হেমন্তর বয়স তখন বছর পনের। পড়েন, ক্লাস নাইনে। বজম বন্ধু, পরবর্তীকালের বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সুভাষ কিন্তু এই বয়সেই বেশ করিৎকর্মা। সাংস্কৃতিক লোকলস্করদের সঙ্গে তাঁর এই বয়সেই খানিক যোগাযোগ-টোগাযোগ রয়েছে; বেশ খবর-টবরও রাখেন। তা, তিনি একদিন কোত্থেকে যেন হেমন্তর বাড়িতে হাজির হলেন প্রায় ঝড়ের মতো। এসেই বললেন, চটপট রেডি হয়ে নে, চল। হেমন্ত তো অবাক! চল, মানে? কোথায়? সুভাষ বললেন, নো কোশ্চেন, গেলেই জানতে পারবি। হেমন্ত হাড়ে হাড়ে চেনেন সুভাষকে, কবি মানুষ, শুরুতে যখন রহস্য ভাঙেননি, মধ্যিখানেও ভাঙবেন না। অগত্যা হেমন্তকে রেডি হতে হল। সঙ্গ নিতে হল।
হ্যাঁ, প্রায় কতকটা এভাবেই সুভাষ মুখোপাধ্যায় ১৯৩৫-এর এক সকালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে টেনে নিয়ে গেলেন আকাশবাণী ভবনে। হেমন্ত দেখলেন, সেখানে চলছে গানের অডিশন। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। বন্ধু হিসেবে সুভাষ যে সারপ্রাইজ দিলেন, তার তুলনা নেই। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও প্রতি-ভালোবাসা ঝলমল করে উঠল সেই হাসিতে। বয়স পনের ঠিকই, কিন্তু গান গাওয়ার ব্যাপারে কোন ভয়ডর নেই হেমন্তর। কারণ, গান তাঁর প্রাণের শান্তি, ভালোবাসার ধন। সঙ্গীতের রস-রূপ-রঙ আজন্ম তাঁর অন্তরে। মাত্র বছর দেড়েক ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ-সাহেবের শিষ্য ফণিভূষণ গাঙ্গুলিমশাইয়ের কাছে তালিম নিয়েছেন। তারপর গাঙ্গুলিমশাই হঠাৎ একদিন মারা গেলেন। আর গুরুর কাছে নাড়া বেঁধে গান শেখা হল না। বাকিটুকু আত্মবিশ্বাসী সাধকের একক সাধনা। সেই সাধনায় সিদ্ধও হলেন। এবার সেই সিদ্ধি প্রমাণ করার পালা। ফলে, অডিশনে এমন জমিয়ে গাইলেন যে, প্রথম অডিশনেই সিলেক্ট হয়ে গেলেন। আকাশবাণীর গায়ক তালিকায় ঠাঁই পেল, 'হেমন্ত মুখোপাধ্যায়'- নামটি। এবং সেইসঙ্গে মুশকিলও জমে উঠল জীবনে…
মুশকিল হল তখনই, যখন হেমন্তর রেডিওতে চান্স পাওয়ার খবরটা বাবার কানে উঠল। হেমন্ত আশা করেছিলেন খবরটা শুনে বাবা হয়তো খুশিই হবেন। কিন্তু, না। ছেলেকে হতাশ করে বাবা খুশি তো হলেনই না; বরং বেজায় রকমের ক্ষেপে গেলেন। ভদ্রলোকের ছেলে হয়ে রেডিওতে গান গাইবে! অসম্ভব! গান শিখেছ ঠিক আছে, কিন্তু বাইরে গান গেয়ে গেয়ে গোল্লায় যাবে--ওটি হচ্ছে না ! বাবা দাবড়ালেন ঠিকই, ছেলের জেদও কম নয়--ফলে, তিনি মুষড়ে পড়লেন না। দরকার হলে বাবাকে লুকিয়ে রেডিও স্টেশনে যাবেন! তবু, গাইবেন! কিন্তু, এ নেহাতই ছেলেমানুষি ভাবনা। সরকারি ব্যাপার, তার ওপর পারফরম্যান্স; লুকিয়ে চুরিয়ে কিছু হয় নাকি! তাই সরকারি নিয়মে আকাশবাণী থেকে তালিকা ধরে একদিন এলো হেমন্তর গান গাইবার পালা। ফলে, চিঠি এলো বাড়িতে। আবার শুরু তুলকালাম। বাবা কিছুতেই ছেলেকে গান গাইতে যেতে দেবেন না। ছেলেও নাছোড়বান্দা। শুরু হল মান-অভিমান জেদাজেদির তীব্র পালা। মধ্যিখানে এলেন তৃতীয়পক্ষ। নরম হতে হল এক পক্ষকে। নিমনরম হলেন, বাবা। সে অনেক বোঝানো-সোঝানোর পর। যাহোক, অনুমতি মিলল।
সেসময় আকাশবাণীর সঙ্গীত-শিক্ষক ছিলেন শৈলেশ দত্তগুপ্ত। অনুষ্ঠানের আগে হেমন্তকে একদিন ডেকে পাঠালেন তিনি। জানতে চাইলেন, প্রোগ্রামে কোন্ গান গাইবেন? তিনি ট্রেনার, তাঁকে তো জানতে হবে, রিহার্সাল দেওয়াতে হবে। হেমন্তর খুব ভাল লাগে কমল দাশগুপ্ত'র সুর। তাই ভাবতেই হল না, দুম করে বলে বসলেন, কমল দাশগুপ্তর ‘তোমার হাসিতে জাগে’ গানটি গাইব। কিন্তু, শৈলেশবাবু জানালেন, সে কী করে হয়; সে গান তো কমলবাবু নিজে গেয়ে রেকর্ড করেছেন। তখন হেমন্ত জানালেন যে, সুরটা তাঁর বড় প্রিয়, তাহলে সুরটা নেবেন, কথাটা নতুন করে লিখিয়ে নেবেন। শৈলেশবাবু বললেন, বেশ। তাই করে দেখ, দেখি কেমন দাঁড়ায়…
তখন হেমন্ত ছুটলেন সুভাষের কাছে। গুনগুনিয়ে সুরটি শুনিয়েই বললেন, এতে কথা বসিয়ে একটা গান লিখে দে দেখি চটপট…! সুভাষ কবি মানুষ। সুরকে কথায় বাঁধতে অসুবিধে হল না। লিখলেন, ‘আমার গানেতে এলে নবরূপে…’। তারপর? তারপর আর কি...সেই গানের মধ্য দিয়েই সারা দেশ রেডিওতে প্রথম মুগ্ধ হয়ে শুনল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠ… শুরু হল কিংবদন্তীর পথ চলা, গড়ে উঠল ইতিহাস…