রবীন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন এক কন্যা, "সমস্ত পৃথিবীর আকুল প্রার্থনার ধন সেই শান্তিকে আপনি সত্যদৃষ্টির দ্বারা দেখতে পেয়েছেন, বাস্তব জীবনে তাকে রূপ দিতে চেষ্টা করেছেন, কিছু পরিমাণে সফল হয়েছেন বইকি। তা নইলে বাইরের জগৎ থেকে কিসের আশায় মানুষ এখানে ছুটে ছুটে আসে"? এর পরের তিনটি ছত্রে আছে, "আশ্রমের প্রাক্তন ছাত্রী হিসাবে আশ্রম সম্বন্ধে আমার ধারণা নিয়ে আপনার সঙ্গে আলোচনা করার অধিকার আমার আছে"। এই দৃপ্ততাই চিনিয়ে দেয় ব্যতিক্রমী এক প্রতিভাময়ীকে- তিনি অমিতা সেন, খুকু।
১৯১৪ সালের ১৯ শে মে বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকায় তাঁর জন্ম। মা সুহাসিনী দেবী ছিলেন সুশিক্ষিতা ও সুগায়িকা।বাবা ক্ষিতীশচন্দ্র সেন ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচারক। আর্থিক স্বাচ্ছল্য তেমন ছিল না সেন পরিবারে। অমিতার পিসি হেমবালা সেন ছিলেন শান্তিনিকেতনে মেয়েদের হোস্টেলের অধ্যক্ষা। তিনিই দুই নাবালিকা ভাইঝি- অমিতা(খুকু) ও ললিতা(তাতু )-কে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন। খুকুর বয়স তখন ন বছর, তাতুর আরও কম। ছোট থেকেই অমিতা ব্যতিক্রমী। মাত্র ছ বছর বয়সে, মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে সেই বালিকা লিখেছিল কবিতা। নিজে সুর দিয়ে পাটনায় এক সমাবেশে সে গানও গেয়েছিল।
ধীর, স্থির, দেশহিতব্রতী, স্বাধীনচেতা ওহে গান্ধী বীর।
বালিকার মুখে সম্পূর্ণ গানটি শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথও। শুরু হয়েছিল খুকুর জীবনের এক অধ্যায়।শান্তিনিকেতন।
ছাত্রীজীবনে কেমন ছিলেন খুকু?
অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মা অমিতা সেন ছিলেন খুকুর সহপাঠী। তাঁর স্মৃতিকথায় ধরা আছে বালিকা বয়সে খুকু যেদিন শান্তিনিকেতনে প্রথম এল সেদিনের কথা। "আনন্দ উচ্ছ্বল পায়ে খুকু দৌড়ে এসে আমার হাতখানি ধরে বলে উঠল, 'তোমারও নাম নাকি ভাই অমিতা সেন? আমারও নাম অমিতা সেন। আজ থেকে আমরা দুজনে বন্ধু হয়ে গেলাম'। ব্যাস, সেদিন থেকে আমরা বন্ধুত্বের দৃঢ় বন্ধনে বাঁধা পড়ে গেলাম"।
আর এক সহপাঠী উমা দত্ত জানিয়েছেন, "ওর ম্যাচিওরিটিটা ছিল আমাদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। ও কি অনায়াসে সকলের সঙ্গে মিশতে পারত, আর খুকু নামটা তো সার্থক। খুকুর মতোই সহজ ও সরল ছিল। বড়, ছোট বা ছেলেমেয়ে এরকম ভাগাভাগির কোন সঙ্কোচ ওর মধ্যে ছিল না"।
অমিতার স্মৃতিচারণ করেছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু রমা চক্রবর্তীও। 'কালো' মেয়ে অমিতার মুখচ্ছবি তেমন সুশ্রী ছিল না কিন্তু 'বুদ্ধির দীপ্তিতে সে ছিল শ্রীময়ী'। অত্যন্ত মেধাবী এই কন্যা শান্তিনিকেতন থেকে ব্যক্তিগত পরীক্ষার্থী হিসেবে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। বাংলায় তিনি সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন। পরীক্ষা পাশের খবর শুনে ইংল্যান্ড থেকে রবীন্দ্রনাথ অমিতাকে লিখলেন, "তুই ভালো করে পাশ করেছিস শুনে খুব খুশি হলুম। এইবার বোধহয় একটু গানবাজনায় মন দিতে পারবি"।
১৯৩২ সালে অমিতা আই. এ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে সংস্কৃতে ৮০% নম্বর ও বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বরের অধিকারী হয়ে পেলেন নগেন্দ্র স্বর্ণপদক। এই বছরের শেষের দিকে বি.এ পড়তে অমিতা এলেন কলকাতায়। সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃতে ছাত্রীদের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বরের জন্য রৌপ্য পদক, 'বেস্ট লেডি গ্র্যাজুয়েট' হয়ে স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন অমিতা। বিদেশ থেকে ফিরে এসে অমিতার কলকাতায় যাওয়া প্রসঙ্গে চিঠিতে লিখলেন রবীন্দ্রনাথ, "তোর উপর রাগ করে থাকব কি করে? আশ্রমের বাইরে গেলেও আশ্রমে তোর মন আছে সে আমি নিশ্চয় জানি।"
মনের একটা অংশ অমিতার আশ্রমে ছিল ঠিকই কিন্তু অন্য অংশে ছিল জ্ঞানার্জনের জন্য তীব্র টান। বি এ পাশ করার পর বীণাপাণি পর্দা হাই স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি সংস্কৃতে স্নাতকোত্তরের পাঠ নিতেন অমিতা। স্নাতকোত্তরও তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
নিতান্ত অল্পবয়স থেকে মায়ের কাছে খুকুর গান শেখার শুরু। ব্রাহ্মসমাজের অনুষ্ঠানে তিনি ছোট থেকেই গান গাইতেন। অধ্যাপিকা যশোধরা বাগচীর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, "আমরা যখন বড় হয়ে উঠছি, তখন শুনতাম, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে সেই সময় দুই 'অমিতা সেনের' রমরমা- একজন নাচে ও একজন গানে"। এই গানের ' অমিতা সেন' হলেন খুকু। লিখেছিলেন যশোধরা, "কলকাতা শহরে সংগীত-পাগল স্কুলপড়ুয়া আমি কিন্তু অন্য অমিতা সেনের সঙ্গে অনেক সহজে পরিচিত হয়েছিলাম, তাঁর ৭৮ আর পি এম রেকর্ডের মারফত। 'ওগো বধূ সুন্দরী/ তুমি মধুমঞ্জরী/ পুলকিত চম্পার লহ অভিনন্দন'-যে যেখানেই গাক না কেন আমার কানে গানটি একান্ত অমিতা সেনেরই"।
শান্তিনিকেতনে এসেই রবীন্দ্রনাথ ও দিনেন্দ্রনাথের অত্যন্ত কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন বালিকা অমিতা। তাঁর অনন্যসাধারণ কন্ঠ, সুরের ওপর দখল ও অনুভূতিপূর্ণ গায়কী তাঁকে বিশিষ্ট করে তুলেছিল। বন্ধু রমা চক্রবর্তী জানিয়েছেন, "মেয়েদের মধ্যে এতটা সহজ, খোলা অথচ সুমিষ্ট দরদী কন্ঠস্বর বিরলই বলা চলে। "দিনেন্দ্রনাথ তাঁকে এতটাই স্নেহ করতেন যে একদিনও যদি অমিতা ক্লাসে না যেতেন তিনি ব্যাকুল প্রশ্ন করতেন খুকুর বন্ধুদের-"খুকু কেন এল না বলতে পারিস?"গভীর স্নেহস্পর্শ ছিল রবীন্দ্রনাথেরও। অমিতার প্রতিভার প্রতি আস্থা ছিল তাঁর।
অমিতাকে নিয়েই লিখেছিলেন 'আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে'-র মতো গান। অমর্ত্য সেনের মা অমিতা সেনের স্মৃতিতে ধরা আছে এই গানটির ইতিবৃত্ত। "এই সময় তিনি (রবীন্দ্রনাথ) একদিন 'আমি তোমার সঙ্গে গানটি শুনতে চান। খুকু তাঁকে গেয়ে শোনালে তিনি হেসে তাকে বললেন, 'কী রে, গানটি শুনে তোর কি কিছু মনে পরছে'?'' প্রাণখোলা হাসি, যা ছিল খুকুর নিজস্ব, সেই হাসিই হেসেছিলেন তরুণী। কবি নিজেই তখন বলেছিলেন, "ওকে উদ্দেশ্য করেই গানটি আমি বেঁধেছিলাম"।
সেখানে যারা উপস্থিত ছিলেন তারা অমিতাকে বলেছিলেন,'পরম সৌভাগ্যের এমন দামী কথাটা তুমি মনের মধ্যেই চেপে রাখলে'? সেই তরুণীর উত্তরটি ছিল চমকে দেবার মতো। 'ও কথা গুরুদেব মুখে বললেও আমি কি বুঝি না এ গানের কি গভীর অর্থ? এই গভীর অনুভূতি কি কোনও একটা ছোট আঁধার ধারণ করতে পারে?' এতটাই সংবেদনশীল ছিলেন অমিতা। এই সূক্ষ্ম অনুভূতির গভীর স্পর্শে তাঁর গান হয়ে উঠত মর্মস্পর্শী।
রবীন্দ্রনাথের 'সোনার তরী' কবিতাটিকে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ উঠেছিল সেকালের কলকাতার সাহিত্যিক সমাজে। রবীন্দ্রনাথের কাছে বিষয়টি নিয়ে জানতে গিয়েছিলেন কয়েকজন গুণীব্যক্তি। কবি তখন নবম শ্রেণীতে পাঠরতা অমিতা সেন সহ ছাত্র-ছাত্রীদের ডেকে পাঠিয়ে সকলের সামনে 'সোনার তরী' কবিতার অর্থ তারা বুঝেছে কি না জানতে চাইলেন। সমস্বরে তারা জানালো যে বুঝেছে। রবীন্দ্রনাথ বললেন, "বল তো কি বুঝেছিস? " তখন খুকু, যিনি পড়াশোনায় ছিলেন সবার আগে তিনি অনায়াসে সেই কবিতার অর্থ এবং ভাবার্থ বলে কবি ও তাঁর কবিতার সম্মান রক্ষা করেছিলেন।
যে কোনও গানের সুর অমিতা অত্যন্ত সহজে গলায় তুলে নিতে পারতেন। স্বাভাবিকভাবেই দিনেন্দ্রনাথের পর খুকুর ওপর ছিল কবির বিশেষ আস্থা। রমা চক্রবর্তীর স্মৃতি থেকে এমন একদিনের কথা জানা যাক। 'একদিন ভোরের আলো ফুটে উঠেছে, আমরা উঠব উঠব করছি, এমন সময় গুরুদেবের সেবক বনমালী এসে ডাক দিল,' খুকু দিদিমণি শিগগির চলো। বাবামশাই সেই কোন রাত থেকে গান নিয়ে বসে আছেন। তোমায় শিগগির করে যেতে বলেছেন'। খুকুর সঙ্গে রমাও তৈরী হয়ে ' উদীচী'-তে পৌঁছে দেখলেন "নীচের ঘরে তাঁর বেতের চেয়ারটিতে তিনি বসেছিলেন, পাশেই একটি মোড়া রাখা। বোঝাই গেল, খুকুর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন"।
কি শান্তিনিকেতন, কি পূর্ব বাংলার গ্রাম কেউ গাইতে বললেই গলা ছেড়ে গেয়ে উঠতেন অমিতা। যশোধরা বাগচী জানিয়েছেন, "খুকু- অমিতা শান্তিনিকেতনের মাঠে- ঘাটে যে গানটি গেয়ে বেড়াতে সবচেয়ে ভালোবাসতেন, সেটি হচ্ছে- 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি'।.... খুকুর অকালমৃত্যুর ৩১ বছর পর সেই গানটি হয়ে উঠল এক নতুন জাতির প্রতীক।"
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানকে স্বীকৃতি দিয়ে লিখেছিলেন, " আমার রচিত যত গান অমিতা তাঁহার ( দিনেন্দ্রনাথের) এবং আমার নিকট হইতে সংগ্রহ করিতে পারিয়াছে এমন দ্বিতীয় আর কেহ পারে নাই এ কথা নিশ্চিত বলা যায়। তাহার সাহায্যে আমার গানগুলি বহু পরিমাণে রক্ষা পাইবে ও বিস্তার লাভ করিবে এই আমার আশা ও আনন্দের বিষয় রহিল। বিস্মৃতি ও অনবধানবশত তাঁহার দ্বারা আমার গানগুলির বিশুদ্ধতা ক্রমশ নষ্ট হইবার আশঙ্কা নাই তাহারও যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে"। প্রকৃতপক্ষে অমিতা সেন(খুকুর) ব্যতিক্রমী সত্তা গড়ে উঠেছিল 'সঙ্গীত শিল্পী অমিতা সেন' আর 'বিদুষী অমিতা সেন'- এর মিলনে।
অমিতা সেন (খুকু) নিছক সুগায়িকা ছিলেন না। তাঁর গায়কীতে ছিল ওজস্বিতা। যে জন্য ১৯২৬ সালে শান্তিনিকেতনে 'বাল্মীকিপ্রতিভা' নাটকে খুকু গেয়েছিলেন বাল্মীকির গান। যে গানে মুগ্ধ বিধুশেখর শাস্ত্রী তার পর থেকে খুকুকে 'বাল্মীকি কোকিলম্' বলে ডাকতেন। প্রতিবাদী সত্তার পাশাপাশি শিশুসুলভ এক সত্তাও ছিল তাঁর। তাঁর ছোট বোন ললিতা দাস(তাতু)-র স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, অমিতা শিশুদের সঙ্গে শিশুর মতো মিশতে পারতেন। আবার উচিত কথা বলতেও পিছপা হতেন না। শান্তিনিকেতনের বাইরের কলেজের ছেলেদের বাচালতা দেখলেই প্রতিবাদে সোচ্চার হত সেই 'কালো' মেয়েটি। কবি নিশিকান্ত রায়চৌধুরী তাঁকে নিয়ে প্যারডি লিখেছিলেন,' কালনাগিনী আমি তারে বলি/ কালো তারে বলে পাড়ার লোক/ শুনেছিলাম বইগুদামের ঘরে/ কালো মেয়ের কালো মুখের ফোঁস'।
অমিতা সেন (খুকু) কলকাতায় বি.এ পড়তে আসার অল্প পরে ১৯৩৪ সালের শুরুতে দিনেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে কলকাতায় চলে আসেন। ১৯৩৫ এ দিনেন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে অমিতাকে লিখেছিলেন, "তোর চিঠি পড়ে মনে পড়ে গেল দিনু তাঁর সকল ছাত্রের মধ্যে তোকেই সকলের চেয়ে স্নেহ করত- সেই স্নেহের দান তুই অজস্র পেয়েছিলি- তোর জীবনে তার সঞ্চয় ফুরোবে না। যা পেয়েছিস তা রক্ষা করার ভার এখন তোদেরই পড়ে রইল। কখনো কোন অবকাশ উপলক্ষ্যে আশ্রমে একবার এলে খুশী হব"।
এই বছরের মে মাসে প্রথম রেকর্ড বেরোলো অমিতার-'আধেক ঘুমে নয়ন চুমে' ও ' ওগো দখিন হাওয়া'। ১৯৩৫ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতার নিউ এম্পায়ার প্রেক্ষাগৃহে 'রাজা' ও 'অরূপরতন' মিলিয়ে যে নাট্যরূপ দেওয়া হয়েছিল সেখানে অমিতাকে গান গাইবার জন্য রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে লিখেছিলেন, "তোকে কিছু সাজতে হবে না, কিন্তু গাইতে হবে। আশ্রমে আজকাল সুকন্ঠের একান্ত অভাব"।
সাজগোজে নিতান্ত নারাজ ছিলেন খুকু। আপত্তি ছিল অভিনয়েও। ডিসেম্বরের ২ তারিখে কবি আবার লিখেছেন, "তোকে গানের তালিকা পাঠাই- এর মধ্যে যে কয়টি তুই পছন্দ করিস বেছে নিস"। অমিতার প্রতিভাকে এতটাই মর্যাদা দিতেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখে খুকুকে আহ্বান জানিয়ে লিখেছিলেন, " তুই যদি আশ্রমে এসে আমাদের কাজে যোগ দিতে পারিস তো খুশী হব। ....তোর শক্তি আছে, অনুরাগ আছে এবং কন্ঠ আছে। সেই জন্য আমার এই কাজে তোকে পেতে অনেক দিন থেকে ইচ্ছা করছি"।
লিখেছেন, "আমি প্রত্যাশা করে থাকব"। লিখেছেন, "কিশোরীর চিঠি থেকে জেনেছিস এই কর্মের জন্য মাসিক পঁচাত্তর টাকা তোর বৃত্তি আমরা স্থির করেছি"। খুকু এলেন না। ক্ষমা চেয়ে জানালেন ব্যক্তিগত কারণে তিনি সঙ্গীতভবনের কাজে যুক্ত হতে পারছেন না। রবীন্দ্রনাথ ব্যথিত হয়েছিলেন। আশাভঙ্গও হয়েছিল তাঁর। কিন্তু তা প্রকাশ করেননি। এর কয়েকমাস পরে অমিতা সেন সঙ্গীত ভবনে যোগ দিয়ে এক বৎসর মতো কাজ করেন। ১৯৩৯র জুন মাসে তিনি শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে এলেন কলকাতায়। যে কলকাতার প্রসঙ্গে তিনি এক কালে লিখেছিলেন, 'কলকাতার atmosphere যেন আগুনের হল্কা'। মেধাবিনী তখন অন্য জীবনের স্বপ্ন দেখছিলেন। রমা চক্রবর্তীর লেখাতেও আছে, "সে সময়কার একটা চিঠি পড়ে মনে হয়েছিল, তার মনে একটা অশান্তি, একটা আলোড়ন চলছে"।
স্নাতকোত্তর পড়ার সময়েই শম্ভুনাথ গাঙ্গুলি নামে এক মেধাবী অথচ দরিদ্র তরুণের সঙ্গে খুকুর আলাপ হয়। আলাপ গভীর হতে থাকে আর শান্তিনিকেতনের আলো খুকুর জীবন থেকে সরতে থাকে। উমা দত্ত লিখেছিলেন, "এই ছেলেটির জন্যই খুকু কেমন বদলে গেল।.... শান্তিনিকেতনে পিসিমার কাছে আসত। একবার আমাকে বলল, 'আমরা যে এত ছেলেদের সঙ্গে মিশতাম সেটা ঠিক ছিল না"।
এ কি সেই খুকু? কোথায় গেল তার "কালো মুখের ফোঁস"? রমা চক্রবর্তীকে লেখা চিঠিতে ধরা পড়ল তাঁর চাওয়া, 'সেবায়, স্নেহে, ত্যাগে আত্মবিসর্জন করতে' শিখে 'ভালো স্ত্রী, ভালো মা, ভালো গৃহিণী বা ভালো পুত্রবধূ' হয়ে ওঠাকেই তিনি তখন জীবনের পরম প্রাপ্তি বলে মনে করছেন।
শম্ভুনাথের জন্য চাকরি চাইলেন খুকু রবীন্দ্রনাথের কাছে। সেই মুহুর্তে আশ্রমে কোনো শূন্য পদ ও ছিল না। তবু রবীন্দ্রনাথ জানালেন তিনি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। কিন্তু খুকুর তখন তলিয়ে দেখার ক্ষমতা কোথায়? আবেগের তীব্র স্রোতে তিনি তখন অসহায় তৃণ মাত্র। ক্ষুব্ধ খুকু আশ্রম ত্যাগ করলেন। পাঠালেন তীব্র তীক্ষ্ণ এক চিঠি। সেখানে থাকল দিনেন্দ্রনাথ প্রসঙ্গও। আহত ও বিরক্ত রবীন্দ্রনাথ জানালেন, "ভাইসরয়কে নিযুক্ত করার সময়ও ক্যাবিনেটে আলোচনা হয়ে থাকে"।
খুকুর অন্য আপত্তি ছিল 'রিহার্সলের অশুচিকর ও দুঃখকর আবেষ্টন' বিষয়ে। কবির বিরক্তি ধরা থাকল কিশোরীমোহন সাঁতরা ও খুকুকে লেখা চিঠিতে। ঘনিষ্ঠ 'তুই' হল 'তুমি'। আর কিশোরীমোহনকে লেখা চিঠিতে কবি খুকুর ব্যবহারে 'ছলনা'-র উল্লেখ করে বললেন, "যাক্ নিষ্কৃতি পেয়েছি"। ১৯৩৯ সালে এই সব চিঠি চালাচালির মাঝে আটকে রাখা হল অমিতা সেনের গাওয়া ছটি গানের রেকর্ড। যে খুকু রবীন্দ্রনাথের কাছে দিনেন্দ্রনাথের উত্তরসূরী, যাঁকে তিনি তাঁর নিজের গান রক্ষা ও বিস্তারের দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন সেই খুকুর রেকর্ড আটকে থাকল!
অন্য দিকে আশ্রম ছেড়ে এসেও ঘর বাঁধা হল না অমিতার। যে শম্ভুনাথের ক্ষয়রোগের চিকিৎসার জন্য তিনি তাঁর সমস্ত পদকগুলি বিক্রি করে দিয়েছিলেন সেই যুবক অমিতাকে প্রত্যাখ্যান করল। সর্বদিক দিয়ে পরিত্যক্ত অমিতাকে গ্রাস করল অসুস্থতা। প্রথমে যক্ষা ভেবে চিকিৎসা হলেও পরে ধরা পড়ল নেফ্রাইটিস- যা তখন ছিল অচিকিৎস্য। শুনলেন রবীন্দ্রনাথও। সব ভুলে চিঠি লিখলেন খুকুকে। প্রার্থনা করলেন তার আরোগ্য। শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে পাঠালেন খুকুর প্রিয় চকোলেট আর বিস্কুটসহ। আরও কিছু পরে যখন খুকুর বেলা শেষ হয়ে এসেছে প্রফুল্লচন্দ্র মহলানবিশকে লিখলেন কবি, "তার সেই ছটা রেকর্ড মুক্ত করে দিস"। গানে তাহলে ভুল ছিল না কিছু। এ ছিল শাস্তি।
জীবন যখন শুকায়ে যায় তখন মৃত্যু আসে করুণাধারা হয়ে। খুকুরও তাই হল। কলকাতা থেকে পাটনা গিয়ে জানা গেল ভুল চিকিৎসা হয়েছে। রোগ তখন ছড়িয়েছে অনেকখানি। জানলেন খুকুও। জীবন যদি শেষ হয় তবে জন্মভূমিতেই হোক-এই ছিল তাঁর চাওয়া। ফিরে গেলেন ঢাকায়।
১৯৪০র ১৯ শে মে ছাব্বিশ বছরের জন্মদিনে পছন্দের ডিমের ডালনা, পোলাউ, মাছ ইত্যাদির থালা সাজিয়ে কপালে চন্দনের ফোঁটা আর ঢাকাই শাড়িতে সাজানো হল অমিতাকে। পরের দিনেই চলে গেলেন কোমায়। ২৪শে মে প্রয়াত হলেন অমিতসম্ভাবনাময়ী সেই কন্যা।
সংক্ষিপ্ত চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, "খুকুকে যথেষ্ট স্নেহ করতুম কিন্তু তাকে দুর্দৈবের হাত থেকে রক্ষা করতে পারিনি"। কিছু পরে যখন কবির শরীরও অশক্ত তখন লিখলেন 'প্রগতিসংহার' নামে এক গল্প, যার নায়িকা সুরীতিতে আছে খুকুর ছায়া- বলেন অনেকেই। আপত্তিও তোলা হয় কেন সুরীতির মধ্যে গানের ছোঁয়াটুকুও নেই! Viswabharati- News- এ শোক প্রকাশ করা হল 'the abrupt end of a youthful life so rich in possibilities' বলে। মাত্র কয়েকটি গানের ডালি রেখে অকালপ্রয়াতা অমিতা সেন- খুকুর সুরে আজকের শ্রোতাও মুগ্ধ হন।