সুচিত্রা মিত্র যখন সুচিত্রা মুখোপাধ্যায় তখনই তাঁর গানের প্রথম রেকর্ড বেরিয়েছিল। রেকর্ডের একদিকে ছিল ‘মরণ রে তুহুঁ মম শ্যাম সমান’ আর অপর পিঠে ‘হৃদয়ের একূল ওকূল দুকূল ভেসে যায়’। রেকর্ডটির প্রশিক্ষক ছিলেন আবদুল আহাদ। শুধু সুচিত্রা মিত্র নন, শান্তিদেব ঘোষ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ রবীন্দ্রসংগীতের দিকপালেরাও আবদুল আহাদের প্রশিক্ষণে রেকর্ড করেছিলেন। অথচ সংস্কৃতির পীঠস্থান আমাদের এই শহরে আজ তিনি বিস্মৃতপ্রায় এক নাম।
১৯১৮ সালে বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহীতে তাঁর জন্ম। আবদুল আহাদের পিতা আবদুস সামাদ ছিলেন স্কুল পরিদর্শক। মা হাসিনা খাতুন ছিলেন উদারমনা ও প্রগতিশীল। ছোটবেলায় আহাদ থাকতেন তাঁর দাদু খান বাহাদুর মোহাম্মদ সোলায়মানের কাছে। তাঁর বদলির চাকরি হওয়ায় আহাদ ছোটবেলায় চুঁচুড়া, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং ইত্যাদি নানা জায়গায় থেকেছেন।
ছোট থেকে এক উদার সাংস্কৃতিক আবহাওয়ায় তিনি বড় হয়ে উঠেছিলেন। অষ্টম শ্রেণীর পরীক্ষার পর রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে তাঁর সহপাঠী ছিলেন রাধিকামোহন মৈত্র এবং হীরেন ভাদুড়ি। টিফিনের অবসরে এই তিনজনে মিলে বসাতেন গানের আসর। স্কুলজীবন থেকে সংগীতের প্রতি তাঁর গভীর টান ছিল। এস. স. সি পাশ করার পর তিনি এলেন কলকাতায়। সিটি কলেজে পড়ার পাশাপাশি শুরু হল গান শেখার পালা। প্রথমে জমিরউদ্দিন খাঁ সাহেবের পুত্র বালির কাছে ও পরে ওস্তাদ মঞ্জুর কাছে তিনি শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নিয়েছিলেন। এই সময় কলকাতার কলেজের পড়া অসমাপ্ত রেখে তিনি পাবনা চলে গিয়ে সেখানকার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে আই এ পাশ করেন। পাবনা থাকাকালীন তাঁর দাদুর অসুস্থতার জন্য তাঁকে নিয়ে তখনকার ওয়ালটেয়ারে যান। সেটি ১৯২৮ সাল। সেই সময়ে তিনি সংবাদপত্রে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রসংগীত শেখার জন্য এক বিজ্ঞপ্তি দেখে আগ্রহী হন। তাঁর আবেদন গ্রাহ্য হওয়ায় সংগীত ভবনের প্রথম মুসলমান ছাত্র হিসেবে তিনি শৈলজারঞ্জন মজুমদার, শান্তিদেব ঘোষ প্রমুখ গুণীজনের কাছে গান শেখার সুযোগ পান। ১৯৪১ সাল পর্যন্ত তিনি শান্তিনিকেতনে ছিলেন।
শান্তিনিকেতনের সংস্কৃতিতে আহাদ গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। শুধু রবীন্দ্রনাথের গান শেখা নয়, সেখানের বহু গুণীজনের সংস্পর্শ তাঁর জীবনভাবনাকে অন্য মাত্রা দিয়েছিল। পরবর্তী জীবনে তিনি যে বাংলাদেশের রবীন্দ্রসংগীতচর্চায় অগ্রণীর ভূমিকা নিয়েছিলেন তার বীজ বপন হয়েছিল শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্বে আহাদ তাঁর সংস্পর্শে এসেছিলেন। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত কবির লেখা গানগুলি তাঁর তখনই শেখার এবং কবির সামনে গাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল।
১৯৪১ সালে রবীন্দ্রপ্রয়াণের পর তিনি মুম্বইতে গিয়ে সেখানকার রেডিয়ো স্টেশনে গান গাইতেন এবং রবীন্দ্রসংগীত শেখাতেন। কিন্তু মুম্বই তাঁর ভালো না লাগায় তিনি শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেন। এই সময়ে তিনি রাণী চন্দের সঙ্গে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে যুক্ত হন। গোয়েন্দা বিভাগের নজর তাঁর ওপর পড়ায় তিনি কলকাতায় চলে আসতে বাধ্য হন। বন্ধু সন্তোষ সেনগুপ্তের সাহায্যে গ্রামোফোন কোম্পানিতে তিনি রবীন্দ্রসংগীতের প্রশিক্ষক হিসেবে যুক্ত হন। আহাদের প্রশিক্ষণে সুধা মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র প্রমুখের রেকর্ড সেকালে যথেষ্ট আলোড়ন তুলেছিল। বিশ্বভারতীর সঙ্গে তখন পঙ্কজকুমার মল্লিকের মতভেদ হওয়ায় তিনি রেকর্ড করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আবদুল আহাদের উদ্যোগে পঙ্কজ মল্লিকের ‘সঘন গহন রাত্রি’ ও ‘তুমি কি কেবলি ছবি’ রেকর্ডটি প্রকাশিত হয় এবং খুবই জনপ্রিয় হয়। শান্তিদেব ঘোষের প্রথম রেকর্ড ও আহাদের প্রশিক্ষণেই হয়েছিল। শুধু রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড করানোই নয়, আহাদ বহু গানে সুরও দিয়েছিলেন। সুচিত্রা মিত্রের বাবা প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের গানে তিনি সুর দিয়ে রেকর্ড করান। নিজের সুরে তাঁর প্রথম আধুনিক গানের রেকর্ড ‘তুমি আমি দুই তীর’ ও ‘সে পথ ধরে আসনি তুমি’ এইচএমভি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। শিল্পী ছিলেন সন্তোষ সেনগুপ্ত। এই সময় তিনি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখের সঙ্গে আই পি টি এ-র আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন।
১৯৪৭-র দেশভাগ বাংলার সংস্কৃতিজগতে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। অনেক গুণীজন দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালে আবদুল আহাদও চলে যান ঢাকায়। ঢাকা বেতারে তিনি প্রযোজক হিসেবে যুক্ত হন। সেখানকার রেডিওতে একক গান ছাড়াও তিনি সমবেত গান প্রচার করতে শুরু করেন। এর জন্য হোসনাবানু, আঞ্জুমান আরা বেগম প্রমুখকে নিয়ে তিনি গানের দল গড়ে তোলেন। ১৯৫৬ সালে স্পেন সরকারের বৃত্তি নিয়ে তিনি স্পেন যান। দেশে ফিরে তিনি একাধিক গানের সুর দিয়েছিলেন। ঢাকা টেলিভিশনের সিগনেচার টিউনটিও ছিল তাঁরই তৈরি। রবীন্দ্রজন্ম শতবার্ষিকীর সময় তিনি ও রফিকুল ইসলাম টেলিভিশনে হাজার বছরের বাংলা গানের অনুষ্ঠান করিয়েছিলেন।
আবদুল আহাদ এই উপমহাদেশের রবীন্দ্রচর্চায় এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশ হবার আগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক কারণে রেডিওতে রবীন্দ্রসংগীত সম্প্রচারে নানান সমস্যার সামনেও আহাদ ছিলেন অবিচলিত। ১৯৬৮ সালে রেডিও এবং টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনে নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আহাদ প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন। এই বছরেই ‘শহীদ দিবস’ উপলক্ষে টেলিভিশনে এক অনুষ্ঠান করান আহাদ সাহেব। ১৯৭১-র স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির স্বরলিপি বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড থেকে তিনি অনুমোদন করিয়ে এনেছিলেন।
পঙ্কজকুমার মল্লিকের " সংগীত শিক্ষার আসর" কলকাতা বেতারে যেমন আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, তেমনই তরঙ্গ তুলেছিল আহাদ সাহেবের ঢাকা বেতারের "সংগীতশিক্ষার আসর"। বাংলাদেশের প্রথিতযশা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সনজীদা খাতুন লিখেছেন, " রেডিওতে ওঁর শেখানো ' জানি জানি, তুমি এসেছ এ পথে মনের ভুলে' গানটি মনপ্রাণ দিয়ে শিখেছিলাম। মনের ভুলে এসে পড়া অতিথিকে স্বাগতম জানাবার সুর-বাণীতে (' তাই হোক তবে তাই হোক, দ্বার দিলেম খুলে') যে আর্তবেদনা আছে, সে শুনতে পেয়েছিলাম গেয়ে গেয়ে শেখানোর ঐকান্তিক ভঙ্গিতে।" কীভাবে গান শেখাতেন আহাদ সাহেব? সুর আর বাণীর উচ্চারণ ধরে ধরে শিখিয়ে শব্দের মর্মার্থের সঙ্গে সুরের দোলাকে মিলিয়ে দিতে শেখাতেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথের গানের পাশাপাশি নজরুলগীতিতেও তাঁর দখল ছিল। প্রাক্ বাংলাদেশ পর্বে রবীন্দ্রবিরোধীতায় সে-দেশের যে কজন সংগীতশিল্পী প্রতিবাদী ছিলেন আহাদ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তবে সরকারি চাকরি করায় তিনি প্রতিবাদে সোচ্চার হতে পারেননি। এই না-পারা তাঁকে বেদনা দিত। ঢাকা বেতারে তিনি প্রযোজক- সুরকার হিসেবে যুক্ত ছিলেন। চাকরির বয়সসীমা অতিক্রম করে যাবার পরেও একাধিকবার তাঁকে বহাল করা হয়েছিল।
একাধিক সম্মাননায় ভূষিত আবদুল আহাদ সাহেব ১৯৯৪ সালের ১৫ মে প্রয়াত হন। তাঁর প্রয়াণে বাংলাদেশের রবীন্দ্রসংগীতচর্চার একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে।