রবীন্দ্রনাথের গানের অনন্য শিল্পীঃ শৈলজারঞ্জন মজুমদার

"নিবিড়ভাবে শিক্ষা পেয়েছি শৈলজাদা-শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কাছে।....তাঁর ঋণ কখনও শোধ করা যাবে না। হাতে ধরে, বকেঝকে, ভালবেসে কতভাবে তিনি গান শিখিয়েছেন আমাকে। নিজে যতক্ষণ না সন্তুষ্ট হচ্ছেন আমার গান শুনে, ততক্ষণ আমার মুক্তি নেই। আমার ধৈর্যচ্যুতি হলেও শৈলজাদা ধৈর্য হারাবেন না কখনও।"

- শৈলজারঞ্জন মজুমদার প্রসঙ্গে এই উক্তি করেছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।

 

১৯০০ সালের ১৯ জুলাই বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোণা শহর থেকে কিছু দূরে বাহাম গ্রামে শৈলজারঞ্জনের জন্ম। তাঁর পিতা রমণীকিশোর দত্ত মজুমদার ছিলেন খ্যাতনামা আইনজীবী এবং অত্যন্ত মেধাবী। পিতার মেধা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন শৈলজারঞ্জন। পরবর্তী জীবনে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে এমএসসি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছিলেন।

ছোট থেকে বাড়িতে গান শুনে বড় হয়েছিলেন শৈলজারঞ্জন। "কৃষ্ণ বিনা প্রাণ বাঁচে না, পাই কোথা তারে- আমার ঠাকুরমা গান করতেন। ...... ঠাকুরমা গোপালের পুজো করতেন, বাড়িতে মহোৎসব হত। কীর্তনীয়ার দল আসত। ঘাটু নাচগানও হত। প্রজাদের বাউলের দল ছিল। তারা এসে জমিদার বাড়িতে, মানে, আমাদের বাড়ি গানে মুখরিত করে রাখত।"নেত্রকোণা অঞ্চলের লোকনৃত্য ঘাটু নাচের গান কিংবা কীর্তনের আসরের গান সবই বালক শৈলজারঞ্জন অনায়াসে গলায় তুলে নিতে পারতেন।তবে বাড়িতে বাবা গান গাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। নেত্রকোণা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন শৈলজারঞ্জন। স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে বি এস সি পাশ করে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এস সি করে আশুতোষ কলেজে শিক্ষকতা এবং গবেষণা করার সময়েই তাঁর বাবার আদেশে আইন পড়তে শুরু করলেন। আইন পাশ করে কিছু দিন নেত্রকোণায় ওকালতি করে কলকাতায় উকিলের পোশাক কিনতে এসে বন্ধু প্রভাত গুপ্ত-র সূত্রে প্রথমবার শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন। দিনেন্দ্রনাথের সঙ্গে আগেই চেনা ছিল। এবার তাঁর কাছে চোদ্দটি গান শিখলেন। সেই গানের ডালি নিয়ে নেত্রকোণায় ফিরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালন করলেন তিনি। গান গাইয়েছিলেন হিন্দু মেয়েদের পাশাপাশি মুসলমান মেয়েদের দিয়েও। সেকালের তুলনায় যা ব্যতিক্রম।

দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগ্রহেই শৈলজারঞ্জনের শান্তিনিকেতনে আসা। তখন বিশ্বভারতীতে রসায়ন বিভাগে একটা পদ খালি হবার সম্ভাবনা ছিল। দিনেন্দ্রনাথ প্রভাত গুপ্তকে ডেকে বলেছিলেন,"ও ( অর্থাৎ শৈলজারঞ্জন) তো গান ভালবাসে, ওকে এখানে আসতে লিখে দাও।" ১৯৩২-র জুলাই মাসের ১ তারিখে শৈলজারঞ্জন শান্তিনিকেতনের কাজে যোগ দিলেন। যোগ দিলেন গানেও। অল্পদিনের মধ্যেই রমা করের পরিচালনায় এক অনুষ্ঠানে গাইলেন দিনেন্দ্রনাথের কাছে শেখা ‘গগনে গগনে আপনার মনে’। শুনে খুশি হলেন রবীন্দ্রনাথ।

১৯৩৪ সালে দিনেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন ত্যাগ করার পর রবীন্দ্রনাথের কাছে শৈলজারঞ্জনের গান শেখার শুরু। ‘রোজ তিনটার সময় যেতাম। (শেখাবার) সময় ঠিক ছিল না। অনেকদিন বেশি সময় থাকতে হত’। অনেক গানের স্টক তাঁর ছিল বলে কবি তাঁকে ‘গীতাম্বুধি’ বলে ডাকতেন। বছরখানেক গান শেখার পর রবীন্দ্রনাথের আদেশে তিনি ছোটদের গানের ক্লাস নিতে শুরু করলেন। এরপর কলেজের অবাঙালি মেয়েদের আবেদনে সাড়া দিয়ে তাদের গান শেখানো, সাহিত্যসভায় এসরাজ বাজিয়ে সংগীত পরিচালনা চলতেই থাকল। পাশাপাশি চলল কেমিস্ট্রির অধ্যাপনা।  গান আর কেমিস্ট্রি দুটোই শেখাতেন বলে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছিলেন, কেউ জিজ্ঞেস করলে তিনি যেন বলেন তিনি কেমিক্যাল মিউজিক অথবা মিউজিক্যাল কেমিস্ট্রি পড়ান। রবীন্দ্রনাথ চাইতেন, শৈলজারঞ্জন যেন তাঁর গানেই মগ্ন থাকুন, রসায়নে নন। "বহুবার বলেছেন, শেষ পর্যন্ত গানই থাকবে"।

রবীন্দ্রনাথ রসিকতা পছন্দ করতেন। দোলে রং লাগানোও  তাঁর পছন্দের ছিল। কিন্তু শৈলজারঞ্জন তেমন পছন্দ করতেন না। কিন্তু কবি "ওকে রং দিবিনে? দে,ওকে দে। ভালো করে মাখিয়ে দে"- বলে আনন্দ পেতেন। কবির সঙ্গে এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল শৈলজারঞ্জনের। তাঁর জন্মদিনে আশীর্বাণী লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ- "জন্মদিন এল তব আজি/ ভরি লয়ে সংগীতের সাজি।/ বিজ্ঞানের রসায়ন রাগরাগিণীর রসায়নে/পূর্ণ হল তোমার জীবনে"। শৈলজারঞ্জনের খোঁজখবর নিতেন কবি নিয়মিত। "একবার তো আমায় হাজারিবাগে জোর করে পাঠিয়ে দিলেন। বললেন, তোমার চেহারাটা খারাপ লাগছে"।

গান গাইলেও অভিনয় করেছেন শৈলজারঞ্জন মাত্র দুবার। ‘রথের রশি’ আর ‘বৈকুন্ঠের খাতা’য়। দ্বিতীয়টিতে তিনি বিপিনের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তাতে ‘ভাবতে পারিনে পরের ভাবনা’- এই গানটি ও নৃত্যাভিনয় রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নিজে শিখিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে শৈলজারঞ্জন একাধিক গান শিখেছিলেন। শৈলজারঞ্জন ছিলেন স্বরলিপির অনুসরণকারী। শান্তিনিকেতনে দিনেন্দ্রনাথ ছাড়া কেউ স্বরলিপির ধারেকাছে যেতেন না। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাঁকে বলেছিলেন, ‘স্বরলিপি এমন ভাবে শেখাবে যেন চিঠি পড়ার মতো প্রত্যেকে স্বরলিপি পাঠ করতে পারে’। স্বরলিপির বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে বহু গানের অপ্রচলিত সুরও তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। এমন একটি গান হল ‘ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে’। গানটি তখন শান্তিনিকেতনে খুব শোনা যেত। গানটির এই অংশের দুটি সুর স্বরলিপিতে ছাপানো ছিল। শৈলজারঞ্জনের নজর পড়ায় তিনি পাশের ঘরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে গানটি গাইতে বললেন- ‘গুরুদেব ঠিক স্বরলিপির মতোই গানটিতে প্রথম পঙক্তি প্রথমে নিচু সুরটি, তার পরের বারে চড়া সুরটি গাইলেন’। তখন আর তাঁকে পায় কে! রবীন্দ্রনাথ গান রচনা করে শৈলজারঞ্জনকে দিলেই তিনি সুধীর করকে দেখাতেন। সঙ্গে সঙ্গে সুধীর কর রবীন্দ্রনাথের কাছে নতুন কবিতা দাবি করতেন। এভাবে বহু লেখা তৈরি হয়েছে। ১৯৩৯-র "বর্ষামঙ্গলে"র সময় শৈলজারঞ্জনের দাবিতেই রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ‘ওগো সাঁওতালি ছেলে’। এই সময় পরপর অনেক গান কবিকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলেন শৈলজারঞ্জন। ১৯৩৯-র শীতকালে ‘ডাকঘর’- অভিনয়ে অমলের অন্তিম শয্যায় গাওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ ‘সমুখে শান্তিপারাবার’ গানটি রচনা করেছিলেন। গানটি লিখে সুর দিয়ে দুপুর একটার সময় শৈলজারঞ্জনকে ডেকে শিখিয়ে বলেছিলেন, “এ গানটি আমার অন্যান্য গানের মতো তুমি কাউকে শিখিয়ো না। আমার তখন হয়ে-বয়ে যাবে তখন এ গানটি করে দিয়ো। ”

কবির প্রয়াণের পর মন্দিরের উপাসনায় তাঁরা গানটি গেয়েছিলেন।গভীর স্নেহ পেয়েছিলেন ইন্দিরা দেবীর কাছেও।

sailoja

গানের পাশাপাশি এসরাজ ও তবলা বাজানোয় দক্ষ ছিলেন শৈলজারঞ্জন। হারমোনিয়াম বাজাতে জানলেও রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে এসরাজই উপযুক্ত বলে তিনি মনে করতেন। ১৯৬০ সালে সংগীত ভবনের অধ্যক্ষপদ থেকে ইস্তফা দিয়ে তিনি কলকাতায় ‘সুরঙ্গমা’ নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন। রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্যায়ের সর্বাধিক স্বরলিপি তাঁরই করা। রবীন্দ্রনাথের গানের শুদ্ধতা রক্ষার জন্য তিনি আজীবন সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুন্ধতী দেবী, নীলিমা সেন, অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।

১৯৭৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে সংগীত আকাদেমি পুরস্কার দিয়েছিল। বিশ্বভারতী তাঁকে দেশিকোত্তম ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ডি. লিট  দিয়েছিল।

১৯৯২ সালের ২৪মে কলকাতার সল্টলেকে প্রয়াত হলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার।

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...