একবার শান্তিনিকেতনে সিংহসদনের এক অনুষ্ঠানে গুরুদেব ইন্দুলেখা ঘোষকে 'মরি লো মরি' গানটি নিজে শিখিয়ে সামনে বসে গাওয়াচ্ছিলেন। অর্ধেক গান শোনার পর গুরুদেব আর না গেয়ে থাকতে পারলেন না। নিজেই গাইতে আরম্ভ করলেন। স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার। গানটি ছিল রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত প্রিয়। যৌবনে তো বটেই, এমনকি পরিণত বয়েসেও তিনি এই গানটি গাইতে খুব ভালোবাসতেন। স্বাভাবিকভাবেই গান তিনি তাকেই শেখাতেন যার ক্ষমতার ওপর তাঁর সম্পূর্ণ নির্ভরতা থাকত।
বারাণসীর বাসিন্দা সুকন্ঠী ইন্দুলেখা ঘোষের গান শুনে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে শান্তিনিকেতনে আসতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু ইন্দুলেখা যখন শান্তিনিকেতনে এলেন, তখন দিনেন্দ্রনাথ আর সেখানে নেই। তিনি তখন কলকাতাবাসী। ইন্দুলেখা কিন্তু রয়ে গেলেন শান্তিনিকেতনে। গান শিখলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছে। শিখলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার সহ আরও অনেকের কাছে। শান্তিনিকেতনের প্রাক্তনী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বন্ধু প্রীতি ভৌমিকের(অনু)স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায় একটা সময় শান্তিনিকেতন মেতে থাকত ইন্দুলেখা ঘোষের গানে। রবীন্দ্রনাথ ইন্দুলেখার গান খুব পছন্দ করতেন।
ইন্দুলেখা যখন শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন তখন রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ পর্ব। কবির ‘গানের ঝর্ণাতলায়’ তিনি ‘সাঁঝের বেলা’য় এলেও নিজের কলসখানি তিনি রবীন্দ্রনাথের গানে পূর্ণ করে নিয়েছিলেন। খুব অল্পদিনের মধ্যেই তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে নিজের দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছিলেন। ১৯৩৭-৩৮ সাল নাগাদ কলকাতা আর শান্তিনিকেতনের শিল্পীদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কলকাতার ছায়া প্রেক্ষাগৃহে ‘বর্ষামঙ্গল’ অনুষ্ঠানটি করেছিলেন। শান্তিনিকেতনে থেকে আসা শিল্পীদের অন্যতম ছিলেন ইন্দুলেখা।
পৃথিবীর সংগীতের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের মতো আর কোনও শিল্পীকে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ, যিনি নিজের শ্রাদ্ধবাসরের গানও লিখে গিয়েছিলেন। ‘সমুখে শান্তিপারাবার’ গানটি বিষয়ে জানা যায়, যে গানটি রচনা করে এক দুপুরে তিনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন শৈলজারঞ্জনকে। কবি বলেছিলেন, সেদিন তিনি যা প্রত্যক্ষ করেছিলেন তাই তিনি সেই গানে ধরে রেখেছেন। কিন্তু অন্যান্য গানের মতো সেই গানটি যেন শৈলজারঞ্জন অন্য কাউকে না শেখান। কবির স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, তাঁর মৃত্যুর পর যেন গানটি শৈলজারঞ্জন অন্যদের শেখান।
তাঁর যখন ‘হয়ে বয়ে যাবে’ তখনই যেন গানটি গাওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথের চরম সংবাদ নিয়ে যখন শান্তিনিকেতনে টেলিগ্রাম এল তখন উদ্ভ্রান্ত শৈলজারঞ্জন ছুটছিলেন কলকাতার দিকে, পথে দেখা হল ক্ষিতিমোহন সেনের সঙ্গে। তিনি মনে করিয়ে দিলেন গানটির কথা। ফিরে এলেন শৈলজারঞ্জন। গানটি শেখালেন তাঁর ছাত্রীদের। তারপর কবি যখন শেষ যাত্রায়, তখন শান্তিনিকেতনের মন্দিরে চোখের জলে ভেসে গানটি গেয়েছিলেন ইন্দুলেখা ঘোষ, অমলা সরকার, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও শৈলজারঞ্জন মজুমদার। কবির প্রাণের শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকদের গানের অশ্রুভরা সুরে সিক্ত হল, স্নিগ্ধ হল কবির যাত্রাপথ।
ইন্দুলেখা ঘোষের একাধিক গানের রেকর্ড বেরিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের জীবিতাবস্থাতে। হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি থেকে বেরিয়েছিল ‘আমার হিয়ার মাঝে’, ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’, ‘আমার মল্লিকাবনে’ ইত্যাদি। উদাত্ত সুরেলা ভাবগম্ভীর গায়নে, স্পষ্ট উচ্চারণে শান্তিনিকেতনের সেকালের গায়কী ধরা আছে। শান্তিনিকেতনের আর এক প্রাক্তনী মহাশ্বেতা দেবীর স্মৃতিচারণায় ১৯৩৬ সালের আশ্রমের বৈশাখের প্রথম দিনটির উদযাপনের এক স্নিগ্ধ ছবি ধরা আছে। সেই সময়ে গানে অংশ নিতেন মহাশ্বেতার ‘ইন্দুদি’- ইন্দুলেখা ঘোষ, নন্দিতা কৃপালানী, শৈলজারঞ্জন মজুমদার সহ অন্যান্যরা। থাকতেন রবীন্দ্রনাথ। গানে, পাঠে পালিত হত নববর্ষ।
ইন্দুলেখা শান্তিনিকেতনে গান শিখেছেন, গান গেয়েছেন, এমনকি গান শিখিয়েওছেন। তাঁর ছাত্রীদের মধ্যে আছেন রাজেশ্বরী দত্ত, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন প্রমুখ রবীন্দ্রসংগীতের অনন্যারা।
এত গুণে গুণী ইন্দুলেখা ঘোষকে ভুলতে বাঙালির সময় লাগেনি। আজ সামান্য কয়েকজন গুণীব্যক্তির স্মৃতিচারণায় কেবল ধরা আছে তাঁর স্মৃতিটুকু।
ছবিঃ প্রতীকী