"শান্তিদার গান যখন যেখানে বসে শুনি আমাদের মনকে অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে সেকালের সেই আনন্দে শান্তিতে পূর্ণ আশ্রমজীবনে পৌঁছে দেয়।"– আশ্রমকন্যা অমিতা সেনের এই উক্তিটি যাঁকে ঘিরে তিনি শান্তিদেব ঘোষ-রবীন্দ্রনাথের গানের এক ব্যতিক্রমী শিল্পী। রবীন্দ্রনাথ – দিনেন্দ্রনাথের বিশিষ্ট গায়কীর উত্তরাধিকার বহনকারী।
১৯১০ সালের মে মাসের ৭ তারিখে বর্তমান বাংলাদেশের চাঁদপুরের কাছে বাজাপ্তি গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা কালীমোহন ঘোষ ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রথম পর্যায়ে শিশু বিভাগের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক ছিলেন। শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার পরে তিনি গ্রামোন্নয়নের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। মা মনোরমা দেবী ছ মাসের শান্তিদেবকে কোলে নিয়ে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। আসার পরদিন কালীমোহন ঘোষ স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়েছিলেন। "মোটাসোটা গোলগাল, কালো কুচকুচে ছেলেটি, মাথায় কোঁকড়ানো চুলের রাশি। হাতে গলায় সোনার গহনা, কোমরে কোমরপাটা। শিশুটির দিকে খানিক দেখে গুরুদেব কালীমোহনবাবুকে বলে উঠলেন-" বাঃ! এই তোমার ছেলে? এ যে কৃষ্ণঠাকুর! খুব সুন্দর।
শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমে শান্তিদেব ঘোষের বিদ্যালয় শিক্ষার সূত্রপাত। তখন তাঁর নাম ছিল শান্তিময়। পরে কবিই তাঁর নাম দিয়েছিলেন শান্তিদেব। ছোট থেকেই তিনি সঙ্গীত, নৃত্য ও অভিনয়ে পারদর্শী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ও দিনেন্দ্রনাথের কাছে তাঁর গান শেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। এক স্মৃতিচারণে তিনি বলেছিলেন, "মনে পড়ে ১৯৩০ সাল নাগাদ আমি গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রথম একলা বসে গান শিখবার সুযোগ পেয়েছিলাম। ১৯৩৫ সাল থেকে গুরুদেব অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হওয়ার আগে পর্যন্ত একটানা ভাবে তাঁর কাছে গান শিখেছি। এ তো আমার জীবনের পরমপ্রাপ্তি।"
মাত্র ছ বছর বয়েস থেকে শান্তিদেব গানের দলের গান গাইতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু শুধু গান শেখাতেই শান্তিদেব ঘোষের কাজ শেষ হয়নি। শুধু নৃত্যশিক্ষাতেই তাঁর নৃত্যচর্চা সীমাবদ্ধ ছিল না। রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নৃত্যের বিষয়ে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মননশীল প্রবন্ধ ও গ্রন্থ রচনাও করেছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ লিখে তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লিখেছিলেন, "তোর এই লেখাটি পড়ে আমার মনে পড়ে গেল অনেক দিনের কথা। তখন থাকতুম দেহলি পাড়ায় আমার কর্মভূমির নেপথ্য প্রান্তে। গান সৃষ্টির নিরন্তর আনন্দে আমার দিনরাত্রি উদ্বেল হয়ে উঠত ঝাপসা হয়ে যেত আমার অন্য কর্মের ধারা। .........আমার গান তখন অবজ্ঞার, এমন কি বিদ্রুপের বিষয় ছিল। কিন্তু আমার জীবন ছিল রসে পূর্ণ। সেই কথা মনে পড়িয়ে দিল তোর এই লেখা- দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে পড়া শেষ করলুম।" ১৯৪১ সালের জানুয়ারির ২১ তারিখে লেখা এই চিঠির কয়েক মাস পরেই কবি প্রয়াত হন।
শান্তিদেব ঘোষের গায়নরীতি ছিল রবীন্দ্রনাথ ও দিনেন্দ্রনাথের অনুসারী। খোলা গলার গান তাঁর পছন্দের ছিল বলে তিনি বলতে পেরেছিলেন, অনেকে মনে করেন, "......গানে মাধুর্য বা মিষ্টত্ব ফুটিয়ে তুলতে হলে মৃদু কন্ঠে গাওয়াই উচিত। মৃদু কন্ঠে গান গায়কী রীতির দিক থেকে যে একটা বড় দুর্বলতা, এ তারা মনে করেন না। গুরুদেবের গানেও অনেক গাইয়ের মধ্যে সেই দুর্বলতা খুব প্রবলভাবে দেখা দিয়েছে। এমন কি, অনেকের ধারণা তাঁর গান মৃদু কন্ঠের বিশেষ প্রশ্রয় দেয়। এ-সব কথার মধ্যে অবিবেচনাই প্রকাশ পায় বলে মনে করি। স্বয়ং গুরুদেবের কন্ঠের গান শিশুকাল থেকে শুনে এসেছি। আর দিনেন্দ্রনাথের কন্ঠের গান শান্তিনিকেতনের পুরাতন ছাত্রছাত্রীরা কে না শুনেছে। তাঁদের দুজনের উচ্চ উদার কন্ঠস্বরের কথা মনে পড়লে অবাক হই এই ভেবে যে, এইরকম পুরুষোচিত কন্ঠস্বর কেন আজকাল শুনতে পাওয়া যায় না।...... তাঁর বহু জোরালো গান আছে, যা ভালো করে গাইতে গেলে উচ্চারণের স্পষ্টতায় ছন্দের ঝোঁকে ও গতির সাহায্যে তাকে ঠিক ভাবে প্রকাশ করতে না পারলে সে গানের প্রকৃত রস ও রূপ প্রকাশিত হয় না।" একথা তিনি বলতে পারতেন। তাঁর গানে সেই দার্ঢ্য ছিল। স্পষ্ট উচ্চারণে উন্মুক্ত উদাত্ত গায়নে তিনি রবীন্দ্রনাথের গানে এক অন্য রূপ দান করতেন। লয় বিষয়েও তাঁর ধারণা ছিল স্পষ্ট। তিনি বলতেন, লয়ের ওপর গানের প্রাণ নির্ভর করে।
শান্তিদেব ঘোষের ওপর রবীন্দ্রনাথের যথেষ্ট আস্থা ছিল। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতন থেকে চলে যাবার পর এবং রমা করের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ শান্তিদেবের হাতেই নতুন গানের স্বরলিপির দায়িত্ব তুলে দিতেন। গানের পাশাপাশি নাচেও গভীর আগ্রহ ছিল তাঁর। এই আগ্রহ দেখেই রবীন্দ্রনাথ তাঁকে জাভা ও বালি দ্বীপ, রেঙ্গুন, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দেশে নাচ শেখার জন্য পাঠিয়েছিলেন। সেই সব নাচ তিনি যেমন শিখেছিলেন তেমনই সে বিষয়ে গুরুত্ব পূর্ণ বইও লিখেছিলেন। শান্তিনিকেতনে তিনি শাস্ত্রীয় ও লোকনৃত্য যেমন শিখেছিলেন তেমনই লোকগান ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেও তালিম নিয়েছিলেন। অভিনয়েও তিনি পারদর্শী ছিলেন।১৯১৯ সালে " শারদোৎসব" নাটকে তিনি অভিনয় করেন। ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যে ‘ওরে পথিক, ওরে প্রেমিক’ গানে তিনি নেচেছিলেন। ‘অরূপরতন’, ‘ ডাকঘর’ নাটকে ‘ঠাকুরদা’, ‘ফাল্গুনী’ নাটকে বাউল, ‘ তাসের দেশ’ – এ রাজপুত্র ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের একাধিক গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন।
১৯৩০ সালে শান্তিদেব ঘোষ সঙ্গীতভবনে শিক্ষকতার দায়িত্ব পেলেন। এই সময় তিনি পাঠভবনেও ছেলেমেয়েদের নাচ শেখাতেন। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘শান্তিদা চিনা ভবনের কাছে এক টিনের ঘরে আমাদের গানের ক্লাস নিতেন।’
রবীন্দ্রনাথের গান ছিল তাঁর ‘মহা আপন’ ধন। শিক্ষক হিসেবেও তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী। মোহন সিং খাঙ্গুরা যখন শান্তিনিকেতনের ছাত্র হতে চেয়ে অধ্যক্ষ শান্তিদেব ঘোষকে চিঠি লিখেছিলেন তখন সেই চিঠির উত্তরে তিনি নিজে লিখেছিলেন পোস্টকার্ড। মোহন সিং- এর হুইলচেয়ার যাতে অনায়াসে যেতে পারে তার জন্য সঙ্গীতভবনের চৌকাঠ ভেঙে সমান করে সিঁড়ির পাশে সিমেন্ট দিয়ে ঢালু করে দিয়েছিলেন। মোহন সিং-এর স্মৃতিতে আছে ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যের মহড়ায় শান্তিদেব ঘোষ নিজে উপস্থিত থেকে গানের লয় বুঝিয়ে দেওয়ার ছবি। আর গোরা সর্বাধিকারীর স্মৃতিতে ছিল এসরাজ বাজিয়ে শান্তিদেব ঘোষের গান শেখানোর কথা।
১৯৬৪ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত এবং ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত তিনি সঙ্গীত ভবনের অধ্যক্ষ ছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি সঙ্গীতভবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। দীর্ঘ জীবনে অসংখ্য ছাত্রছাত্রীকে তিনি শিক্ষা দিয়েছিলেন। সুচিত্রা মিত্র ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় দুজনেই ছিলেন তাঁর ছাত্রী। সুচিত্রা মিত্রের উদাত্ত গায়ন গুরু শান্তিদেব ঘোষের গায়ন ভঙ্গীমা স্মরণ করায়।
শান্তিদেব ঘোষের প্রথম রেকর্ড ‘জনগণমন’ ও ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ’। এরপর রেবা মজুমদারের সঙ্গে ‘আমার প্রাণের মানুষ’ ও ‘বাকি আমি রাখব না’। পরবর্তী সময়ে তাঁর ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’, ‘খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে’, ‘বঁধূ তোমায় করব রাজা’, ‘ওই আসনতলে’, ‘ তোমার কাছে শান্তি চাব না’ ইত্যাদি গানের রেকর্ড রবীন্দ্রসঙ্গীতের জগতে স্বতন্ত্র আসন অধিকার করেছিল।
অনেক পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। তার মধ্যে আনন্দ, আলাউদ্দিন ও পদ্মভূষণ এবং বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম উল্লেখযোগ্য। সঙ্গীত নাটক আকাদেমির ফেলোশিপ, বর্ধমান ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডি লিট-ও তাঁকে দেওয়া হয়েছিল।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের জগতের এই বহুমুখী প্রতিভা বার্ধক্যজনিত কারণে ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরের ১ তারিখে প্রয়াত হন।