রবীন্দ্রনাথের গানের অনন্য শিল্পীঃ মালতী ঘোষাল

“একবার মনে আছে একটি টপ্পার মধ্যে/ উদ্ভাসিত হয়েছিল আসমুদ্রহিমালয়/ প্রাচীন বিশাল ভারতবর্ষের অন্তরের ঘনিষ্ঠ আকাশ/ মালতী ঘোষাল তাঁর স্পষ্টস্বরে গাইলেন যখন এই/পরবাসে রবে কে এ পরবাসে/ আজীবন দীর্ঘ পরবাস/ সেদিন দেশের সত্তা রবীন্দ্রনাথের  দীর্ঘশ্বাসে/ সুরের সত্যের নিঃসংশয়  উদার অক্ষরে/ চিরতরে মূর্তি পেল থেকে- থেকে একা ভিড়ে/ আবৃত্তির বাণী।/ রবীন্দ্রনাথের গান হয়ে গেল দেশ সারা দেশ/ বিস্তৃত য্ন্ত্রণা নিজবাসভূমি এই পরবাস দেশ”।

মালতী ঘোষালকে, মালতী ঘোষালের গানকে এভাবেই চিরদিনের করে তুলেছেন কবি বিষ্ণু দে। যাঁর গায়নে রবীন্দ্রনাথের গান এমন প্রাণ পেত সেই মালতী ঘোষালের জন্ম ১৭ ডিসেম্বর ১৯০২ সালে, কলকাতায়। তাঁর  পিতা ছিলেন কুন্তলীনখ্যাত হেমেন্দ্রমোহন বসু। বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন হেমেন্দ্রমোহনের নানারকম ব্যাবসা ছিল।

প্রসাধনী, মিষ্টি পানীয়, পান মশলা- সব কটিরই চাহিদা ছিল খুব। তাঁর বিজ্ঞাপনের ভাষাটিও ছিল মনমাতানো- “কেশে মাখো ‘কুন্তলীন’/ রুমালেতে ‘দেলখোস’/ পানে খাও 'তাম্বুলীন’/ ধন্য হোক এইচ. বোস”। এই বিজ্ঞাপনে অবশ্য তাঁর ফোনোগ্রাফ, গ্রামোফোন রেকর্ড তৈরির কথা বলা হয়নি। চিরাচরিত ব্যাবসার পথ নয়, তাঁর আগ্রহ ছিল নতুন কিছু করার।

তাই ফোনোগ্রাফ থেকে প্যাথেফোন যন্ত্র পর্যন্ত তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন। পুণ্যলতা চক্রবর্তীর স্মৃতিকথায় আছে, “ফনোগ্রাফ (গ্রামোফোন) প্রথম পিসেমশাইয়ের বাড়িতেই দেখি, রেকর্ডও তিনি নিজেই তৈরি করতেন। তখনকার রেকর্ডগুলো এরকম চ্যাপ্টা গোল ছিল না, চোঙ্গার মতো হত। দ্বিজেন্দ্রলালের গাওয়া তাঁর হাসির গান, রবীন্দ্রনাথের গাওয়া ‘বন্দেমাতরম্’ গান পিসেমশাইয়ের নিজে তোলা রেকর্ডে শুনেছিলাম…….”

এই পরিবেশে বড় হয়ে উঠেছিলেন মালতী। বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছোট বোন মৃণালিনী দেবীর বড় মেয়ে ছিলেন মালতী। ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়ে তিনি সঙ্গীতের প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়িকা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বোন অমলা দাশের কাছে। লীলা মজুমদারের স্মৃতিকথায় আছে, “আমাদের পিসতুতো দিদি মালতী, তাঁর অপূর্ব গানের গলা এখন পর্যন্ত টসকায়নি এবং তাকে সবাই মালতী ঘোষাল বলে জানে সেও ছিল ওদের সম-বয়সী বন্ধু, সেও মাঝে মাঝে এসে ২/১ দিন কাটিয়ে যেত”। কোথায় কাটিয়ে যেতেন? সেই বিখ্যাত গড়পারের বাড়িতে-যেখানে জন্ম ‘সন্দেশ’  পত্রিকার, যে বাড়িতে থাকতেন উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার সহ আরও কত গুণীজন।

মালতী ঘোষাল ও তাঁর ভাইবোনদের সম্বন্ধে তাঁর মামাতো বোন পুণ্যলতা বলেছিলেন, “ পিসীমার চোদ্দটি সন্তানের মধ্যে অনেকের তখন জন্ম হয়নি, তবু তখনও তাঁর বাড়িটি সর্বদা শিশুর কল-কাকলিতে পূর্ণ থাকত”। তাঁদের অনেক ভাই-বোনই ছিলেন অত্যন্ত গুণী। যদিও পরিবারের বাইরে তাঁরা বিশেষ খ্যাতিমান হননি। মালতীর গান শেখার পরিসরটি ছিল বিস্তৃত। হেমেন্দ্রমোহনের রেকর্ডিং কোম্পানির সূত্রে তাঁদের বাড়িতে বহু শিল্পীর আসা-যাওয়া ছিল।

এঁদের মধ্যে মানদাসুন্দরী দাসীর কাছে টপ্পা ও পূর্ণকুমারী দাসীর কাছে মালতী তিনি কীর্তন শিখেছিলেন। তাছাড়া গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্যামসুন্দর মিত্রের কাছে তিনি তালিম নিয়েছিলেন। লীলা মজুমদার লিখেছেন, “পিসিমার বড় মেয়ে মালতী ঘোষালকেও সবাই চেনে। যেমন গলা, তেমনি সাধনা। গোপেশ্বরবাবুর ছাত্রী ছিল”। সঙ্গীতের অন্যান্য ধারায় তালিম নিলেও মালতী রবীন্দ্রনাথের গানই গাইতেন। সীতা দেবীর স্মৃতিকথায় আছে, ১৯২১-র ২০ আগস্ট ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের সভায় রবীন্দ্রনাথকে অভিনন্দন জানানো হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে “মেয়েদের গানের মধ্যে শ্রীমতী মালতী বসু ও শ্রীমতী লীলা গুহের গান খুব ভালো হইল”। শুধু গানে নয়। মালতীর দক্ষতা ছিল সেতারেও। খুব ভালো সেতার বাজাতেন তিনি।

১৯৩৫ সালে বিখ্যাত মাইক্রোবায়োলজিস্ট ড. সুশান্তচন্দ্র ঘোষালের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। সুশান্তচন্দ্র স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের শীর্ষ পদে আসীন ছিলেন। সেকালের মারণব্যাধি কালাজ্বর ও কলেরা নিয়ে তিনি গবেষণা করেছিলেন। পেশাগত জীবনের পাশাপাশি সুশান্তচন্দ্রের সঙ্গীতে আগ্রহ ছিল। তিনি নিজেও ভালো গান গাইতেন।

তাঁর উৎসাহে মালতী ঘোষালের সঙ্গীত জীবনে যোগ হয় নতুন মাত্রা। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী দ্বৈতকন্ঠে ব্রাহ্মসমাজের নানা অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। মালতী ঘোষালের প্রথম রেকর্ড “কে বসিলে আজি”“হৃদয়বাসনা পূর্ণ হল" প্রকাশিত হয় ১৯৪০ সালে। তাঁর দ্বিতীয় রেকর্ড “এ পরবাসে রবে কে” ও “যদি এ আমার হৃদয় দুয়ার”। বহু পরিচিত “এ পরবাসে রবে কে” গানটি মূলত মুক্তছন্দে গাওয়া হয়। মালতী ঘোষাল কিন্তু গানটি তাল ও ছন্দে নিবদ্ধ করে গেয়েছিলেন। রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে রমেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দ্বৈতকন্ঠে মালতী “আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে” এবং “সকলকলুষতামসহর” গান দুটি রেকর্ড করেছিলেন। ১৯৫২ সালে সুশান্তচন্দ্রের মৃত্যুতে মালতী ঘোষাল গানবাজনার জগৎ থেকে সরে আসেন।

১৯৮৪ সালের ১৯ শে জুলাই প্রয়াত হন মালতী ঘোষাল। সমাপ্তি ঘটে একটি আশ্চর্য সত্তার। যখন ‘গায়ক নিজে অথবা গায়িকা হয়ে ওঠে গান কথা সুর’- আধেয় আধার যেখানে একাকার, গানের লীলার সেই কিনারায় শ্রোতাকেও নিয়ে যাবার অসামান্য ক্ষমতা ছিল মালতী ঘোষালের।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...