রবীন্দ্রনাথের গানের অনন্য শিল্পীঃ বিজয়া রায় (দাশ)

"আমি রবীন্দ্রনাথের গানের অন্ধ ভক্ত, কিন্তু কিছু কিছু গান একটু একঘেঁয়ে লাগে"। একজন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর এই অনুভূতি এবং তার বহিঃপ্রকাশ অত্যন্ত ব্যতিক্রমী। অবশ্য এই বাক্যটি যিনি বলেছেন তিনি নিজেই যে ব্যতিক্রমী- তিনি বিজয়া রায়(দাশ)। সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রী- এই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। তিনি নিজে ছিলেন অসামান্যা গায়িকা। সেলাই এবং দেশ-বিদেশের রান্নাতেও তাঁর যথেষ্ট দখল ছিল। একটা সময় তিনি "সন্দেশ" পত্রিকার সম্পাদনাও করেছেন। করেছেন লেখালেখিও।

১৯১৭ সালের ২৭ অক্টোবর পাটনায় জন্ম বিজয়ার। তাঁর বাবা ছিলেন ব্যারিস্টার চারুচন্দ্র দাসমা মাধুরী দেবীদেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন তাঁর মেসোমশাই। বিজয়ারা ছিলেন চার বোন আর বাবা মা নিয়ে এক উচ্চবিত্ত সুখী পরিবার। "বাবা তখনকার দিনে বহু বছর বিলেতে থাকার দরুন হাবেভাবে পুরোপুরি সাহেব ছিলেন। মা এবং মাসিমা(দেশবন্ধুজায়া বাসন্তী দেবী) ছোটবেলা থেকে লোরেটো কনভেন্টে পড়েছিলেন, ফলে ইংরেজিটা ভালোই জানতেন, কিন্তু মেসোমশাই- এর সঙ্গে বিয়ে হবার পর স্বদেশী ভাবাপন্ন হয়ে পড়েছিলেন। বড় বোনের সঙ্গে ছোট বোনও"- লিখেছেন বিজয়া।

বাবা চারুচন্দ্র দাশ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, "বাবার অসামান্য গানের গলা ছিল। আমাদের পরিবারে একটি কথা আছে, 'গুপ্তবংশ'-র রক্ত যাঁর গায়ে আছে সে-ই গাইতে পারবে। আমার ঠাকুমার বাবা ভক্ত কালীনারায়ণ গুপ্ত শুধু যে মধুর কন্ঠের অধিকারী ছিলেন তাই নয়, ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হয়ে উনি প্রচুর ব্রহ্মসঙ্গীত লিখেছিলেন যা এখনও সমাজে গাওয়া হয়"

ছোট থেকেই বিজয়া ছিলেন সুমধুর কন্ঠের অধিকারিনী। যখন তাঁর ৬/৭ বছর বয়েস তখন দিলীপকুমার রায় বিজয়ার গান শুনে চারুচন্দ্র দাসকে বলেছিলেন, "দাসসাহেব, আপনার এতটুকু বাচ্চা মেয়ের এত অপূর্ব গানের গলা আর আপনি আমায় এতদিন কিছু বলেননি। আপনি তো জানেন আমি ভালো গাইয়ের জন্য পাগলের মতো ছুটে বেড়াই। কথা দিন, এবার যখন কলকাতায় যাবেন, আমি যেন অতি অবশ্য একটা খবর পাই"

এরপর যখন বিজয়ারা কলকাতায় গেলেন, দিলীপকুমার ঝড়ের মতো এসে ছোট্ট বিজয়াকে নিয়ে গিয়ে হল ভর্তি মানুষজনের সামনে গান গাইয়েছিলেন। এমনকি সর্বসমক্ষে গান তুলিয়ে গান গাইয়েছিলেন। "উনি দু'বার গাইলেন, তারপর বললেন, " আমার সঙ্গে গাইতে পারবে"? আমি বিনা বাক্যব্যয়ে ওঁর সুরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে গাইতে আরম্ভ করলাম। শেষ হলে পর বললেন, 'সাবাশ বিজয়া'।"

বিজয়ার গান শেখার শুরু পাটনাতে। তাছাড়া শিখেছেন সাহানা দেবী- তাঁর 'ঝুনু পিসি'- র কাছে। "ঝুনু পিসিমার কাছে আমি অজস্র গান শিখেছিলাম। বেশির ভাগ ক্ল্যাসিক্যাল, সেমি- ক্ল্যাসিক্যাল, দ্বিজেন্দ্রগীতি এবং আমার জ্যাঠামশাই অতুলপ্রসাদ সেনের গান। ভারী ভালোবাসতেন আমাকে।" ছ/ সাত বছর বয়েসেই আর একবার কলকাতায় এসে 'সংগীত সম্মিলনী'-তে সাহানা দেবীর শেখানো গান গেয়ে উপস্থিত সুধীবৃন্দ সহ স্বয়ং সাহানা দেবীর আশীর্বাদ পেয়েছিলেন। বিজয়ার ছোটপিসি ছিলেন প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়িকা কনক দাশ, যাঁর সম্পর্কে বিজয়া বলেছেন, "ছোট পিসি তাঁর এই খুদে ভাইঝির গান সবাইকে শোনাবার জন্য অস্থির হয়ে থাকতেন।"

কনক দাশের জন্যেই বিজয়া পৌঁছে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। বিজয়া জানিয়েছেন, " সেবার বকুলবাগান রোডের বাড়িতে পৌঁছতে না পৌঁছতে ছোটপিসি একেবারে লাফিয়ে উঠলেন। তখন কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের 'বর্ষামঙ্গল' চলছিল এবং ছোটপিসি একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটা বড় ভূমিকা পালন করছিলেন। উনি এত ভালো গাইতে পারতেন, কিন্তু লোকের সামনে গাইতে গায়ে জ্বর আসত।

মেজপিসি্র দিকে তাকিয়ে বললেন, "মেজদি, আজ আমার গান মঙ্কুকে দিয়ে গাওয়াব। ওর তো গান তুলতে সময় লাগবে না। এক্ষুনি ওকে গান দুটো শিখিয়ে দেব। ........'কী রে, পারবি তো?' আমি তো তক্ষুনি রাজি। মেজপিসির ক্ষীণ আপত্তি, 'উনি যদি রাজি না হন?'উনি অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ।" কনক দাশ সেকথার গুরুত্ব না দিয়ে বিজয়াকে তাঁর জন্য নির্ধারিত গান দুটি শেখালেন। "হাতমুখ ধুয়ে বসে গেলাম গান শিখতে। গান দুটো হল, 'বন্ধু রহ রহ সাথে' আর 'অশ্রুভরা বেদনা'। দুটোই বেশ কঠিন গান।" এরপর সুপ্রভা রায়, কনক দাশ ও বিজয়া গেলেন জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথের কাছে। কথা তুললেন সুপ্রভা রায়ই। রবীন্দ্রনাথকে বললেন তিনি, "কনকের খুব ইচ্ছে যে ওর গান দুটো আমার এই ছোট্ট ভাইঝিকে দিয়ে গাওয়ানো হয়"। রবীন্দ্রনাথ রীতিমতো বিস্মিত হয়ে সুপ্রভাকে বললেন, "তুমি বলছ কী টুলু? এইটুকুন মেয়ে ওই কঠিন সুরের গান গাইবে? আগে গান শিখতে হবে, তারপর তো গাইবে। কিন্তু তার আর সময় কোথায়?" সুপ্রভা জানালেন গান বিজয়ার তোলাই আছে এখন "আপনি যদি দয়া করে একবার শোনেন। আপনার পছন্দ না হলে কনকই গাইবে"। পরপর দুটো গান গাইলেন বিজয়া, শুনলেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর "গান শেষ হলে আমার মাথার উপর হাত রাখলেন, একটু কম্পিত কন্ঠে বললেন,' ঠিক আছে, আজ বিজয়াই গাইবে'।" রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন বিজয়া যেন তাঁর কাছে থেকে গান শেখে কিন্তু একে তো বিজয়া তখন নিতান্তই ছোট, তাছাড়া "শরীরও খুব সুস্থ নয়, একটু এদিক-ওদিক হলেই অসুখ করত। কাজেই বাবা-মা রাজি হলেন না।"

বিজয়ার গান শোনানোর সৌভাগ্য হয়েছিল সুকুমার রায়কেও। একবার যখন তাঁরা কলকাতায় এসেছিলেন তখনও সুকুমার রায় জীবিত ছিলেন। ওঁরা দু বোন একরাত কাটিয়েছিলেন গড়পারে। "সকালে ঘুম থেকে উঠেই মেজো পিসি আমাকে পিসেমশাইর ঘরে নিয়ে গেলেন। মানিকও আমার সঙ্গে সঙ্গে গেল। ঘরে ঢুকে দেখলাম উনি আধশোয়া অবস্থায় বই পড়ছেন। মানিককে দেখেই হাত বাড়িয়ে একেবারে বিছানার ওপর তুলে নিলেন। আমি মেজো পিসির হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, এবার আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন,'তুমি শুনেছি ভালো গাইতে পার। আমাকে একটা গান শোনাবে?'.......আমি দ্বিধা না করে গাইলাম। .........উনি চুপ করে শুনলেন। গান শেষ হবার পর মেজো পিসির দিকে তাকিয়ে বললেন,' এতটুকুন বয়সে এরকম কেউ গাইতে পারে আমার ধারণা ছিল না'।"

মধুকন্ঠ ছিল বিজয়ার। সঙ্গীত রসিক পিতা চারুচন্দ্র দাশ বিজয়ার গাওয়া ইংরেজি গান শুনে তাঁকে প্যারিসে পাশ্চাত্য সঙ্গীত শিখতে পাঠানোর চিন্তা করেছিলেন- "একটা ইটালিয়ান অপেরার গান, তাঁর নামটা এতদিন পর আর মনে পড়ছে না, এতে অর্কেস্ট্রার সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা ফ্লুট ছিল। অসাধারণ বাজনা আর গান। ইটালিয়ান ভাষা আমার জানা ছিল না, কিন্তু নকল করে ঠিক সেইভাবে উচ্চারণ করতাম। গানটা থামলে ফ্লুটটা চলত, সেই সুরটাও তুলে নিয়েছিলাম। গলা খুলে প্রায়ই গাইতাম, সঙ্গে সঙ্গে বাঁশির সঙ্গত।.....এক ছুটির দিনে উনি( বাবা) অফিসরুমে বসে আমার গান শুনতে পেলেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে শুনলেন, তারপর শোওয়ার ঘরে ঢুকে মা'কে দেখেই উত্তেজিত হয়ে বললেন, "মঙ্কু কী গান গাইছে শুনলে?" এই নিয়ে কথা বলতে বলতে চারুচন্দ্র বলেছিলেন, "নাঃ এভাবে আমি ওকে নষ্ট হতে দিতে পারি না।...... একমাত্র উপায় আছে, ওকে প্যারিসে পাঠিয়ে ওখানকার কনজারভেটারিতে ভর্তি করে ওর ভয়েস ট্রেনিং করা। ওর যা গলা, ট্রেনিংয়ের খুব বেশি প্রয়োজন হবে বলে মনে করি না।" চারুচন্দ্রের অকাল মৃত্যুতে সে ভাবনা বাস্তবায়িত হয়নি। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেও দখল ছিল বিজয়ার।

এতটাই ভালো গাইতেন তিনি যে পাটনায় থাকার সময় তাঁর জন্য যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষক নিযুক্ত করেছিলেন তাঁর বাবা, সেই ' কেষ্টবাবু' একটা সময়ের পর আর বিজয়াকে গান শেখাতে রাজি হন নি। বিস্মিত চারুচন্দ্র কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, "কারণ ও আমার চেয়ে অনেক ভালো গান গায়। ঠিক এরকম পরিস্থিতিতে আমাকে আগে কখনও পড়তে হয়নি। যা শেখাই ও তক্ষুনি সেটা তুলে নেয় আমার চেয়ে শতগুণ সুন্দর ও ভালোভাবে।" এই বলে "ভারী লজ্জা করে, ভারী লজ্জা করে" বলে তিনি চলে গিয়েছিলেন।

পাটনায় থাকতেই বিজয়ার পিয়ানো শেখার শুরু। "এই বাড়িতে এসেই আমি গৌরীদির কাছে পিয়ানো শিখতে আরম্ভ করি।" এই সময়েই 'নটীর পূজা' মঞ্চস্থ হলে নিতান্ত অল্পবয়সী বিজয়া তাতে নটীর ভূমিকা নিয়েছিলেন কারণ "আর কেউ নেই যে, গান আর নাচ দুটোই পারবে।" এর অল্প পরে আকস্মিক ভাবে মৃত্যু হল তাঁর বাবার- "বাবা ঊনত্রিশে ডিসেম্বর ১৯৩১-এ চলে গেলেন। আমার প্যারিসে গিয়ে ট্রেনিং নেওয়া, পিয়ানো শেখা- সব এক নিমেষে স্বপ্নের মতো অদৃশ্য হয়ে গেল।"

পাটনার বিশাল বাড়ি ছেড়ে তাঁরা চলে আসতে বাধ্য হলেন কলকাতায় তাঁর কাকা প্রশান্তচন্দ্র দাশের আশ্রয়ে। বিজয়া ভর্তি হলেন 'নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে'। সেখানে থেকেই ১৯৩৪ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আশুতোষ কলেজ থেকে ১৯৩৬ সালে আই এ পাশ করেন। এই সময় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের কন্যা অপর্ণা দেবীর কীর্তন দল 'ব্রজমাধুরী সঙ্ঘ'-তে কীর্তনও গেয়েছেন বিজয়া। ইংরেজি নিয়ে বি. এ পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ- তে ভর্তি হয়েও শারীরিক অসুস্থতার জন্য পড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। বেলতলা রোডের বাড়িতে থাকার সময়েই তিনি অনাদিকুমার দস্তিদারের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছিলেন। "বেলতলা রোড থেকে অনাদি বাবুর সঙ্গে আমার আলাপ। যখন ই রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেছি, ওঁরই তত্ত্বাবধানে করেছি"

এই সময়েই প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ছোট ভাই প্রফুল্লচন্দ্র মহলানবিশের উদ্যোগে হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি থেকে বিজয়া দাসের রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং হিমাংশু দত্তর গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। এছাড়া অতুলপ্রসাদের গানের রেকর্ডও তাঁর ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় সে সব রেকর্ডের প্রতি স্বয়ং শিল্পীরই কোনো ভালোবাসা ছিল না। "আজ অবধি আমার গাওয়া একটা গানও আমার কাছে নেই, ইচ্ছে করেই রাখিনি। তার প্রধান কারণ, গান গেয়ে এবং শুনে এত খারাপ লেগেছিল যে, রাখবার কোনো তাগিদ অনুভব করিনি।" তাঁর একক গাওয়া "স্বপ্নে আমার মনে হল" রেকর্ডটি শুনলে একথা কোনো ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। বিজয়ার গাওয়া আরও কিছু রেকর্ডও আছে।

নিজের গানের রেকর্ড নিজের কাছে না রাখলেও বিজয়া গাইতেন বড় ভালো। তিনি যখন বেথুন স্কুলের শিক্ষিকা এবং গান ও শেখাচ্ছেন তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার সিলেবাসে হঠাৎ মিউজিক যোগ করা হল। "ইউনিভার্সিটি থেকে অর্ডার এল যে, মিউজিক টিচারের যে কোনো একটা ডিগ্রি থাকতে হবে। মিসেস বি. এল. চৌধুরীর স্কুল থেকে তখন সবে 'গীতশ্রী' চালু হয়েছে। হয় 'গীতশ্রী' হতে হবে, নয় কোনও বড় ওস্তাদের কাছে থেকে অনুমোদনপত্র আনতে হবে তাতে তিনি লিখে দেবেন-গান শেখানোর পক্ষে আমি উপযুক্ত।"

তখন কলকাতার মস্ত বড় ওস্তাদ গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে যাবেন বলে ঠিক করে, কনক দাশের কাছে রাগাশ্রয়ী গান কিছুটা ঝালিয়ে নিলেন। সঙ্গীত বিদ্যালয়ে গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে বললেন পিলু রাগের গান গাইতে। "পিলুটা আমার অত্যন্ত প্রিয় সুর, কাজেই গান বাছতে সময় লাগল না। হিমাংশু কুমার দত্তের শেখানো গান 'হরিয়াওন কি আওয়াজ' গানটা গাইতে শুরু করে দিলাম। সেদিন কী হয়েছিল জানি না। পাছে চাকরি চলে যায় সেই ভয়েই কি না কে জানে, নিজের স্বাভাবিক সুন্দর গলায় গাইলাম।" গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় সেই গান শুনে তাঁকে সার্টিফিকেট তো দিলেনই, উপরন্তু বললেন, "এমন গলা নষ্ট হতে দিয়ো না। ভালো ওস্তাদ রেখে গান শেখো।" এরপর বিজয়া তালিম নিয়েছিলেন যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে।

ব্যক্তিগত জীবনে বিজয়ার মতো ব্যতিক্রমী সেকালে খুব বেশি কেউ ছিলেন না। "উনিশশো চল্লিশ সাল থেকে মানিকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা আরম্ভ হল। তখনও তাকে ঠিক প্রেম বলা চলে না। তখন আমি বেথুন স্কুলে চাকরি করি। তার ‌আগে কিছু দিন কমলা গার্লস স্কুলে চাকরি করেছিলাম"। পিসতুতো ভাই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসা থেকে। "রাত্রে আমি ও মানিক দুজনে বসে রেডিয়ো শুনতাম। তখন যুদ্ধ চলছে, বিদেশের সব জায়গা থেকে বাছাই করা ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকাল মিউজিক শোনাত।....... মানিকের সঙ্গে এইভাবে একসঙ্গে বসে মিউজিক শুনতে শুনতে কবে যে সেটা গভীর প্রেমে পরিণত হয়েছে, তা বলতে পারব না।...... ও আমার চেয়ে বয়েসে ছোট, তার ওপর আবার নিকট আত্মীয়। কাজেই বিয়ের প্রশ্নই ওঠে না। দুজনেই ঠিক করলাম কোনওদিন বিয়ে করব না।" বিয়ে অবশ্য হয়েছিল। একবার নয় দু'বার।

গান তো ভালো গাইতেনই বিজয়া, পাশাপাশি করেছেন অভিনয়ও। বাংলা চলচ্চিত্রের দিকপাল শিল্পী অহীন্দ্র চৌধুরী, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, জহর গাঙ্গুলি, পদ্মা দেবী প্রমুখের সঙ্গে তিনি 'সন্ধ্যা''শেষ রক্ষা' নামে দুটি ফিল্মে তিনি অভিনয়ের পাশাপাশি নিজের গলায় গানও গেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের কাহিনি নিয়ে ছবি "শেষ রক্ষা"-য় তিনি দু’খানি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিলেন- "স্বপ্নে আমার মনে হল" এবং "মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো""সন্ধ্যা" ছবিতে তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে গেয়েছিলেন "সময়টা নয় মন্দ"। এছাড়াও ছিল তাঁর একক গান। বাংলা চলচ্চিত্র ছাড়াও মুম্বাইতে 'জনতা', 'রেণুকা', 'রজনী' ইত্যাদি হিন্দি চলচ্চিত্রেও অভিনয়ের সঙ্গে গানও গেয়েছেন বিজয়া।

১৯৪৮র অক্টোবরের ২০ তারিখে সত্যজিৎ রায় ও বিজয়া দাশ রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করেন। এরপর অবশ্য ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসের তিন তারিখে ব্রাহ্মমতে তাঁদের বিয়ে হয়। অনেক পরে আত্মকথা লিখতে গিয়ে লিখেছিলেন, "আমাদের ভালোবাসার পরিণতি যে এত সুন্দর হবে, এ আমি কোনওদিন কল্পনা করতে পারিনি।"

জীবন তাঁর সত্যিই সুন্দর হয়েছিল। কিন্তু গান-অভিনয়ের জগত থেকে সরে গিয়ে সর্বতোভাবে সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রী হয়ে, নিজেকে অন্তরালে রেখে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন এই বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন নারী। যার গান শুনে স্বয়ং সাহানা দেবী বলেছিলেন, "....এ আমাদের সবাইকে ছাড়াবে", তিনিই সরে গেলেন সঙ্গীত পরিবেশনের প্রত্যক্ষ জগৎ থেকে। সরে গেলেন এমনভাবে যে জীবনের উপান্তে এসে আত্মকথায় তিনি অনায়াসে লিখলেন, "নিজের গানের সম্বন্ধে লিখে বৃথা সময় নষ্ট করছি, কারণ এখন আর গাইতে পারি না। উনি যতদিন ছিলেন, ততদিন ভালোই গাইতাম। ওঁর শেষ ছবি 'আগন্তুক'-এ উৎপল বাবুর গলায় যে গানটি উনি গেয়েছিলেন সেটা আমার কাছেই শেখা। গানটি হল 'হরিহরায় নমঃ কৃষ্ণ যাদবায় নমঃ'। আর অন্য গানটি 'বাজিল কাহার বীণা' আমিই শ্রমণাকে টেপ করে দিয়েছিলাম। উনি চলে গেলেন, সঙ্গে আমার গলাটিও নিয়ে গেলেন।" যদিও প্রত্যক্ষ গানের জগৎ থেকে বিজয়া অনেকদিন আগেই সরে এসেছিলেন। সর্ব সমক্ষে গাইতে তাঁর সমস্যা হচ্ছিল।

দুঃখে সুখে সম্পদে বিপদে বিশ্ববরেণ্য স্বামীর পাশে থেকে, তাঁর সহায় হয়ে এক আলো ঝলমলে জীবন কাটিয়ে ২০১৫-র জুন মাসের ২ তারিখে প্রয়াত হলেন বিজয়া রায়(দাশ)

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...