রবীন্দ্রনাথের গানের অনন্য শিল্পীঃ অজিতকুমার চক্রবর্তী

শান্তিনিকেতনের এক আন্তরিক ছবি আছে সীতা দেবীর স্মৃতিকথায়। সেই কবেকার শান্তিনিকেতন! ১৯১২ সালের। রবীন্দ্রনাথকে তখন সরাসরি অনুরোধ করা যেত গান শোনানোর জন্য। করেও ছিলেন সীতা দেবীরা। আর “তিনি পূর্বের মত বলিলেন, ‘ও এতক্ষণ এই পরামর্শ হচ্ছিল বুঝি?” অজিতকুমার চক্রবর্তীর খোঁজ করিলেন, কিন্তু তখন তাঁহাকে পাওয়া গেল না। রবীন্দ্রনাথ বলিলেন, “তা হলে আমার দ্বারা যতটা হয় তাই শোনো।”

অতিথিদের গান শোনাবার জন্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যাঁর খোঁজ করতেন তিনি অজিতকুমার চক্রবর্তী। ১৮৮৬ সালের ১৯ অগাস্ট কলকাতার সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা শ্রীচরণ চক্রবর্তী ও মা সুশীলা দেবী। তাঁদের আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার কোটালিপাড়া গ্রামের মঠবাড়িতে। অজিতকুমারের পিতা শ্রীচরণ ছিলেন সাহিত্যানুরাগী। সমকালীন কয়েকটি পত্রপত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। অজিতকুমার পিতার এই গুণটি পেয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন সুকন্ঠের অধিকারী এবং সুঅভিনেতা।

১৯০৪ সালে বি এ পরীক্ষা পাশ করে অজিতকুমার শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমে শিক্ষকতার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বন্ধু সতীশচন্দ্র রায়ে্র সূত্রেই তিনি শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে দৃষ্টিপাত না করেই এই দুই তরুণ যুক্ত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের আদর্শ বাস্তবায়িত করার কাজে। ছাত্রদের শিক্ষাদানের পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা, নাট্যাভিনয় ইত্যাদি সর্বপ্রকার কাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯১০ সালের মে মাসে অজিত কুমারের সঙ্গে আশ্রমকন্যা লাবণ্যলেখার বিবাহ হয়। এর চারমাস পরে অজিতকুমার ম্যাঞ্চেস্টার বৃত্তি নিয়ে বিলেত যান। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি কয়েকমাস পরেই দেশে ফিরতে বাধ্য হন।

বিলেতে থাকার সময় অজিত কুমার রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করে সেখানকার গুণীজনদের শুনিয়েছিলেন। কাজটি যে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার প্রমাণ “The Christian Life” পত্রিকাটিতে তাঁর সাক্ষাৎকার ভিত্তিক এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। বিদেশের পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ এবং শান্তিনিকেতন প্রসঙ্গে এটি প্রথম প্রকাশিত প্রতিবেদন। দেশে ফিরে অজিতকুমার শান্তিনিকেতনেই শিক্ষকতা এবং অন্যান্য কাজের সঙ্গে যুক্ত হন। এই সময় তিনি সন্ধ্যাবেলায় অন্যান্য শিক্ষকদের একত্র করে ইংরেজি সাহিত্য আলোচনা করতেন। এই আলোচনা শান্তিনিকেতনের ছোট ছোট ছাত্রদের কাছে হয়ে উঠেছিল পড়ানোর সমান। সেই ছাত্রদের অন্যতম প্রমথনাথ বিশী স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছেন, “আমাদের যাঁরা শিক্ষক তাঁদের তিনি শিক্ষকতা করছেন, এতে আমাদের বিস্ময়ের অন্ত থাকত না।”

অজিতকুমার তখন থেকেই সঙ্গীতে ও অভিনয়ে মনোনিবেশ করেছিলেন। ১৯১১-র মে মাসে রবীন্দ্রজন্মোৎসবের সময় “রাজা” নাটকে অজিতকুমার রাণী সুদর্শনার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। মনে রাখতে হবে, শান্তিনিকেতনের প্রথম পর্যায়ে নারীর ভূমিকায় পুরুষরাই অভিনয় করতেন। প্রমথনাথ বিশী জানিয়েছেন, “সে সময়ে প্রয়োজন হইলে ছেলেরাই মেয়ে সাজিত। স্ত্রী ভূমিকায় তাঁহারা কৃতিত্ব অর্জন করিয়াছিলেন তাঁহাদের মধ্যে সুধীরঞ্জন দাশ ও অজিত চক্রবর্তীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।” সীতা দেবীর স্মৃতিকথায় আছে একবার শান্তিনিকেতনের কাছে পারুলবনে বেড়াতে গিয়ে তাঁরা পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর দিনেন্দ্রনাথ সহ আরও কয়েকজন গিয়ে তাঁদের আবিষ্কার করেছিলেন। সেই প্রান্তরে গান শুনিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১১ সালের পুজোর ছুটির আগে ‘শারদোৎসব’  অভিনয়ে অজিতকুমার চক্রবর্তী হয়েছিলেন ঠাকুরদা। যেখানে ‘আজ ধানের খেতে রৌদ্রছায়ায়’, ‘আনন্দেরই সাগর হতে এসেছে আজ বান’, ‘আমার নয়ন ভুলানো এলে’ ইত্যাদি গানগুলি তিনি গেয়েছিলেন। সেই অভিনয়ের প্রত্যক্ষদর্শী সীতা দেবীর স্মৃতিতে উজ্জ্বল ছিল দুটি গান-‘দুইটি গানের কথা বিশেষ করিয়া মনে পড়ে, ‘আমার নয়ন ভুলানো এলে’ এবং ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ’।”

১৯১২ সালের বৈশাখ মাসে শান্তিনিকেতনে ‘রাজা ও রাণী’ অভিনয়ে অজিতকুমার বিক্রমদেব সেজেছিলেন। সেবার সন্ধেবেলায় সীতা দেবীদের সঙ্গে গল্প করতে বসে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “এবার অনেক নূতন গান লিখেছি, অজিতের কাছে শুনো।”

অজিতকুমার দীর্ঘ জীবনের অধিকারী ছিলেন না। কিন্তু তাঁর স্বল্পকালীন জীবনে প্রধানতম কাজ ছিল রবীন্দ্রসাহিত্যের মর্মব্যাখ্যা। তাঁর লেখা ‘রবীন্দ্রনাথ ও কাব্যপরিক্রমা’ অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। অজিতকুমারের গান আজ আর শোনার কোনও উপায় নেই। কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যাঁকে একটি চিঠিতে রাখীবন্ধন দিনের জন্য ‘আজি তোমার দক্ষিণ হাত/ রেখো না বাকি।/ এসেছি তোমারে, হে নাথ,/ পরাতে রাখী’- গানটি পাঠিয়েছিলেন, তাঁর কন্ঠের ওপর কবির যে নির্ভরতা ছিল তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

দশ বছর অধ্যাপনার পর মূলত আর্থিক সমস্যার জন্যেই অজিত কুমার শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হন। যদিও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অটুট ছিল। ১৯১৮ সালের ৭ পৌষ উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ অজিতকুমারকে আহ্বান করেছিলেন। কিন্তু তিনি তখন ইনফ্লুয়েঞ্জায় শয্যাশায়ী।

১৯১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ভোর চারটের সময় অজিতকুমার চক্রবর্তী প্রয়াত হন। ব্যথিত কবি শ্রাদ্ধবাসরে পাঠিয়েছিলেন একটি অনবদ্য গান- ‘কেন রে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়’।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...