দোড়গোড়ায় আরও একটা নববর্ষ। ১৪২৬। আর এই 'নববর্ষ' শব্দটির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে হালখাতা। দোকানে দোকানে মানুষের ঢল নামে এই হালখাতার কারণে। সব থেকে বেশি যে দোকানে ভিড় থাকে সেটি হল জুয়েলারি হাউজ। আর এর থেকেই বোঝা যায় সোনার গয়নার কদর ঠিক কতখানি। দোকানে ধার বাকি থাক বা না থাক একবার অন্তত কোনও জুয়েলারি হাউজ থেকে গয়না বানালেই পয়লা বৈশাখের দিনে নিমন্ত্রণ পাক্কা। ক্যালেন্ডার আর মিষ্টির প্যাকেট ঘরে আসবেই আসবে।
ভারতীয়দের কাছে সোনা শুধু ঐশ্বর্য নয়, সোনা হল স্বচ্ছতা ও সৌন্দর্যের প্রতীক। সোনা স্বয়ং ব্রহ্মার অংশবিশেষ এবং লক্ষ্মীর অবস্থান ধনসম্পদে। তাই সোনার গয়না পায়ে পরার চল নেই আমাদের সমাজে। মনু সংহিতায় লেখা আছে কোনও অনুষ্ঠানে গয়না পরা বাধ্যতামূলক। হিন্দু ধর্মে সোনা একটি পবিত্র ধাতু।
বহু যুগ আগে জিনিসপত্র বিকিকিনির মাধ্যমও ছিল সোনা। পাশাপাশি জমিদারের পাঞ্জাবিতে হিরে খচিত সোনার বোতাম, গলার হার, হাতের ব্রেসলেট, আংটি সবই গায়ে চড়িয়ে রাখতে অভ্যস্ত ছিলেন জমিদার বাবুরা। এমনকী তাঁদের হাতের লাঠির মাথাতেও থাকত সোনার মোড়ক। গিন্নির পানের বাটা থেকে শুরু করে সীতাহার, স্বর্ণচূড়, বালা, ঝুমকো কানের সবেতেই সোনার জয়জয়কার। আজও সোনার এই আধিপত্য বহাল। এর ভাঙন সম্ভব নয়।
হাজার হাজার বছর আগের সিন্ধু নদের তীরে গড়ে ওঠা সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ বলে দিয়েছিল তখনকার মহিলারাও গয়না পরতে অভ্যস্ত ছিলেন। মোটা পাতের ঢালাই করা গয়নার উপর পশু, গাছ এমনকী যৌন অঙ্গের মোটিফও আঁকা থাকত সেই সময়। অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মহিলারা নানা ধরনের গয়নার উল্কি এঁকে রাখতেন নিজেদের শরীরে। সোনা, ব্রোঞ্জ, লোহা সবই প্রাধান্য পেত সেই সময় গয়নার উপকরণ হিসেবে। পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে গয়নার ধরন বিভিন্ন সম্প্রদায় এবং তাদের সংস্কৃতিকে নির্দেশ করত।
সোনা কিংবা রূপোর ধাতুর উপরে নানা ধরনের কারুকাজ সমৃদ্ধ গয়না বানানো প্রথম শুরু হয় ইজিপ্টে। এই গয়না তৈরিই অনেকের পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক সময়।
মধ্যযুগে গয়নার প্রতি মানুষের আগ্রহ আরও বাড়তে থাকে। গয়নার ডিজাইনে আসে বিভিন্নতা। এই সময় Clets নামে এক জাতির আবির্ভাব হয়। তারা তাদের নিজস্ব ঘরানায় বানাতে শুরু করে নানা ধরনের গয়না। তাদের একটা নিজস্ব কালচার গড়ে তোলে যার নাম 'কেলটিক কালচার'। নবজাগরণের সময়ে গয়নার প্রতি মানুষের কদর আরও বাড়তে থাকে। এই সময় সোনার পাশাপাশি হিরেও হয়ে উঠতে শুরু করে সমান জনপ্রিয়। সেই সময় থেকে আজও গয়না মানুষের মনের ঘরে বিরাজ করে।
বিভিন্ন অঙ্গের জন্য রয়েছে নানা ধাঁচের গয়না। হার, কানের দুল, চুড়ি, বালা, বাজুবন্ধ, ব্রেসলেট, আংঠি, বোতাম, নাকছাবি, মান্তাসা এই সব নিয়ে গয়নার বিশাল সাম্রাজ্য। সোনার গয়নার রঙেও আছে বৈচিত্র। হোয়াইট গোল্ড, ইয়েলো গোল্ড, রোজ গোল্ড, লাইম গোল্ড, ব্রোঞ্জ গোল্ড রঙের সোনার গয়না রয়েছে। যার যেমন রঙ পছন্দ সে সেটাই বেছে নেয়। আজকাল রুপো দিয়েও অত্যাধুনিক ডিজাইনের গয় না তৈরি করছেন গয়ানার কারিগরেরা। প্রসঙ্গত, জুয়েলারি ডিজাইনিং-এর উপর পাঠও দেওয়া শুরু হয়েছে দিকে দিকে। তাতে সোনা, রুপো, তামা, ব্রোঞ্জের গয়নায় আসছে অভিনবত্ব। আর তাতেই স্টাইল স্টেটমেন্টে আসছে ভিন্ন রং। মহিলা এবং পুরুষ উভয়েই গয়নার প্রতি আগ্রহী। শুধু ডিজাইনে থাকে বিভিন্নতা। আর কোনও পুরুষ তো আর মান্তাসা পরেন না, ফলে যার জন্য যেটা উপযোগী সেটা সে সুযোগ বুঝে বেছে নেন।
মোদ্দা কথা গয়না মানবজাতির ভালবাসার ধন। বাঙালি মহিলাদের গয়না কেনার প্রতি আগ্রহ আরও খানিকটা বেড়ে যায় চৈত্র মাসে। কারণ এই সময়ে গয়নার দাম খানিকটা কমে। আর হালখাতার দিনে ব্যাগের ওজন অনুযায়ী গয়নার দোকানে টাকা জমা দিয়ে শুরু হয় আরও একখানি হার বা চুড়ি গড়িয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা। সেই দিন আসন্ন। তাই মহিলা মহলের উদ্দেশ্যে আবেদন প্ল্যানটা বানিয়ে নিন চটপট। কর্তার কাছে বায়নাটাও সেরে নিন আজই।