রবীন্দ্রনাথের গানের অনন্য শিল্পীঃ সাবিত্রী কৃষ্ণাণ

"তব কন্ঠে বাসা যদি পায় মোর গান/ আমার সে দান কিংবা তোমারই সে দান?" যাঁর অটোগ্রাফ খাতায় রবীন্দ্রনাথ এই দুটি ছত্র লিখে দিয়েছিলেন তিনি সাবিত্রী কৃষ্ণাণ( গোবিন্দ)।

আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে, চেন্নাইয়ের প্রখর গ্রীষ্মে এক কিশোরী তার সাথীদের সঙ্গে বাড়ির বাইরে খেলছিল। এমন সময় তার ছবি আঁকার শিক্ষক এসে তাকে একজনের কাছে যাবার কথা বললে কিশোরী কোনওমতেই রাজি হল না। উপায় না দেখে চিত্রশিক্ষক কিশোরীর মায়ের শরণাপন্ন হলেন। অনেক আপত্তি করলেও কোনও ফল না হওয়ায় সে বাধ্য হল শিক্ষকের সঙ্গে যেতে। শিক্ষক কিশোরীকে নিয়ে উপস্থিত হলেন যাঁর সামনে তিনি রবীন্দ্রনাথ। ১৯২৮ সালে অ্যানি বেসান্তের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন বর্তমান চেন্নাইয়ের আডেয়ারে। আডেয়ারেই ছিল অ্যানি বেসান্তের থিয়োজফিকাল সোসাইটির "গিন্ডি হাই স্কুল"- সেই স্কুলেরই ছাত্রী ছিলেন সাবিত্রী।

সাবিত্রী যখন কবির সামনে উপস্থিত হল তখন সেখানে ছিলেন দক্ষিণ ভারতের একাধিক গুণীজন। ছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশও। সাবিত্রীর সঙ্গে ছিল তাঁর দুই বোন। রবীন্দ্রনাথ প্রথমে তাদের খেয়াল করেননি। এতে সাবিত্রীর ক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। খেলা বন্ধ করে সেখানে বসে থাকতে তার ভাল লাগছিল না। বলাবাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধেও তাদের কোনও ধারণা ছিল না। অবশেষে রবীন্দ্রনাথ ডেকে গান শোনাতে বললে তারা প্রথমে গেয়েছিল মীরার ভজন। তখন কবি সাবিত্রীকে একা একটি দক্ষিণ ভারতীয় গান শোনাতে বলেন। কিশোরী তখন তাঁকে শুনিয়েছিল মীনাক্ষী দেবীর ভজন "মীনাক্ষী মে মুদম্ দেহি'। কিশোরী কন্ঠের সুমধুর সতেজতা ও সুরের সূক্ষ্ম কারুকার্য কবিকে মুগ্ধ করেছিল।

এরপর যে ক’দিন রবীন্দ্রনাথ আডেয়ারে ছিলেন প্রতিদিন তিনি সাবিত্রীর গান শুনতেন। শেষ পর্যন্ত তিনি সাবিত্রীকে শান্তিনিকেতনে এসে পড়াশোনার পাশাপাশি গান শেখার আহ্বান জানান। সাবিত্রী প্রথমে রাজি হননি। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর কোনও পরিচয় ছিল না। নিজের শহর, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের ত্যাগ করে শান্তিনিকেতনে আসার সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পারেননি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিজেই উদ্যোগী হয়ে সাবিত্রীর অভিভাবকদের সম্মতি নিয়ে তাঁকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে এসেছিলেন।

প্রথমদিকে সমস্যা ছিল অনেক। ছিল ভাষাসমস্যা। ছিল খাদ্যাভ্যাসজনিত সমস্যাও। কিন্তু ধীরে ধীরে সব সমস্যারই সমাধান হয়ে গেল। ভাষাশিক্ষার পাশাপাশি নৃত্য, সংগীত, অঙ্কন ইত্যাদি সব বিষয়ই শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন সাবিত্রী। গান শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ আর দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। দিনেন্দ্রনাথকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সাবিত্রীকে প্রথমে পূরবীরাগের গান শেখাতে। কেননা কবির মনে হয়েছিল সাবিত্রীর গলায় ওই বিশেষ রাগের গান সঠিক রূপ পাবে। সাবিত্রীর তাই শান্তিনিকেতনে শেখা প্রথম গানটি হল "অশ্রুনদীর সুদূর পারে......"। প্রথম প্রথম বিশালদেহী দিনেন্দ্রনাথ, তাঁর অতি বৃহৎ দুই চক্ষু দেখে কিশোরী সাবিত্রী ভয় পেত। কিন্তু দিনেন্দ্রনাথের স্নেহস্পর্শে সে ভয় অবিলম্বে উধাও হয়ে গিয়েছিল।

 

Savitri1

 

শান্তিনিকেতনে আসার আগে সাবিত্রী গান গাইলেও সংগীতশিক্ষা তাঁর হয়নি। শান্তিনিকেতনেই তাঁর সংগীতশিক্ষার সূত্রপাত। রবীন্দ্রনাথের কঠিন সুরের গানগুলি তাঁর কন্ঠে অন্য মাত্রা পেত। শান্তিনিকেতন, জোড়াসাঁকো ও কলকাতার অন্যান্য নানা অনুষ্ঠানে সাবিত্রী তাঁর অনন্য কন্ঠের স্পর্শ রেখেছিলেন। ১৯২৮ সালে সাবিত্রী শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। একটুও বাংলা না জানা দক্ষিণ ভারতীয় সেই কিশোরী মাত্র চার বছরে এতটাই গভীরভাবে সেই ভাষা আয়ত্ত করেছিল যে ১৯৩২ সালেই হিন্দু প্রদান রেকর্ড কোম্পানি থেকে বেরোল তাঁর প্রথম ডিস্ক।

রবীন্দ্রসংগীতের দুনিয়ায় সাবিত্রী কৃষ্ণাণের(গোবিন্দ)অবদান শুধু অসামান্যা গায়িকা হিসেবে নয়। তিনি রবীন্দ্রনাথের অনেক গানের সৃষ্টির উৎস। তাঁর গাওয়া একাধিক দক্ষিণী গানের সুরে নতুন কথা বসিয়ে রবীন্দ্রনাথ একাধিক গান সৃষ্টি করেছিলেন। সাবিত্রীর আগেও সরলা দেবীর মাধ্যমে দক্ষিণী গানের সুরের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন কবি। নতুন গান সৃষ্টি করেছিলেন কবি সেই সব সুরে শব্দ বসিয়ে। তেমনই সাবিত্রীর গাওয়া “মীনাক্ষী মে মুদম্ দেহি”-র সুরে কবি লিখেছিলেন "বাসন্তী, হে ভুবনমোহিনী"। গানটির সৃষ্টিবৃত্তান্তটিও অনবদ্য।

শান্তিনিকেতনে আসার পর সাবিত্রী দেবী থাকতেন ছাত্রী-আবাসে। একদিন সকাল থেকে দুপুর এগারোটা পর্যন্ত ক্লাস করে সবে মাত্র ছাত্রী-আবাসে ফিরেছেন, এমন সময় হেমবালা সেন- যিনি ছিলেন ছাত্রী-আবাসের দায়িত্বে, জানালেন সাবিত্রীর জন্য রবীন্দ্রনাথ অপেক্ষায় আছেন।

তাঁর পরিচালক বনমালীকে তিনি পাঠিয়েছেন সাবিত্রীকে নিয়ে যাবার জন্য। সাবিত্রী তাই যেন তৎক্ষণাৎ গুরুদেবের সঙ্গে দেখা করতে চলে যান। এদিকে খিদেয় কাতর সাবিত্রী খেয়ে উঠে যাবার কথা বললে হেমবালা সেন অনুনয় করে বললেন, তার খাবার তিনি ঢাকা দিয়ে রাখবেন। আগে সে গুরুদেবের সঙ্গে দেখা করে আসুক। নিতান্ত অনিচ্ছায় সাবিত্রী গেলেন বনমালীর সঙ্গে। গিয়ে দেখলেন উত্তরায়ণের ঘরে কবি বসে আছেন। সাবিত্রীকে দেখেই তিনি বললেন গান গাইতে। অস্নাত অভুক্ত সাবিত্রী ‌ইতস্তত করায় কবি একটু ধমকের সুরে তাঁকে সেই প্রথম দিনের মীনাক্ষী দেবীর ভজনটি শোনাতে বললেন। সাবিত্রী গান শোনাতে শুরু করলে কবি তাঁকে একটু ধীরে গতিতে গাইতে বললেন। গান শেষে কবি সাবিত্রীর কাছে একটা কাগজ চাইলেন।

কিন্তু সাবিত্রী তো এসেছেন খালি হাতে। উপায় না দেখে ময়লা কাগজের ঝুড়ি থেকে একটা বড় খাম এনে দিলেন সাবিত্রী। কবি সেই ফেলে দেওয়া খামেই লিখলেন "বাসন্তী, হে ভুবনমোহিনী/ দিকপ্রান্ত, বন-বনান্তে,/ শ্যাম প্রান্তরে, আম্রছায়ে,/ সরোবরতীরে, নদীনীরে,/ নীল আকাশে, মলয় বাতাসে/ব্যাপিল অনন্ত তবে মাধুরী"- এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি! এবার কবি বললেন সাবিত্রীকে ওই "মীনাক্ষী মে মুদম দেহি"-র শব্দগুলির পরিবর্তে কবির লেখা কথাগুলি বসিয়ে গানটি গাইতে। সাবিত্রীর তখন খিদেয় প্রাণ যায়।

তিনি বললেনও কবিকে সেকথা। অবিচলিত রবীন্দ্রনাথ জানালেন, সাবিত্রীর জন্য প্রতিমা দেবী- রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ, রসম, দই বড়া ইত্যাদি সব তৈরি করে রেখেছেন। গান গাওয়া হলেই মিলবে খাবার। অগত্যা সাবিত্রী অনেক পরিশ্রমে ওই কঠিন শব্দগুলি বসিয়ে গানটি গাইলেন। না। এখানেই শেষ নয়। এবার ডাক পড়ল দিনেন্দ্রনাথের। দিবানিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে তিনি এলেন। আবারও গাইতে হল সাবিত্রীকে। শুনে মুগ্ধতা আর কাটে না দিনেন্দ্রনাথের। জানালেন কবি,কলকাতার নিউ এম্পায়ারে বসন্ত- উৎসবে "নবীন" অভিনয়ের প্রথম গান হিসেবে সর্বসমক্ষে এই গানটি গাইবেন সাবিত্রী। ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে অর্থাৎ ১৯৩০ সালে লেখা হয় "নবীন"

১৯৩৪ সাল নাগাদ হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি থেকে কবি বেশ কিছু আবৃত্তি ও গান রেকর্ড করেছিলেন। সেইসময় একদিন কবি প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ভাই প্রফুল্লচন্দ্র মহলানবিশকে ফোন করে বললেন, তিনি যেন সঙ্গে সঙ্গে বাঁশির নিয়ে হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানিতে চলে যান। কবি সাবিত্রী কৃষ্ণাণকে নিয়ে সেখানেই যাচ্ছেন। প্রফুল্লচন্দ্র খুব ভালো বাঁশি বাজাতেন। সেইদিন রবীন্দ্রনাথের সামনেই সাবিত্রী দেবীর "তুমি কিছু দিয়ে যাও"-গানটি রেকর্ড করা হয়েছিল। গানটির সঙ্গে বাঁশির বাজিয়েছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। এই গানটিও সাবিত্রী দেবীর গাওয়া গানের সুরে তৈরি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

এছাড়া, "বাজে করুণ সুরে", "শুভ্র প্রভাতে পূর্ব গগনে", " বেদনা কী ভাষায় রে", "নীলাঞ্জনছায়া" প্রভৃতি গানগুলিতেও সাবিত্রী দেবীর গাওয়া গানের সুরকাঠামোয় কথা বসিয়েছিলেন কবি। এই গানগুলি তাঁর কন্ঠে এতটাই রসোত্তীর্ণ হত যে দিনেন্দ্রনাথ এক চিঠিতে লিখেছিলেন, "সাবিত্রী, তুমি আমাদের আশ্রম ত্যাগ করার পর আর তোমার মতো ' নীলাঞ্জন ছায়া' গাওয়ার উপযুক্ত গায়িকা পাই না"। সাবিত্রী অবশ্য ঠিক আশ্রম ত্যাগ করেননি। বিবাহের জন্য তাঁকে চলে যেতে হয়। অনেক পরে তিনি আবারও এসেছিলেন আশ্রমে। তবে তখন স্নেহময় দিনদা বা গুরুদেব কেউ আর নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নিয়ে ঠাট্টাও করতেন, আবার দুষ্টুমির জন্য বকুনিও দিতেন।

অত্যন্ত দুরন্ত ছিলেন সাবিত্রী। কচি আমের জন্য গাছের এ ডাল থেকে সে ডালে তাঁর ছিল অনায়াস যাতায়াত। তাঁর এই দুরন্তপনার জন্য কবির কাছে প্রায়ই যেত রিপোর্ট। এক দুপুরে উত্তরায়ণ থেকে সাবিত্রীকে তলব পাঠালেন কবি। সাবিত্রী পৌঁছে দেখলেন খাওয়াদাওয়া শেষ করে খাবার ঘরেই সাবিত্রীর জন্য অপেক্ষা করছেন কবি। সাবিত্রীকে দেখেই বলে উঠলেন যে এতদিন শান্তিনিকেতনে থেকে সাবিত্রী শিখলেন কী? সাবিত্রী তো নিরুত্তর।

তখন রবীন্দ্রনাথ প্লেটে রাখা একটি চপ জাতীয় খাবার দেখিয়ে সাবিত্রীকে খেতে বললেন নিরামিষাশী সাবিত্রী রাজি হলেন না। কেন না, ওই চপ কিসের তৈরি তা কে জানে! রবীন্দ্রনাথ তখন ছদ্মগাম্ভীর্যে জানালেন, রে ওটা মাছের চপ। এতদিন বাংলাদেশে থেকে সাবিত্রী যদি মাছ খেতেও না শেখে তবে শিখলেন কী? সাবিত্রীর তখন কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা। তখন কবি হেসে ফেলে বনমালীকে বললেন প্রতিমা দেবীর কাছে থেকে সন্দেশ, রসগোল্লা ইত্যাদি যা কিছু আছে সব নিয়ে আসতে। সামনে বসে খাইয়ে, গান শুনিয়ে তবে ছুটি।

সাবিত্রী দেবী যতদিন শান্তিনিকেতনে ছিলেন ততদিন আশ্রমের সব অনুষ্ঠানেই তিনি গান গেয়েছেন। কলকাতাতেও একাধিক অনুষ্ঠানে- "তপতী", "নবীন" ইত্যাদি অভিনয়ে এমনকি রবীন্দ্রনাথের ৭০ তম জন্মজয়ন্তী তেও তিনি গান গেয়েছিলেন। এই উৎসবে গান শেখানো এবং সংগীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ইন্দিরা দেবী

সাবিত্রী দেবীর গাওয়া যে সব গান এখন শোনা যায় তার অনেকগুলির সুর ও গায়নভঙ্গী আজকের তুলনায় সম্পূর্ণ পৃথক। রবীন্দ্রনাথের গানের যে গায়কী আজ হারিয়ে গিয়েছে তিনি সেই ধারার গায়িকা।

ভারতের নানা প্রান্ত থেকে অনেক গুণীজন এসেছেন, থেকেছেন আশ্রমে। তাঁদের অনেকের গানের সুরে রবীন্দ্রনাথের গানের যথার্থ রূপ প্রকাশিত হয়েছে। সাবিত্রী দেবী তাঁদের অন্যতম। রবীন্দ্র অনুচর সুধীরচন্দ্র কর যে জন্য লিখেছিলেন, "রেকর্ডে রবীন্দ্রসংগীতের সুধা যাঁরা বিলিয়েছেন তাঁদের মধ্যে দক্ষিণ ভারতের সাবিত্রী গোবিন্দ ও সিন্ধী শ্রীমতী রাজেশ্বরী বাসুদেবের কন্ঠমাধুর্যের দান কখনো ভুলবার নয়।"

সাবিত্রী দেবীর গানের একটি অপরূপ স্মৃতি ধরা আছে রাণী চন্দের লেখাতেও। "কিন্তু যেদিন সাবিত্রী গান ধরে সেদিন সময়ের হিসাব থাকে না কারো মনে। গানের পর গান গেয়ে মেতে থাকে সাবিত্রী।...কলাভবনে সেও একটা সীট নিয়ে বসত, আঁকত। কোনো কোনো দিন নন্দদা তার ছবি দেখতে এসে সেখানে বসে পড়তেন। সাবিত্রী বুঝত, সে গান ধরত"

১৯৯৮ সালে সাবিত্রী কৃষ্ণানের প্রয়াণে রবীন্দ্রনাথের গানের বেশ কিছু অপ্রচলিত সুরও হারিয়ে গেল।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...