়ুব- গৌরী আইয়ুব ছিলেন আশ্চর্য অচ্ছেদ্য জুটি- "গৌরী মাখন-নরম, রাজেশ্বরী গর্জাস, গ্ল্যামারাস"।
সুখ তো অল্পস্থায়ী। সুধীন্দ্রনাথের আকস্মিক মৃত্যু হল ১৯৬০’র ২৫ জুন। রাজেশ্বরী তখন মাত্র বিয়াল্লিশ। জীবনের ধারাটি আবার বদলে গেল তাঁর। ভারতের পশ্চিম প্রান্তের যে কন্যাটি সুরের টানে এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে, নীড় বেঁধেছিলেন কলকাতায়, যাঁর সুরে মুগ্ধ বিষ্ণু দে লিখেছিলেন ‘পরকে আপন করে’, সেই রাজেশ্বরী তখন সংকটে জর্জরিত। সমস্যা শুধু আত্মিক নয় আর্থিকও। থেমে গেল গানের চর্চা।
১৯৬১তে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উপলক্ষে National Tagore Centenary Committee-র আহ্বানে লন্ডনে আমন্ত্রিত হলেন তিনি। গাইলেন গান। লন্ডন, সরবোন, তারপর রোম আর বন শহরে। এই বছরেই যোগ দিলেন Congress for Cultural Freedom Paris-এ। ‘ভারতীয় সঙ্গীত’ বিষয়ে বক্তৃতা দিলেন সরবোনের প্রাচ্য সঙ্গীতবিদ্যাচর্চা কেন্দ্রে। ক্রিস্টিন বসনেকের সঙ্গে অনুবাদ করতে শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’। যা ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হল গালিমার থেকে। ১৯৬২ সালেই যোগ দিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগে। প্রথম বছরে তাঁর পড়ানোর বিষয় ছিল 'Ragas and Raginis of the Music of India'. পেলেন লাইব্রেরি সায়েন্স পড়ার জন্য স্কলারশিপ। এত কিছুর পরেও হাহাকার ছিল তাঁর কলকাতার জন্য।
অমিয় দেবকে লেখা এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, " Thank you so much for your Bijoya greetings; it helps so much to know that one is remembered still. I think of you so much and have at times a mad desire to be back in Calcutta in our flat, both of us Sudhin and me-to receive friends like you, Buddhadeva, Jyoti and others and spend many more of those very happy evenings we had together on that lovely verandah of ours. But alas, the chapter is finished....".
১৯৬২ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে রাজেশ্বরীর গুরু রমেশ বন্দ্যোপাধ্যায় যুক্ত হলেন।স্থান হল না রাজেশ্বরীর। মনে রাখতে হবে ১৯৬১ সালের মার্চ মাস থেকে অগাস্ট পর্যন্ত রাজেশ্বরীর গাওয়া ১৩৪০ টি রেকর্ড বিক্রির হিসেব দিয়েছিল হিন্দুস্থান রেকর্ড। অবশ্য অবাক হবার কিছু নেই তাঁর গাওয়া দুটি ফিল্মের গান শেষ পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়নি। দুটিই রবীন্দ্রসঙ্গীত।
১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ রাজেশ্বরী শিক্ষকতা করলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৯-এ লন্ডনে The School of Oriental and African Studies- এ যোগ দিলেন ভারতীয় সঙ্গীতের অধ্যাপিকা হিসেবে। ১৯৭৫-এ স্টাডি লিভ নিয়ে এলেন ভারতে। ১৯৭৬ সালে ক্ষেত্রসমীক্ষার জন্য বারাণসীতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে ফিরে এলেন কলকাতায়। ৬ এপ্রিল ভর্তি করা হল নার্সিংহোমে। ১০ এপ্রিল ভোরে চলে গেলেন রাজেশ্বরী।
কলকাতা খবরও পেল না সব মোহ আবরণ' সরিয়ে চির অন্তরালে চলে গেল এক মহাপ্রাণ।
“এই মৃত্যু ঘোর মৃত্যু, পত্রপুষ্পে বিরাট বকুল/ আজকে উন্মূল হল”