জ্ঞানবিহার নালন্দা

পৃথিবীর বিভিন্ন শহর থেকে পন্ডিতরা ভারতের এই বিশ্ব বিদ্যালয়ে পাঠ নিতে আসতেন। যুক্তি- তর্ক- বোধে ধারালো হয়ে উঠতেন এখানেই।

এই উক্তি বিখ্যাত চীনা দার্শনিক হিউয়েন সাং-এর। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে।

সপ্তম খ্রিস্টাব্দে নালন্দায় এসেছিলেন তিনি। একসময় কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পারস্য, তুরস্ক থেকে ছাত্ররা আসত এই ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে।

অধুনা বিহারএর রাজধানী পাটনা থেকে ৫৫ মাইল দক্ষিণ পূর্বে খ্রিষ্টীয় ৪২৭ অব্দ থেকে ১১৯৭ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে নালন্দা মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

১২ হেক্টর জমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা লাল ইঁটের ভগ্নস্তূপ দেখলে আন্দাজ করা দুষ্কর হয় এই জায়গার অতীত গৌরব।

৫০০ জন বৌদ্ধ অনুরাগী ব্যবসায়ী যৌথ উদ্যোগে দশ কোটি স্বর্ণ মুদ্রা ব্যয় করে এই ভূমি ক্রয় করেন। গৌতম বুদ্ধ কে উপহার দেন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারের জন্য।

ধারনা করা হয় সম্রাট শক্রাদিত্যের (অপর নাম কুমারগুপ্ত, রাজত্বকাল ৪১৫-৫৫) রাজত্বকালে নালন্দা বিহারের প্রতিষ্ঠা ঘটে। মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় আরও কিছু পরে। পরে সম্রাট হর্ষবর্ধন ও পাল বংশের রাজারাও এই মহাবিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষকতা করেন।

নালন্দা শব্দের অর্থ ‘দানে অকৃপণ’।

মহাবিহার চত্বরটি ছিল লাল ইঁটে নির্মিত।  ২০০৬ সালে ভারত, চীন, সিঙ্গাপুর, জাপান ও অন্যান্য কয়েকটি রাষ্ট্র যৌথভাবে এই সুপ্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়টির পুনরুজ্জীবনের প্রকল্প গ্রহণ করে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম স্থির হয়েছে নালন্দা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়। এটি প্রাচীন নালন্দা মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষের নিকট নির্মিত হবে।

 

পরবর্তীতে পাল রাজাদের আমলে শিক্ষা-দীক্ষায়  অগ্রগতি লাভ করে নালন্দা।

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে হিউয়েন সাং তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে বহু তথ্য লিখে গিয়েছেন। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্থান-পতন সম্পর্কে জানা যায়।

তিনি যখন বিশ্ব বিদ্যালয় পরিভ্রমণ করেন তখন প্রায় ৬ হাজার ছাত্র পড়ত। প্রায় ১০০ শ্রেণীকক্ষ এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসন ব্যবস্থাসহ সে সময় প্রায় দুই হাজার শিক্ষক এবং ২০ হাজার শিক্ষার্থীর পড়াশোনার ব্যবস্থা ছিল।

বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ছাত্রদের কলতানে ভরে থাকত নালন্দার ক্যাম্পাস। বিতর্ক ও আলোচনার জন্য আলাদা কক্ষ ছিল।

তবে নালন্দার অন্যতম গৌরব ছিল এখানকার গ্রন্থাগার।

 পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায়  নালন্দায় গড়ে উঠেছিল পুস্তকের এক বিশাল এক সমৃদ্ধ সংগ্রহ।  ধারণা করা হয়, সেখানে প্রায় নব্বই লক্ষের বেশি বই ছিল। গ্রন্থাগার তিনটি পৃথক দালানে বিস্তৃত ছিল। এদের নামকরণ করা হয় রত্নসাগর, রত্নদধি এবং রত্নরঞ্জক নামে। এদের মধ্যে রত্নদধির ছিল প্রায় নয়তলা বিশিষ্ট ভবন। এসব গ্রন্থাগারে শুধুমাত্র ধর্মভিত্তিক পুস্তকের পাশাপাশি ব্যাকরণ, ন্যায়শাস্ত্র, সাহিত্য, জ্যোতিষবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ভেষজবিদ্যা সংবলিত গ্রন্থাবলিও ছিল।

 

তৎকালীন নালন্দায় শিক্ষা ছিল সকলের জন্য উন্মুক্ত। শ্রেণী, লিঙ্গ, বর্ণগত বৈষম্য সেখানে ছিল না। হিউয়েন সাংয়ের বক্তব্য অনুসারে জানা যায়, তখন প্রতি ১০ জনের মধ্যে দুজন নালন্দায় শিক্ষার সুযোগ পেত। আর তা ছিল সম্পূর্ণ ভাবে মেধার ভিত্তিতে। নালন্দাকে তাই পৃথিবীর প্রাচীনতম ‘আধুনিক’ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।

এই গৌরবের ধ্বংস কিন্তু এক দিনে হয়নি। ধাপে ধাপে ক্ষয়ে ক্ষয়ে একদিন ভেঙে পড়ে। নালন্দা ধ্বংসের কারিগর হিসেবে ইতিহাসে কলঙ্কিত হয়ে আছেন আফগান শাসক বখতিয়ার খলজি। ত্রয়োদশ শতকে উত্তর পূর্ব ভারত আক্রমণ করেন। সেই সময় নালন্দা, বিক্রমশিলা এবং ওদন্তপুরী সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেন। পারসি ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরাজ তাঁর তবাওয়াক্ত-ই-নাসিরি গ্রন্থে লিখেছেন কয়েকশো বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এবং ছাত্রকে জীবন্ত দগধ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী গ্রন্থাগারে আগুন লাগানো হয়। সমস্ত বই, পাণ্ডুলিপি, সংগ্রহ অসহায় ভাবে শেষ হয়ে যায় লেলিহান শিখায়। সেই আগুন সহজে নেভেনি। কয়েকমাস ধরে জ্বলেছিল।

তবে বখতিয়ার একেবারে থামিয়ে দিতে পারেননি নালন্দার প্রাণশক্তিকে।

তিব্বতী সন্ন্যাসী ধর্মাস্ফন ১২৩৫ খ্রিস্টাব্দে নালন্দায় আসেন। চারদিকে তাণ্ডবের চিন্হ। তারই মাঝে এক দৃশ্য তাঁকে থামিকে দেয়। দেখেন নব্বই ছোঁয়া এক অধ্যাপক ছাত্রদের পাঠ দিচ্ছেন। তাঁর সামনে তন্ময় হয়ে বসে সত্তর জন জ্ঞান ভিক্ষু। ভূত গ্রস্থ নালন্দায় একা অবিচল সেই অধ্যাপকের নাম রাহুল শ্রীভদ্র।

অতীত গৌরবের শিখাটি ম্লান হয়েছে বটে, কিন্তু একেবারে নিভিয়ে দেওয়া যায়নি।

একদা বিশ্ব সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূত গ্রস্থ স্তূপে দাঁড়িয়ে রাহুল শ্রীভদ্র যে প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন সেই পথে আজও জেগে আছে নালন্দা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...