রবীন্দ্রনাথের গানের অনন্য শিল্পীঃ রমা কর

" আমাদের আশ্রম উৎসব/ যখনি জাগাবে গীতরব/তখনি তাহার মাঝে অশ্রুত তোমার কন্ঠস্বর/ অশ্রুর আভাস দিয়ে অভিষিক্ত করিবে অন্তর"-যাঁর মৃত্যুতে ব্যথিত কবি এই কবিতাটি লিখেছিলেন, তিনি  রমা কর- আশ্রমে তিনি পরিচিতা ছিলেন ' নুটু' নামে। ১৯০৩ সালে জন্ম হয়েছিল রমার। তাঁর পিতা  শ্রীশচন্দ্র মজুমদার ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধু। পেশায় তিনি ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ১৯০৮ সালে শ্রীশচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী যুগলমোহিনী দেবী সন্তানদের নিয়ে শান্তিনিকেতনে থাকতেন।

রমার দাদা সন্তোষচন্দ্র মজুমদার ছিলেন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রথম পাঁচজন ছাত্রদের অন্যতম। ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে এন্ট্রান্স পাশের পর রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁকেও রবীন্দ্রনাথ কৃষিবিদ্যা অধ্যয়নের জন্য আমেরিকা পাঠিয়েছিলেন। সেখানে কৃষিবিদ্যা ও পশুপালন বিদ্যা শিখে ভারতে এসে ডেয়ারি স্থাপন করেছিলেন। পরে তিনি শান্তিনিকেতনে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। সন্তোষচন্দ্রের অকালপ্রয়াণের পর রমা(নুটু) সংসারের হাল ধরেন। অমিতা সেন জানিয়েছেন, "শোকে-তাপে নুটুদিই মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে পারিবারিক সব কর্তব্য করে গেছেন।

দাদা সন্তোষচন্দ্র মজুমদারের যখন মৃত্যু হল, নুটুদির কতই-বা বয়স, কিন্তু তিনিই সংসারের ভার নিজের হাতে তুলে নিলেন। একে একে ছোট বোন রেখাদি, বাসুদির বিয়ে দিলেন"। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই পরিবারের সম্পর্ক ছিল নিবিড়। রমা ও তাঁর বোনেরা রবীন্দ্রনাথকে ডাকতেন  কাকামশাই বলে আর রথীন্দ্রনাথ, মীরা দেবীরা রমার মা যুগলমোহিনী দেবীকে ডাকতেন জ্যাঠাইমা বলে।

অত্যন্ত সুকন্ঠী ছিলেন রমা। "তখন গানে দিনুবাবুর পরেই ছিল তাঁর স্থান। নুটুদিকে ছাড়া কোনো উৎসব অনুষ্ঠান অভিনয় হতে পারত না।"

রমা গান শেখাতেন। রাণী চন্দের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, "নুটুদি গানের ক্লাশ নিতেন। শ্রীভবনে এসে এ ঘর, ও ঘর ঘুরে গাইয়ে মেয়ে কয়টিকে ডেকে খুঁজে জোগাড় করে মেঝেতে বসে গান শিখিয়ে দিতেন। এক একদিন কলাভবনেও চলে আসতেন। মিউজিয়ামের যে কোনো একটা ঘরে মেয়ে কয়টিকে জড়ো করে গান শিখিয়ে যেতেন"। শুধু তো গান শেখানো নয় গানকে প্রাণের দোসর করার দীক্ষাও দিতেন।

রাণী চন্দের স্মৃতিচারণে সেকালের শান্তিনিকেতনের ছবিটি বড় সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে। "রাত্রের খাবার পর নুটুদি এসে দাঁড়ালেন শ্রীভবনের গেটের সামনে। মেয়েরা এল, ছেলেরা এল। নুটুদির সঙ্গে সবাই মিলে গান ধরল 'আমার ভাঙা পথের রাঙা ধূলায় পড়েছে কার পায়ের চিহ্ন'। বৈতালিকের দল শ্রীভবনের সামনের লম্বা পথটি ঘুরে গুরুপল্লী হয়ে মাধবীবিতানের গেটের ভিতর দিয়ে পুরাতন গেস্ট হাউস ডাইনে রেখে উত্তরায়ণ পরিক্রমা করে ছাতিমতলা দিয়ে এসে শ্রীভবনের সামনের থামল। বারে বারে ফিরে ফিরে এই একটি গানই গাইতে গাইতে গানটি সবার কন্ঠে লেগে রইল"।

সেকালের তুলনায় একটু বেশি বয়েসেই শিল্পী ও স্থপতি সুরেন্দ্রনাথ করের সঙ্গে তাঁর বিবাহ  স্থির হয়। পাত্র পাত্রী দুজনে বিবাহে আগ্রহী হলে রবীন্দ্রনাথের সমর্থন পান। কিন্তু তাঁদের মধ্যে জাতিগত পার্থক্য থাকায় দেখা দিল সমস্যা। রমার অভিভাবিকা তাঁর মা যুগলমোহিনী দেবীর আপত্তি থাকায় রবীন্দ্রনাথ হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হলেন। এই বিষয়ে তিনি সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে চিঠি লিখলেন।
 

"একটা সামাজিক সঙ্কটে তোমার শরণাপন্ন হলাম। ইতিহাসটি এই- সুরেন এবং নুটু কোনো এক গ্রহচক্রে পরস্পরকে পছন্দ করেচে। নুটু বৈদ্য ঘরের  মেয়ে, সুরেন কায়স্থ ঘরের ছেলে। নুটুর মা হিন্দুসমাজের সনাতন বিধিবিধানে অবিচলিত নিষ্ঠাবতী"।

অবশেষে সমস্যাটির সমাধান হয়। রাণী চন্দের স্মৃতিচারণে অবশ্য এইসব ঘনঘটার আভাসমাত্র নেই। সেখানে শুধুই আনন্দধ্বনি। "....সুরেনদার বিয়ে নুটুদির সঙ্গে। আশ্রমে একটা খুশির ঢেউ জাগল। নুটুদির মা থাকতেন মেয়েদের নিয়ে- এখন যেটা সঙ্গীতভবন তার পাশে রাস্তা- সেই রাস্তার অপর দিকে ছিল একটা বড়ো খড়ের চালার ঘর, সেই বাড়িতে। ......... আমরা কলাভবনের দল বরের বাড়ি, কনের বাড়ি ছুটোছুটি করি। গুরুপল্লীতে নন্দদার বাড়ি অর্থাৎ বরের দাদার বাড়ি। সুধীরা বৌদি থালায় থালায় তত্ত্ব সাজিয়ে দিলেন। আমরা মেয়েরাই সে তত্ত্ব মাথায় করে গান করতে করতে খেলার মাঠের ভিতর দিয়ে কনের বাড়ির উঠোনে এসে থামি। বরের বাড়ির তত্ত্বের থালা মাথা হতে নামিয়ে কনের বাড়ির উঠোন লেপে আলপনা দিতে বসি- সেও আমরাই"।

সুরেন কর ও রমা মজুমদার (নুটু) দুজনেই ছিলেন রবীন্দ্রনাথের নিতান্ত আপনার জন। বিবাহের দিন স্থির হল ২৫শে বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী ছাপা হল হাতে তৈরি কাগজে-" ও যে সুরভবনের রমার কমলবনবাসী/ মর্ত্যে নেমে বাজাইল সাহানায়/ নন্দনের বাঁশি!.../এলো প্রেম চিরন্তন, দিল দোঁহে আনি/ রবিকর-দীপ্ত আশীর্বাণী"। তারপর? "বাসরঘর সাজিয়ে বর-কনেকে এনে তুললাম কলাভবনে আমাদেরই বসে আঁকবার সেই ছোট্ট বাড়িটিতে। তখন গ্রীষ্মাবকাশে আশ্রম ছুটি, কলাভবনের কাজও বন্ধ। সুরেন দা নুটুদি এই বাড়িতেই প্রথম সংসার পাতলেন"। তাঁদের সংসার দেখতে এলেন রবীন্দ্রনাথ। বললেন, "তোমরা এই বাড়িতেই থাকো।এইটিই তোমাদের বাড়ি হোক"।

কিন্তু সুরেন- রমা ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। আশ্রমের বাড়ি তাঁরা নেবেন কেন? " সুরেনদা কাছেই একটা মাটির চৌচালা বাড়ি তুলেছিলেন, গরমের ছুটিতে আশ্রম খুলবার আগেই সে বাড়িতে নুটুদিকে নিয়ে চলে গেলেন।" সুরেন কর ছাড়া সেদিনের শান্তিনিকেতন আশ্রম চলত না। আশ্রমের সর্বকাজে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বস্ত সহায় ছিলেন তিনি। রমাও ছিলেন জড়িয়ে- গানের সুরে। শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে স্বামী- স্ত্রী দুজনেই- সেদেশের আমন্ত্রণে। " .... ওখানকার নির্দেশ অনুযায়ী একদিন গুরুদেব আমাদের নিয়ে রওনা হলেন। নন্দদা শৈলজাবাবু বোঠান মীরাদি নুটুদি নাচের মাস্টার ছেলের দল মেয়ের দল মিলে মস্ত দল।" নৃত্যনাট্য আর বক্তৃতায় মেতে উঠল শ্রীলঙ্কাবাসী-"খুব ভিড় হতে লাগল প্রতিটি শো তে"।

রমার গানের সুরে ভরে থাকত শান্তিনিকেতন। একবার আলাপিনী মহিলা সমিতির উদ্যোগে হল ঋতু উৎসব। সে কাহিনি শোনা যাক অমিতা সেনের জবানীতে-"শীত ঋতু সেজেছিলেন শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের কন্যা আমাদের নুটুদি, পরনে শুভ্র সাদা শাড়ি- শাড়ির আঁচলটি যেন গাছের শুকনো কোনো ডালে আটকে গেছে। সেই আঁচলটি ছাড়াবার ভঙ্গিতে নুটুদি গাইছেন, 'ছাড় গো তোরা ছাড় গো/ আমি চলব সাগর পার গো'-কি সুরেলা গলা নুটুদির, আজ যেন মনের মধ্যে সে গান শুনতে পাই"।

রমার গানকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়ে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। কবি তাঁর সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গেয়েছিলেন, "তোমার সুরের ধারা ঝরে যেথায় তারি পারে"। রেকর্ডিং- এর নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও রমার সুরেলা মধুর কণ্ঠটি আজও একালের শ্রোতার হৃদয়ে দোলা দেয়। রেকর্ডিং-এ সমস্যা থাকায় সে রেকর্ডটিকে রবীন্দ্রনাথ ‘রিজেক্ট’  করেছিলেন। কিন্তু কালের আশ্চর্য স্পর্শে সেই বাতিল হয়ে যাওয়া রেকর্ড রয়ে গিয়েছিল কোথাও। কিভাবে, কে জানে! আজ তা ইতিহাসের স্মারক। রমার গাওয়া 'ও আমার চাঁদের আলো', 'আর নাই রে বেলা' ইত্যাদি গানগুলি তে ধরা আছে হারানো দিনের গায়কী।

দীর্ঘ জীবন পাননি রমা কর। দুটি শিশুকে রেখে ১৯৩৫ এর ১৯ জানুয়ারি কলকাতায় তিনি প্রয়াত হন। তাঁর স্মরণে ব্যথিত রবীন্দ্রনাথ লিখলেন-"হে বৎসে, যা দিয়েছিলে আমাদের আনন্দভান্ডারে,/ তারি স্মৃতিরূপে তুমি বিরাজ করিবে চারিধারে"।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...