বিখ্যাত পরিবারের বধূ, বিখ্যাত ব্যক্তির স্ত্রী আর বিখ্যাত পুত্রের মা-এই পরিচয়েই যেন সীমায়িত হয়ে গিয়েছে বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়িকা সুপ্রভা রায়ের নিজস্ব সত্তাটি। অথচ সুপ্রভা ছিলেন অত্যন্ত গুণী। সুমধুর কন্ঠের অধিকারিনী সুপ্রভার গায়নে রবীন্দ্রনাথের গান অন্য মাত্রা পেত।
১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত বাংলার ঢাকা জেলায় জন্ম সুপ্রভার। তাঁর পিতা জগচ্চন্দ্র দাশ ও মা সরলা দাশ। ঢাকার ইডেন গার্লস স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করার পর তিনি কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হলেন। থাকতেন তাঁর মাসির বাড়িতে। সুপ্রভার মেসোমশাই ছিলেন কলকাতার বিশিষ্ট ডাক্তার প্রাণকৃষ্ণ আচার্য।
শান্তা দেবীর লেখায় আছে, "সত্যজিৎ রায়ের মা ঢাকা থেকে পাশ করে এখানে তাঁর মাসির বাড়ি থেকে পড়তেন। তাঁর ডাক নাম ছিল টুলু। ভালো গান করতেন, তাঁর ছোট বোন কনক তো বিখ্যাত গায়িকা"। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে সুপ্রভার বিবাহ হল উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ পুত্র সুকুমার রায়ের সঙ্গে।
এই বিবাহের বিষয়ে সীতা দেবী লিখেছেন, "এই বৎসর অর্থাৎ ১৯১৩-র ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি বোধহয় সুকুমার রায়ের বিবাহ হয়। রবীন্দ্রনাথ তখন শিলাইদহে ছিলেন শুনিয়াছিলাম। বিবাহ প্রায় আরম্ভ হইয়া যাইতেছে এমন সময় গেটের কাছে করতালিধ্বনি শুনিয়া কিছু বিস্মিত হইয়া গেলাম।পরক্ষণেই দেখিলাম কবি আসিয়া সভাস্থলে প্রবেশ করিলেন।পরে শুনিয়াছিলাম, এই বিবাহে উপস্থিত থাকিবার জন্যই তিনি কলিকাতায় আসিয়াছিলেন। সুকুমার বাবুকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করিতেন"।
বিবাহের অল্প পরে নবদম্পতি গিয়েছিলেন শিলং-এ। সুকুমার রায়ের কাকা, বিখ্যাত লেখিকা লীলা মজুমদারের বাবা প্রমদারঞ্জন রায়ের বাড়িতে।"বডদার নাম সুকুমার, বৌঠানের নাম সুপ্রভা। তাঁদের জন্য ঘর সাজানো হতে লাগল, বাড়ির সমস্ত ব্যবস্থা উল্টেপাল্টে গেল। পড়াশুনো আমাদের মাথায় উঠল"।
তারপর যখন তাঁরা এলেন- " তখন বিকেলবেলা, পড়ন্ত রোদে, বৌঠানকে বড় সুন্দর লেগেছিল। পরনে ঢাকাই শাড়ি, গলায় লম্বা মটরমালা, শ্যামলা রঙের উপর অমন সুন্দর মুখ কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ল না"। অল্পবয়সি দেওর, ননদদের সঙ্গে সুপ্রভার সম্পর্ক ছিল মধুর। শিলং-এ তখন মাছ সহজলভ্য ছিল না। সপ্তাহে দুদিন হাট বসত। তখন মাছ আনা হত, দুদিন ধরে খাওয়া হত-" সম্ভবত অনেক দাম দিয়ে আনানো হত। বৌঠান যেমন চমৎকার গান গাইতেন, তেমনি রাঁধতেন। এ সব মাছ বৌঠান রেঁধে খাওয়াতেন। এত ভালো হত যে স্কুল থেকে ফিরে একেক দিন দেখতাম আমাদের জন্য একটুও বাকি নেই। ভীষণ রেগে যেতাম"। যদিও সে রাগ স্থায়ী হত না, কিন্তু নববিবাহিতা সুপ্রভার রান্না ও গানের খ্যাতি সেই সময় থেকেই ছড়িয়ে পড়েছিল।
স্বল্পকালীন বিবাহিত জীবনে সুপ্রভার ব্যক্তিত্বময়ী সত্তার একটি সুন্দর ছবি ধরা আছে লীলা মজুমদারের স্মৃতিকথায়। " বড়দা দিব্যি মোটাসোটা ছিলেন। তাই নিয়ে বৌঠান মাঝে মাঝে রাগমাগ করতেন, 'আচ্ছা খাওয়ার কথা আমি কিছু বলছি না, কিন্তু খেয়েদেয়ে তিনটে পর্যন্ত শুতে পাবে না'। বড়দা দেখলেন এ তো মহা গেরো। ভয়ঙ্কর ভালো রান্না করতেন বৌঠান।
তখন দিনকাল অন্যরকম ছিল। ...... হাজার লেখাপড়া শেখা, গাইয়ে, বাজিয়ে মেয়ে হক না কেন, রাঁধবার লোক থাকলেও ভালো রেঁধে বাড়িসুদ্ধ সকলকে পরিবেশন করে খাওয়ানোর মধ্যে ভারি একটা তৃপ্তির ব্যাপার ছিল। তাঁর ওপর বৌঠান ছিলেন অসাধারণ রাঁধিয়ে। বড়দার খাওয়াটা মন্দ হত না।
কিন্তু খেয়েদেয়ে আর শোবার জো রইল না। বৌঠান বাড়িসুদ্ধ সবাইকে ডেকে ঘরে আসর জমানো ধরলেন। দিন দুই চেয়ারে বসে বই পড়ে, প্রুফ দেখে, কাটাবার পর বড়দা বললেন, 'এখানে বড্ড হট্টগোল, যাই আমার অপিস ঘরে গিয়ে কাজ করি'। এই বলে বাড়ির সামনের দিকটায় নিষিদ্ধ অঞ্চলে চলে গেলেন। তারপর থেকে রোজই খেয়েদেয়ে কাগজপত্র নিয়ে অপিস-ঘরে চলে যেতেন। আর শোবার কথা মুখে আনতেন না"। এতে সুপ্রভার খুশি হবার কথা ছিল কিন্তু তিনি হলেন সন্দিগ্ধ। একদিন দারোয়ানকে দিয়ে চাবি দেওয়া অপিস-ঘর খুলে আবিষ্কার করলেন বই-এর আলমারির পাশে এক গদিআঁটা বিছানা। বুঝলেন সুপ্রভা। এরপর থেকে শুরু হল ঘরেই শোবার পালা।
ধীমতী সুপ্রভার কাজের ধরণটি ছিল নিখুঁত। হেলাফেলা করে কাজ তিনি নিজে তো করতেনই না, তাঁর সঙ্গে যারা কাজ করতেন তাদের কাছেও তিনি নিখুঁত কাজ-ই আশা করতেন।
এমনই এক অভিজ্ঞতার বর্ণনা শোনা যাক লীলা মজুমদারের বয়ানে-" তখন আমার বছর বারো বয়স, কলকাতায় এসেছি, একশো নম্বর গড়পারে ইউ. রায়-এন্ড সন্সের বাড়িতে উঠেছি। ..... মা আমাকে একদিন রান্না শেখার জন্য বড় বৌঠানের সঙ্গে ভিড়িয়ে দিলেন। আধঘন্টার মধ্যে ঘেমে নেয়ে উঠলাম, প্রত্যেকটি কাজ নিখুঁত হওয়া চাই। রান্না শেষ করে, বাসনপত্র যথাস্থানে বের করে দিয়ে খাবার জিনিসগুলি ঢাকা দিয়ে তুলে, তবে ছুটি। ভালো কাজের আদর জানত বড় বৌঠান"। সুপ্রভার বেথুন কলেজের সহপাঠিনী শান্তা দেবীর স্মৃতিচারণায় সুকুমার- সুপ্রভাত বিবাহিত জীবনের একটি আনন্দছবি ফুটে ওঠে-"... ওদের বাড়িতে মাঝে মাঝে চায়ের নিমন্ত্রণে যেতাম। চিঠি আসত এইরকম:'আসছে কাল শনিবার/ অপরাহ্ন সাড়ে চার/ আসিয়া মোদের বাড়ি/ শুভ পদধূলি ঝাড়ি/ কৃতার্থ করিলে হবে, টুলু পুষু খুশি হবে'।"
অল্পবয়সে বধূ হয়ে সুপ্রভা এসেছিলেন রায় পরিবারে। সুখের সেই দিন তাঁর জীবনে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখে যখন কালাজ্বরে ভুগে প্রয়াত হলেন সুকুমার রায় তখন তাঁর তরুণী বধূটির বয়স ছিল মাত্র উনত্রিশ। সুকুমার রায় যখন অসুস্থ তখন তাঁকে দেখতে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, "সুকুমার বাবু তখন অত্যন্ত পীড়িত, খানিক পরে কবি তাঁহাকে দেখিতে চলিয়া গেলেন"। প্রয়াণ দিনের বর্ণনা দিয়েছেন লীলা মজুমদার- "একদিন সকালের দিকে একজন শিক্ষিকা এসে আমাকে ক্লাস থেকে ডেকে নিয়ে গেলেন। ... নিচে নেমে মায়ের মুখটা দেখে বুকটা ধড়াস্ করে উঠল। দেখলাম মায়ের হাতটাও থরথর করে কাঁপছে। ট্যাক্সি থেকে নেমে দেখলাম এ গড়পার সে গড়পার নয়।
এখানে হাসি নেই, কথা নেই, কাজ নেই, আনন্দ নেই। প্রেস বন্ধ, প্রেসের ঝম্ ঝম্ শব্দ বন্ধ। কে যেন মনের কানে বলে দিল এখানে আর কোনোদিন ওসব হবে না।..... বসবার ঘরের পাশ দিয়ে বড়দার ঘরে গেলাম। বড়দা চোখ বুজে বুকের ওপর হাত দুখানি জড়ো করে, একটা নিচু খাটের ওপর শুয়ে ছিলেন। সাদা কাপড়, সাদা চাদর, সাদা ফুল। বড়দার পায়ের ওপর মুখ থুবড়ে আমার হতভাগিনী জ্যাঠাইমা পড়ে ছিলেন।
বড়দার পাশে একটা মোড়ার ওপর আমার অনন্যসাধারণ বৌঠান, চোখ বুজে, দুহাত জোড় করে বসেছিলেন আর তাঁর দু গাল দিয়ে স্রোতের মতো জল পড়ছিল। মানিককে কোথাও দেখিনি; হয়তো তাকে কোথাও সরিয়ে রাখা হয়েছিল। মানিকের তখন দু বছর বয়স, তার মায়ের ঊনত্রিশ বছর, বাবার ৩৬ বছর"। এর কিছু পরে পারিবারিক প্রেসের ব্যাবসা উঠে গেল। লিখেছেন সত্যজিৎ রায়, " সন্দেশ পত্রিকা বন্ধ হবার কিছুদিন পরেই যে ইউ.রায় অ্যান্ড সন্সের ব্যবসাও কেন উঠে গেল সেটা অত ছেলেবয়সে আমি জানতেই পারিনি। শুধু শুনলাম মা একদিন বললেন আমাদের এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে"।
সুপ্রভা তাঁর শিশুপুত্র কে নিয়ে চলে এলেন দক্ষিণ কলকাতায় তাঁর ভাই প্রশান্তচন্দ্র দাশের কাছে। কিন্তু গলগ্রহ হয়ে নয়। যে সেলাইয়ের কাজে তাঁর অসাধারণ নৈপুণ্য ছিল সেই সেলাইকে ভিত্তি করে লড়াই শুরু করলেন সেদিনের দৃপ্ত তরুণী। এর আগে অবশ্য দার্জিলিং-এ বেড়াতে গিয়ে মহারাণী গার্লস স্কুলে চাকরি নিয়েছিলেন সুপ্রভা। সেই স্কুলের বর্ণনা আছে সত্যজিৎ রায়ের লেখায়, যিনি নিজেও ভর্তি হয়েছিলেন সেই স্কুলে- "অদ্ভুত ইস্কুল, ক্লাসে ক্লাসে ভাগ নেই। আমি একটা বড় হলঘরের এক জায়গায় বসে পড়ছি। দূরে ওই কোণে দেখতে পাচ্ছি আরেকটা ক্লাসে মা অঙ্ক কষাচ্ছেন"।
অবলা বসু প্রতিষ্ঠিত 'বিদ্যাসাগর বাণী ভবন' নামের প্রতিষ্ঠানে হাতের কাজ বিভাগের দায়িত্ব নিলেন সুপ্রভা। হলেন সুপারিনটেনডেন্ট। সত্যজিৎ রায়ের স্মৃতিকথায় আছে, "গড়পার থেকে ভবানীপুর আসার দু-এক বছরের মধ্যেই মা বিধবাদের ইস্কুল বিদ্যাসাগর বাণী ভবনে চাকরি নেন। তার জন্য মা- কে বাসে করে রোজ সেই গড়পারেরই কাছাকাছি যেতে হত"। ১৯২৭/২৮ সাল নাগাদ কলকাতার পথে সম্ভ্রান্ত পরিবারের তরুণী বিধবা বাসে পাড়ি দিচ্ছেন শহরের দক্ষিণ থেকে উত্তর- কাজটি সহজ ছিল না।
শুধু সেলাই বা হাতের কাজ নয় সুপ্রভার দখল ছিল সাহিত্যেও। ছোটবেলায় মায়ের কাছেই সত্যজিৎ রায় শুনেছিলেন 'ব্লু জন গ্যাপ' আর 'ব্রেজিলিয়ান ক্যাট' নামের দুটি বিদেশি গল্প। অনেক পরে তিনি অনুবাদও করেছিলেন গল্প দুটি। 'ব্লু জন গহ্বরের বিভীষিকা' আর 'ব্রেজিলের কালো বাঘ' নামে। শিল্পী বাড়ির বধূ সুপ্রভা মাটির মূর্তি গড়ার কাজ শিখেছিলেন প্রখ্যাত মৃৎশিল্পী নিতাই পালের কাছে।
তাঁর তৈরি প্রজ্ঞাপারমিতার মূর্তি আজও তাদের পরিবারের অহঙ্কার হয়ে আছে। চামড়ার কাজও শিখেছিলেন তিনি। সত্যজিৎ রায়ের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, "এই ননী মামার কাছ থেকেই চামড়ার কাজ শিখে মা নিজেও ক্রমে এক্সপার্ট হয়ে উঠেছিলেন।একটা সময় ছিল যখন মা সারা দুপুর বসে ওই কাজই করতেন। চামড়ায় যে রং লাগে তার সঙ্গে স্পিরিট মেশাতে হয়। সেই স্পিরিটের গন্ধে সারাক্ষণ ঘর ভরে থাকত। পরিপাটি হাতে তৈরি ব্যাগ, বটুয়া, চশমার কেস ইত্যাদি মা কিছু বিক্রিও করেছিলেন"। যথার্থই বলেছিলেন লীলা মজুমদার, "যা করত, তাই ভালো করে করত"।
অপূর্ব গানের গলা ছিল সুপ্রভার। স্বনামধন্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী কনক দাশ ছিলেন তাঁর বোন। সীতা দেবীর স্মৃতিতে ছিল সুপ্রভার গানের কথা, "শ্রীমতী সুপ্রভা অতি সুগায়িকা, কবি তাঁহাকে নূতন গান শুনাইবার প্রতিশ্রুতি দিলেন"। রবীন্দ্রনাথের কাছে গান শেখার সুযোগও হয়েছিল তাঁর, "তিনি শ্রীমতী সুপ্রভাকে গান শিখাইবার আশ্বাস দিয়া, তাঁহার খাওয়া হইয়া যাইবার পর তাঁহাকে ঘরে আসিতে বলিলেন।....গান অনেকগুলি শেখা ও শোনা হইল"। সুপ্রভা রায়ের গান সম্বন্ধে লীলা মজুমদার বলেছেন, "....গানের গলাটি একবার শুনলে ভোলা যেত না, যেন রুপোর বাঁশিতে সুর কুলকুল করছে"।
জানিয়েছেন সত্যজিৎ রায়, "একবার লখনৌ গিয়ে কিছুদিন মা'র মাসতুতো ভাই অতুলপ্রসাদ সেনের বাড়ি আর কিছুদিন অতুলপ্রসাদের বোন ছুটকি মাসির বাড়ি ছিলাম। অতুলমামার বাড়িতে খুব গান বাজনা হত সেটা মনে আছে। অতুলমামা নিজে গান লিখতেন, সে গান মাকে শিখিয়ে মার একটা কালো খাতায় লিখে দিতেন"। আজকের শ্রোতার কাছে সুপ্রভা রায়ের গানের আভাস ধরা আছে শুধু কিছু সমবেত গানের রেকর্ডে। 'জাগো পুরবাসী!ভগবত প্রেম পিয়াসী' নামের ব্রহ্মসঙ্গীত এবং 'আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও'- এই রেকর্ডগুলিতে ধরা আছে তাঁর গান।
সত্যজিৎ রায়ের অনবদ্য সঙ্গীতবোধের অন্যতম উৎস যে সুপ্রভা রায় তা দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়। প্রকৃতপক্ষে সাহিত্যের জগতের সঙ্গেও তিনিই সত্যজিতের প্রাথমিক পরিচয় করিয়েছিলেন। এমনকি ছোটবেলায় তাঁর পড়াশোনাও সুপ্রভা নিজেই দেখতেন। তাঁরই উৎসাহে সত্যজিৎ শান্তিনিকেতনে কলাভবনে ছবি আঁকার পাঠ নিতে গিয়েছিলেন। 'মা-ই আমাকে একটা ছোট্ট খাতা কিনে দিয়েছিলেন যেটা নিয়ে মাঝে মাঝে চলে যেতাম কলাভবনে'- বলেছেন সত্যজিৎ রায়। প্রথমবার শান্তিনিকেতন যাবার স্মৃতিও ধরা আছে তাঁর লেখায়- 'তখন শান্তিনিকেতনের চারিদিক খোলা। আশ্রম থেকে দক্ষিণে বেরোলেই সামনে দিগন্ত অবধি ছড়ানো খোয়াই। পূর্ণিমার রাতে খোয়াইতে যেতাম আর মা গলা ছেড়ে গান গাইতেন'। বহুবিধ গুণের অধিকারী সুপ্রভার সেবা করার স্বাভাবিক ক্ষমতা ছিল। 'আমাদের বাড়িতে কারুর কোনো বড় অসুখ করলে মা লেগে যেতেন সেবার কাজে'-বলেছেন সত্যজিৎ রায়।
নৈতিকতার বোধ তীব্র ছিল সুপ্রভা রায়ের। তখন নিয়ম ছিল ম্যাট্রিক অর্থাৎ স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার্থীর ন্যূনতম বয়েস পনেরো বছর হতেই হবে। সত্যজিৎ রায় যখন পরীক্ষার উপযুক্ত হলেন তখন দেখা গেল তাঁর বয়স চোদ্দ বছর দশ মাস। অর্থাৎ মাত্র দুটি মাসের জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হবে আরও একটি বছর। নিয়মকে পাশ কাটানোর পদ্ধতি তখনও অজানা ছিল না। কিন্তু নারাজ ছিলেন সুপ্রভা- "ওকালতির কারসাজির সাহায্যে বয়স বাড়িয়ে নেওয়া যায়, কিন্তু সে ব্যাপারে মা মোটেও রাজি নন"। অবশেষে সরকারি নিয়মে বদল আসায় সমস্যার সমাধান হল।
এই সুপ্রভা রায় কিন্তু মেনে নিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে বিজয়া রায়ের বিবাহ। আজও যা সহজ নয়, সেদিন তা ছিল অসম্ভব। ভাইঝি থেকে পুত্রবধূ-নিতান্তই কঠিন। সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি 'পথের পাঁচালী'-র জন্য সুপ্রভা দ্বারস্থ হয়েছিলেন তাঁর ছোটবেলার বন্ধু বেলা সেনের। বেলা সেন ছিলেন বিধানচন্দ্র রায়ের আত্মীয়। বেলা সেনের অনুরোধে বিধানচন্দ্র রায় 'পথের পাঁচালী'-র জন্য আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। অসামান্য ছেলের স্বপ্ন সত্যি করে তুলেছিলেন অসামান্যা এক নারী। তাঁর দেওর, সুকুমার রায়ের সবচেয়ে ছোট ভাই সুবিমল রায় যে তাঁকে 'বজ্র বৌঠান' বলতেন, সে কি এমনি? প্রয়াত স্বামীর স্বপ্ন ' সন্দেশ' পত্রিকা পুনঃ প্রকাশের জন্য তিনি পুত্রকে বলেছিলেন, "সন্দেশ পত্রিকা আবার বেরোলে তিনি খুশি হতেন"। সত্যজিৎ সে কাজ অত্যন্ত সার্থকভাবে করেছিলেন।
এভাবেই অসামান্য স্বামী-পুত্রের স্বপ্ন সফল করে অতুল কর্মদক্ষতায় সারা জীবন নিজের ব্যক্তিগত দুঃখকে আড়ালে রেখে জীবন কাটিয়ে দিয়েছিলেন সুপ্রভা রায়। "সুখে দুঃখে অবিচলিত থাকতে দেখেছি তাঁকে। অনেক দুঃখ দিয়েছিলেন ভগবান তাঁকে, অনেক সুখও। অসাধারণ স্বামীর স্ত্রী, অসাধারণ ছেলের মা, আমার বড় বৌঠান নিজেও কম অসাধারণ ছিলেন না"। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে হৃদযন্ত্রের সমস্যায় প্রয়াত হলেন অসামান্যা সুপ্রভা রায়।