রবীন্দ্রনাথের গানের অনন্য শিল্পীরা

যাঁর গান শুনে রবীন্দ্রনাথের ‘সকল গানের ভান্ডারী’ দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “ওকে আমার হাতে দাও- দেখবে এ রত্নকে পালিশ করে কেমন ঝকঝকে করে তুলি”- তিনি অবনীন্দ্রনাথ  ঠাকুরের দৌহিত্রী মেনকা দেবী। অবনীন্দ্রনাথ ও সুহাসিনী দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যা উমারাণীর বিবাহ হয়েছিল দ্বারকানাথ ঠাকুরের ভাগ্নের বংশধর নির্মলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ১৯১৭ সালে তাঁদের কন্যা মেনকার জন্ম। নির্মলচন্দ্র সঙ্গীতরসিক হওয়ায় ছোটবেলা থেকে  সুরের জগতে মেনকার বাস। ন বছর বয়েস থেকে গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ওস্তাদ বচ্চন মিশ্রের কাছে তালিম নেওয়া মেনকার গান শুনে মুগ্ধ দিনেন্দ্রনাথ তাঁকে গান শেখাতে আগ্রহী হয়েছিলেন। পরম আগ্রহে শিখেছিলেন মেনকাও।

 

শেখার পালা জোরদার হতেই হল রেকর্ড। ‘এসো এসো আমার ঘরে এসো আমার ঘরে’,'শেষবেলাকার শেষের গানে’, 'তোমার বীণা আমার মনোমাঝে’,'তোমার সুরের ধারা'- একের পর এক। গানের সঙ্গে এসরাজ বাজালেন স্বয়ং দিনেন্দ্রনাথ। মেনকা গান গেয়েছেন জোড়াসাঁকো বাড়িতেও। সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, 'মাঘ উৎসবের আসরে উপাসনার সঙ্গে সঙ্গে চলত দ্বিজেন্দ্রনাথ, গণেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের গান। ঐ গানের আসরে দেখেছি বিবিদিকে (ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী) পিয়ানো বাজাতে, অমিয়া কাকী (অমিয়া ঠাকুর) ও মিন্টুদি (মেনকা ঠাকুর), অনাদি দস্তিদার ও বাড়ির অন্যান্য ছেলেমেয়েদের গান গাইতে বা কোন না কোন বাদ্যযন্ত্র বাজাতে’। ১১ই মাঘের উৎসবে মেনকার গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র ক্ষেমেন্দ্রনাথ। তাঁর সঙ্গে বিবাহের পর মেনকা হলেন ঠাকুর বাড়ির বধূ।ক্ষেমেন্দ্রনাথের ঠাকুর্দা, রবীন্দ্রনাথের সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথ ছিলেন সঙ্গীতে নিবেদিতপ্রাণ। তাঁর সন্তানদের তিনি সঙ্গীতে উল্লেখযোগ্য তালিম দিয়েছিলেন। মেনকা সেই সুরের ধারায় মিলিয়ে নিয়েছিলেন নিজের সুর।

সুরেলা উদাত্ত গায়কী ছিল মেনকা দেবীর। বিয়ের পরেও গানের চর্চা অক্ষুন্ন ছিল তাঁর। এমনকি 'দিনেন্দ্র শিক্ষায়তন’ নাম দিয়ে জোড়াসাঁকো বাড়িতেই গান শেখাবার স্কুলও করেছিলেন তিনি। এই স্কুল প্রতিষ্ঠার অন্তরালে আছে একটি কাহিনি। জোড়াসাঁকো বাড়ির যে অংশে তাঁরা থাকতেন সেখানে সকাল সন্ধে বাইরে থেকে ভেসে আসত জনৈকা প্রতিবেশিনীর বেসুরো রবীন্দ্রসঙ্গীত। সেই গান শুনে বিরক্ত ক্ষেমেন্দ্রনাথ মেনকাকে অনুরোধ করেন গানের স্কুল খুলে মেয়েটিকে সঠিক গান শেখাতে।

রবীন্দ্রনাথের কাছে গান শেখার সুযোগ পাননি মেনকা। রবীন্দ্রনাথের গানে তাঁর দীক্ষা দিনেন্দ্রনাথের কাছে। দিনেন্দ্রনাথকে স্মরণ করেই তিনি তাঁর গানের স্কুলের নাম রেখেছিলেন 'দিনেন্দ্র শিক্ষায়তন’। দিনেন্দ্রনাথ ছাড়াও তিনি সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অনাদি কুমার দস্তিদার, শৈলজারঞ্জন মজুমদার প্রমুখের কাছে রবীন্দ্রনাথের গান শিখেছেন। ঠাকুর বাড়ির গানের ধারায় মেনকা ছিলেন কিছুটা ব্যতিক্রম। কেননা তিনি গান গাইতেন হারমোনিয়াম বাজিয়ে। যে যন্ত্রটির প্রতি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিরূপ। উদাত্ত কন্ঠের সঙ্গে নিখুঁত সুরের মেলবন্ধনে মেনকা মুগ্ধ করেছেন শ্রোতাদের। রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়াও দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ,জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সহ ঠাকুর বাড়ির অন্যান্য সঙ্গীত রচয়িতাদের গানও তিনি পরিবেশন করেছেন, প্রশিক্ষণও দিয়েছেন।

 এই শহর, এই রাজ্যসীমার বাইরে ওড়িশায় ঠাকুর পরিবারের জমিদারির যে অংশ ছিল সেখানে অর্থাৎ কটকে এবং ভুবনেশ্বরে মেনকা বাঙালিদের পাশাপাশি ওড়িয়াভাষীদেরও রবীন্দ্রনাথের গান শিখিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গানকে তিনি এভাবেই সর্বভারতীয় রূপ দেবার চেষ্টা করে গিয়েছেন। যা সেকালে একালে সর্বকালেই বিরল।

মেনকা ঠাকুর যুক্ত ছিলেন আকাশবাণীর সঙ্গে। ‘বৈতানিক’, ‘পারাণি’ এবং ‘বঙ্গীয় সঙ্গীত কলাকেন্দ্র’ ইত্যাদি সংস্থার সঙ্গেও ছিল তাঁর যোগ। 'ঠাকুর বাড়ির গান’ নামে ঠাকুর পরিবারের অনেকের গানের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকলনও তিনি করেছিলেন।

ক্ষেমেন্দ্রনাথ ও মেনকা ছিলেন নিঃসন্তান। ক্ষেমেন্দ্রর মৃত্যুর পরেও মেনকা জোড়াসাঁকোতেই থাকতেন। ঠাকুরবাড়ি অধিগ্রহণের পর তিনি বিডন স্ট্রিটে চলে যান। মেনকা ঠাকুর বাড়ির ছোটদের কাছে দিঠাই নামে পরিচিত ছিলেন। ছোটদের নিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন নাটক করাতেন। যতদিন ক্ষমতা ছিল রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে ও মাঘোৎসবে তিনি জোড়াসাঁকোয় আসতেন।

জীবনের শেষ পর্যায়ে পঞ্চকন্যার গানের রেকর্ডে মেনকা গেয়েছিলেন সেই পুরোনো গান ‘এসো  আমার ঘরে এসো আমার ঘরে'। সুরেই ছিল তাঁর জীবন গাঁথা। ১৯৯২ সালে মেনকা ঠাকুরের প্রয়াণে একটি অধ্যায়ের অবসান ঘটে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...