উনিশ শতকের আলোক উজ্জ্বল এক বাঙালি

ছোট থেকেই তিনি অন্যরকম। তাঁর বয়সী শিশুরা যখন খেলায় ব্যস্ত তখন তিনি ব্যস্ত থেকেছেন বই নিয়ে। মামা দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ খুব ভালোবাসতেন। তাঁর ছায়াতেই বড় হয়ে ওঠা।

  জীবনের শুরুর প্রথম পর্যায়টা এরকমই ছিল তাঁর। শিবনাথ ভট্টাচার্য, ওরফে শিবনাথ শাস্ত্রী। উনিশ শতকের অন্যতম আলোক উজ্জ্বল বাঙালি।

 ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ জানুয়ারি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার চাংড়িপোতা গ্রামে মাতুলালয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হরানন্দ ভট্টাচার্য, মা কামিনী ভট্টাচার্য।

এমএ পরীক্ষায় ভালো ফল লাভ করায় তিনি ‘শাস্ত্রী’ উপাধি পেয়েছিলেন।

অতঃপর পারিবারিক পদবি ভট্টাচার্যের পরিবর্তে তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়
‘শাস্ত্রী’ উপাধি। ‘শিবনাথ ভট্টাচার্য’ পরিচিত হয়ে উঠতে থাকেন ‘শিবনাথ শাস্ত্রী’ নামে।

ছোট থেকে উদার মানসিকতার শিক্ষা পেয়েছিলেন মামার সূত্রে। যুক্তিবাদকে ধারণ করেছিলেন জীবনে। সংস্কৃত কলেজিয়েটের ছাত্র হিসেবে যোগ দিলেন তখন সেই যুক্তিবাদ যেন আরও প্রবল হয়ে উঠল সেই যুক্তিবাদ। আর সেই টানেই সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়লেন বিভিন্ন আন্দোলনে। সমকালকে অস্বীকার করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাঁকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল ব্রাহ্ম আন্দোলন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন- উনিশ শতকের শিক্ষিত বাঙালির পক্ষে ব্রাহ্ম আন্দোলন থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা সম্ভব হয়নি।

শিবনাথ শাস্ত্রী ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়লেন ব্রাহ্ম আন্দোলনের সঙ্গে। ব্রাহ্মণ সন্তান  উপবীত ও মূর্তিপূজা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ‘বেহ্মজ্ঞানী’দের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার খবর গিয়ে পৌঁছল বাবার কানে। পারিবারিকভাবে প্রবল প্রতিরোধ ধেয়ে এল। হরানন্দ, শিবনাথকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। স্ত্রীকে নিয়ে শিবনাথও গৃহত্যাগ করলেন। পরিবারের সকলের সঙ্গে ছেদ করলেন সম্পর্ক। ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।

যুক্তি, ভাবনা, বোধ এবং মুক্ত চিন্তাধারার ক্ষেত্রে সবসময় স্বচ্ছ এবং স্পষ্ট ছিলেন। নারীমুক্তির পথকে প্রশস্ত করতে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন। নারী শিক্ষা, বিধবা বিবাহ, মেয়েদের শিক্ষার অধিকার এই সব নিয়ে কণ্ঠ তুলতে যুক্ত হয়েছিলেন ইন্ডিয়ান রিফর্মস অ্যাসোসিয়েশন- এর সঙ্গে।   

হয়ে উঠেছিলেন আদর্শ শিক্ষক। তাঁর শিক্ষক জীবনের শুরুয়াত হয় সাউথ সুবার্বন স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে। তারপর যোগ দেন হেয়ার স্কুলে। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক রূপে। পরবর্তী সময়ে তাঁর মামা তাঁকে হরিনাভী স্কুলের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।

১৮৭৯ সালে শিবনাথ শাস্ত্রী প্রতিষ্ঠা করেন সিটি স্কুল। পরবর্তীকালে সেই স্কুলই হয়ে ওঠে সিটি কলেজে। শিক্ষা বিস্তার এবং সামাজিক-রাজনৈতিক সচেতনতা এই দুই স্বার্থে ছাত্র সচেতনতা যে কতটা জরুরী নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছিলেন। ওই বছরেই গঠন করেন স্টুডেন্ট সোসাইটি’ (১৮৭৯)। বস্ত্তত এটিই হল ভারতবর্ষের প্রথম ছাত্রসংগঠন।

সমাজ সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম মুখ, শিক্ষাব্রতী, এসব ছাড়াও তিনি ছিলেন সাংবাদিক। সম্পাদকের ভূমিকাতেও একইভাবে সফল। ১৮৭৩-৭৪ সালে প্রকাশ করেছিলেন ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকা।১৮৮৩ সালে তাঁর  ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে সখা নামে ভারতের প্রথম কিশোর মাসিক প্রকাশিত হয়। ১৮৯৫ সালে তাঁর সম্পাদনায়
প্রকাশিত হয় বিখ্যাত কিশোর মাসিক মুকুল।

বাংলা সাহিত্যে শিবনাথ শাস্ত্রী খ্যাতিমান লেখক। প্রবন্ধ থেকে শুরু করে গল্প, উপন্যাস সমস্ত ক্ষেত্রে নিজস্ব ছাপ রেখে গিয়েছেন। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় বই ‘রামতনু লাহিড়ী এবং তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ উনিশ শতকের দলিল।   

১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে সেপ্টেম্বর কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।

শিবনাথ শাস্ত্রীর যথাযথ মূল্যায়ন বাঙালি করতে ব্যর্থ। উনিশ শতকের বাঙালি নবজাগরণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদকে বিস্মৃত হতে তাই বিশেষ সময় লাগেনি। তিনি আজীবন চেয়েছিলেন মনকে শিক্ষা, যুক্তি এবং যথার্থ বিচারবোধ দিয়ে স্বাধীন করে তুলতে, কিন্তু সেই স্বাধীনতা আজও থেকে গিয়েছে অ

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...