রবীন্দ্রনাথের গানের অনন্য শিল্পীঃ কুন্দনলাল সায়গল

"সায়গল যেন নিরেট সিমেন্ট – বাঁধানো কঠিন প্রাচীরের বুকে কোথায় কোন ফাঁকে গজিয়ে ওঠা একগুচ্ছ দুর্বাঘাস।... এমন মধুর মানুষ বড় দুর্লভ"। গায়ক-নায়ক কুন্দনলাল সায়গল সম্বন্ধে এমনই বলেছিলেন তাঁর সহ-অভিনেত্রী কানন দেবী।

১৯০৪ সালের ১১ এপ্রিল(মতান্তরে ৪ এপ্রিল) জম্মু শহরে জন্ম হয়েছিল কুন্দনলাল সায়গলের। তাঁর বাবা অমরচন্দ সায়গল ছিলেন তহশিলদার। মা কেশর দেবী ছিলেন ধর্মপ্রাণা। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তিনি ভজন গাইতেন। বালক কুন্দনলাল মায়ের সঙ্গে নানান অনুষ্ঠানে যেতেন। সুরপাগল সায়গল বাবার কড়া শাসন সত্ত্বেও পড়াশোনা না করে 'রামলীলা'-য় সীতার ভূমিকায় অভিনয় করতেন। কখনও রেলের টাইমকিপার, কখনও রেমিংটন কোম্পানীর টাইপরাইটার বিক্রেতা ইত্যাদি নানান ধরণের কাজ করেছিলেন সায়গল। এভাবেই তিনি এসে পৌঁছেছিলেন কলকাতায়।

কলকাতা বেতারকেন্দ্রে গান গাইবার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আসা সায়গলের অডিশন নিয়েছিলেন আর এক তরুণ পঙ্কজ মল্লিক। গান শুনে মুগ্ধ পঙ্কজকুমার প্রোগ্রাম ডিরেক্টর নৃপেন মজুমদারকে ডেকে আনলেন। নৃপেন মজুমদার আর রাইচাঁদ বড়ালের সায়গলের গান এতই ভালো লাগল যে সেই দিন সন্ধ্যেবেলাতেই তাঁর গাওয়া দুটি গজল টেলিকাস্ট করা হল।

সূচনা হল সায়গলের জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের। কলকাতা বেতারে নিয়মিত গান গাইবার সুযোগ পাবার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি গায়ক-অভিনেতা হিসেবে কাজের সুযোগ পেলেন নিউ থিয়েটার্সে। প্রথম দিকে তিনি কয়েকটি হিন্দি ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। বাংলাভাষা ভালোভাবে আয়ত্ত করার পর তিনি বাংলা চলচ্চিত্রেও নায়ক-গায়ক হয়ে দর্শকমন জয় করেছিলেন। তাঁর অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র 'মুহব্বত কে আঁসু'। সায়গলের প্রথম বাংলা ছবি 'দেবদাস'। পঙ্কজকুমার মল্লিকের মতে, "অভিনয়ে সে ছিল মোটামুটি ভালো, কিন্তু গানে ছিল অসাধারণ"।

সায়গলের গানে মুগ্ধ পঙ্কজকুমার তাঁকে দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ানোয় আগ্রহী হয়ে উঠলেন। আগ্রহ ছিল সায়গলের, ছিল সমস্যাও।"বাংলা উচ্চারণে, বিশেষ করে যুক্তাক্ষর উচ্চারণে ওর ত্রুটি একটু কান পাতলেই ধরা পড়ে যেত। তাই ধৈর্য সহকারে ওর উচ্চারণকে ত্রুটিমুক্ত করতে লাগলাম"। অবশেষে সায়গল গাইলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত। পঙ্কজকুমার মল্লিক তাঁকে শেখালেন "প্রথমদিনের উদয় দিগঙ্গনে"। শুধু শেখানো নয়, গানটির অর্থও তাঁকে ধরে ধরে বোঝালেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার তীব্র ইচ্ছে ছিল সায়গলেরও। "জীবন মরণ"(১৯৩৯) ছবিতে "তোমার বীণায় গান ছিল " আর "আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান", "পরিচয়"(১৯৪১) ছবিতে "এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার", "একটুকু ছোঁয়া লাগে", "আজি খেলা ভাঙার খেলা", "আমার রাত পোহালো" অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী কনক দাশ একবার বলেছিলেন, "রবীন্দ্রসঙ্গীতের জনপ্রিয়তা সৃষ্টিতে পঙ্কজবাবুর নিজের বিধিদত্ত কন্ঠ ও আরাধনা তো ছিলই, সঙ্গে সঙ্গে এ দুটি শিল্পীর ভূমিকাও কম নয়। সায়গলের দরাজ কন্ঠ, কাননের এক্সপ্রেশন তাঁদের অনন্য করে রেখেছে"।

KL-SAIGAL-001

নিজের গানকে শুদ্ধতার তুঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য সায়গলের আগ্রহ ও চেষ্টা কত তীব্র ছিল, তার প্রমাণ আছে পঙ্কজ মল্লিকের স্মৃতিকথায়। সায়গল যখন শিল্পী হিসেবে নাম করেছেন, অর্থও উপার্জন করেছেন যথেষ্ট, তখন তিনি একটা মোটর বাইক কিনে তাতে করেই টালিগঞ্জ স্টুডিয়োতে আসা-যাওয়া করতেন। সেই সময় একদিন পঙ্কজকুমারকে  বাইকের পিছনে বসিয়ে চালিয়ে নিয়ে যাবার সময় মোটরবাইকের একটানা ভটভট শব্দকে তাল ও স্কেল করে সায়গল গান ধরেছিলেন, "শারদপ্রাতে আমার রাত পোহালো"। সায়গল বাইকের শব্দের তালে তাল মিলিয়েই "বাঁশি তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে" গাইছেন আর পঙ্কজ মল্লিককে বলছেন, "পঙ্কজ তুই-ও গা"। আর পঙ্কজ মল্লিক বলছিলেন, "ঠিক করে কর"। যেখানে ভুল হচ্ছে বলছেন-"ঠিক হল না"। এভাবে এবড়োখেবড়ো রাস্তায় চলতে চলতে এক ঝাঁকুনিতে পড়ে গেলেন পঙ্কজকুমার। স্মৃতিকথায় তিনি জানিয়েছিলেন, "কুন্দন কিছুই বুঝতে পারেনি। সে মহানন্দে 'বাঁশি তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে' গাইতে গাইতে সশব্দে চলে গেল"। বাইকের গতি বেশি না থাকায় পঙ্কজ মল্লিকের চোট লাগেনি। তিনি ট্রাম ধরে বাড়ি ফিরে এলেন কিছুসময় পরে সায়গল এসে উপস্থিত। একটুখানি গিয়েই সায়গল বুঝতে পেরেছিলেন যে পঙ্কজকুমার পিছনে নেই। তখন আস্তে আস্তে বাইক চালিয়ে পিছন দিকে এসে যেখানে ঘটনাটি ঘটেছিল তার কাছাকাছি এক চায়ের দোকানে সব খবর পেয়ে সোজা পঙ্কজ মল্লিকের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি। এই আপনভোলা আন্তরিক সুরপাগল মানুষটির প্রতি অন্তরের গভীর কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করেছেন কানন দেবী। কীভাবে সায়গল সহগায়িকাকে সাহস দিতেন, কীভাবে বলতেন, "আরে দূর, ছেড়ে দিন ওসব ঝুটঝামেলার বাত। আপনি গান তো"। গান শুরু করতে না করতে উৎসাহের প্লাবনে, তারিফের উচ্ছাসে সব ভয়কে ভাসিয়ে নিয়ে যেতেন তিনি। তখনকার দিনে গানের রেকর্ডিং-এর সময় একটাই মাইক্রোফোন থাকত বলে সব শিল্পীই এমন ভাবে দাঁড়াতে চাইতেন যাতে মাইক্রোফোনে তার গলা ভালো শোনা যায়। কিন্তু সায়গল তো অনন্য। তাই "আমার ও সায়গলের ডুয়েট গান টেকের সময় উনি চট করে সরে মাইক্রোফোনের দিকে আমাকেই ঠেলে দিতেন"। কানন দেবীর মতো অভিনেত্রী তাই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, "এ ঋণ কি কোনোদিন শোধ হবার"?

গান ছিল সায়গলের প্রাণ। সুরের প্রতি একনিষ্ঠতা আর গানের গভীরে যাবার অসামান্য ক্ষমতা সায়গলকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যতিক্রমী গায়ক করে তুলেছিল। তাঁর গাওয়া গান অনুমোদন করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। "জীবন মরণ" ছবির "আমি তোমায় যত" গানটির ' উঠবে যখন তারা সন্ধ্যাসাগর কূলে' অংশটি না কেঁদে কখনও গাইতে পারতেন না সায়গল। এই গানেই 'কবি' শব্দটি শুধু ছবির প্রয়োজনে 'জানি' গাইতে অনুমতি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রেকর্ডে কিন্তু নয়। ফিল্মে তাই সায়গল গেয়েছেন 'জানি' আর রেকর্ডে 'কবি'।

সায়গল ছিলেন সেই গায়ক যাঁর গান শুনে ছোট্ট লতা ভাবতেন বড় হয়ে তাঁকে বিয়ে করবেন। সায়গল ছিলেন এমন একজন যিনি লাইটম্যানকে তাঁর মেয়ের বিয়েতে যাবেন কথা দিয়েছিলেন বলে অনায়াসে পঁচিশ হাজার টাকার অনুষ্ঠান ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৪১ সালে তিনি গেলেন মুম্বই, সেখানেও তুললেন তাঁর জয়পতাকা। সুরমগ্ন মানুষটি সুরাতেও ডুবে থাকতেন। ভরাট গলার মধুর কন্ঠ তাই নিতান্ত অসময়ে থেমে গেল।

১৯৪৭ সালের ১৮ জানুয়ারি মাত্র ৪২ বছর বয়েসে স্ত্রী আশারাণী ও তিন সন্তানকে রেখে সুরলোকে গান শোনাতে চলে গেলেন কুন্দনলাল সায়গল।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...