হাওড়ার আমতার অন্যতম বিখ্যাত কালী হলেন খড়িয়পের শ্মশানকালী। অগ্রহায়ণ মাসের অমাবস্যায় অর্থাৎ মার্গশীর্ষ অমাবস্যায় পূজিতা হন খড়িয়পের শ্মশানকালী। খড়িয়পের বিখ্যাত বসু পরিবারের ধর্মপ্রাণ জমিদার বৈদ্যনাথ বসু স্বপ্নে দেবী কালীর রূপ দর্শন করেছিলেন। স্বপ্নাদেশে শুরু হয়েছিল খড়িয়পের শ্মশানকালীর পুজো। বলে রাখি, এই বসু পরিবারেই স্বামী বিবেকানন্দের এক বোনের বিবাহ হয়েছিল। সেই সুবাদে খড়িয়পে স্বামী বিবেকানন্দের পদধূলি পড়েছিল একাধিকবার।
বৈদ্যনাথ বসু স্বপ্নে যে রূপে দেবীকে দর্শন করেছিলেন, সেই ভাবেই তিনি মায়ের মূর্তি তৈরি করিয়েছিলেন। সেই রূপেই দেবীর আরাধনা শুরু হয়েছিল। স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পরই বৈদ্যনাথ বসু এবং কাশীনাথ বসু মায়ের পুজো শুরু করেন। তারপর থেকে বংশপরম্পরায় এই পুজো হয়ে আসছে।
দেবী দ্বিভুজা। তিনি বিরাজ করেন উলঙ্গ শিবের উপরে। দেবীর গাত্রবর্ণ গাঢ় নীল। দেবীর একটি হাতে থাকে নরমুণ্ড এবং অন্য হাতে থাকে কারণ পাত্র। মন্দিরের গর্ভগৃহে তিনি তাঁর দুই সহচরী ডাকিনী ও যোগিনী-সহ অবস্থান করেন। ফি বছর অগ্ৰহায়ণের অমাবস্যায় শ্মশানকালীর পুজো হয়। খড়িয়পের বারোয়ারী শ্মশান কালী পুজো কমিটি এই পুজোর আয়োজন করে।
এই পুজোকে ঘিরে রয়েছে এক কাহিনি। প্রায় ২০০ বছর আগে হাওড়ার আমতার খড়িয়প গ্রামে মহামারি শুরু হয়। গ্রামে মড়ক লাগে। উদ্ধার পেতে গ্রামবাসীরা দেবী মহামায়ার প্রার্থনা করতে শুরু করেন। জমিদার, বসু পরিবারে বৈদ্যনাথ বসুকে স্বপ্নাদেশ দেন দেবী। শ্মশান কালী রূপে তাঁর আরাধনা করতে বলেন। স্বপ্নে দেবী জানিয়ে দেন, অগ্রহায়ণ মাসের মার্গশীর্ষ অমাবস্যায় দেবীর পুজো করতে হবে। দেবী খড়িয়প গ্রামকে চিরকাল রক্ষা করবেন। তখন থেকে খড়িয়প গ্রামে শ্মশান কালীর পুজো শুরু হয়। এ বছর সেই পুজো ২০১ বছরে পদার্পণ করল। আজও বংশ পরম্পরায় এই পুজোর করে আসছেন তদানিন্তন সময়ের ব্রাহ্মণ ও প্রতিমা নির্মাণ শিল্পীরা। একই নিয়মে দেবীর পুজো হচ্ছে আজও। বসু পরিবারের পুজো এখন আর পারিবারিক পুজো হিসাবে আটকে নেই। ১৯৮০ সাল থেকে সর্বজনীনভাবে খড়িয়প গ্রামে দেবী শ্মশান কালীর আরাধনা হয়ে চলেছে।
খড়িয়পের জাগ্রত মা কালীর প্রতিমূর্তি রাজস্থানের অম্বর প্যালেসে রাখা রয়েছে। মোঘল সেনাপতি মানসিংহ আমতা থেকে এই মূর্তির নিয়ে গিয়েছিলেন।
স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী শ্মশান কালীর ধ্যান মন্ত্রে পুজো হয়। সারারাত ধরে পুজো চলে। পুজোর পরদিন রাতে পার্শ্ববর্তী পুকুরে দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি নিরঞ্জন করা করা হয়। পুজো উপলক্ষ্যে মেলা বসে। পুজোকে কেন্দ্র করে ১০ দিনের মেলা বসে। মেলায় যাত্রাপালা, লোকগান, বাউল-সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। হিন্দু, মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ পুজোয় অংশগ্রহণ করেন। শ্মশান কালীর পুজোকে কেন্দ্র করে মেতে ওঠে খড়িয়প গ্ৰাম।