মহামারী লো, তুই এবার যা!

প্রাচীন এক শিক্ষক ছিলেন আমার। হাত-পায়ের চামড়ায় পুরনো বটের জড়তা। মাথায় বিস্তৃত টাক। স্মৃতি টুকু থাক চুল। সেও শনের মতো আমূল সাদা। হাত-পায়ের মতোই কণ্ঠও কিঞ্চিৎ কাঁপা। বিদ্দা-সরু সিক্ত আলের ওপর দিয়ে চলতে চলতে যেমন টাল রাখা দায় হয়, কথা বলতে তাঁরও তেমনি হত।

আমার শিক্ষকের এত পরিচয় দেওয়ার দরকারই ছিল না, আজকাল কে কার পরিচয় দেয়! সকলে প্রত্যেকে প্রায় নিজেরই কাছে নিজের প্রকৃত পরিচয় গোপন রাখে! তবুও দিলাম, এই কারণেই যে, তিনি আমাকে একদা এক মহামারীর গপ্পো শুনিয়েছিলেন। ব্ল্যাক ডেথ পড়াতে পড়াতে আরেক প্লেগমারীর কথা বলেছিলেন। তাঁর দেখা। 

সে গপ্পে অসংখ্য বৃষ্টিহীন দিন ছিল, অনেক ভয় ছিল, অসহায় মৃত্যুর বীভৎসতা ছিল। সে-সব কথা আজকের এই সমপ্রায় পটভূমিতে দাঁড়িয়ে চারণ করার কোন প্রয়োজন নেই। আমি সে-সব মনে রাখার খুব একটা চেষ্টা করিনি। তবে মানুষ বিভীষিকা অনায়াসেই মনে রাখতে পারে তো, তাই শ্রুতিমালা ভুলতেও পারিনি। মাফ করবেন, তবু হৃদয় খুঁড়তে আমি যাব না।

বিভীষিকার শেষে একটা প্রশান্তির গপ্পোও তিনি বলেছিলেন। আসলে আগের গপ্পোটারই উপসংহার সেটা। মন্দিরের ঘন্টাধ্বনির মতো, উপ্ত বীজের মতো, তৃষ্ণার জলের মতো আমি সেটুকুই মনে রাখতে চেয়েছি। মনে রেখেছি। 

তিনি বলেছিলেন: তারপর জানিস তো, একদিন গুরু গুরু মেঘ ডেকে উঠল, আকাশে বিদ্যুৎ খেলল, দমকা হাওয়া উঠল শুকনো পাতা আর ক্ষুধার্ত ধুলোর গোল্লা পাকিয়ে। না, সে-হাওয়ার অতটা জৌলুস ছিল না যে, আকাশ জোড়া কালো মেঘের মন ভোলাতে পারে! তাই মাটিমুগ্ধ মেঘমালারা বুক উজাড় করতে দেরি করল না।

বিন্দুতে বিন্দুতে টুপ টুপ ভরতে লাগল সমস্ত চরাচর। চালা বেয়ে নেমে উঠোনে-গলিতে-পাড়া বেড়ানো কীর্ণ রাস্তায়-পাড়া পেরনো বড় রাস্তায় সেই বিন্দুরা সাঁতার কাটতে কাটতে, খুনসুটি করতে করতে মাটি মাথায় করল। 

অমন করেই সারারাত বৃষ্টি হল। সেই একেবারে গিয়ে ভোর ভোর থামল। রাতে ভেবেছিলাম, সকলটায় বুঝি থৈ থৈ জলে সব একশা দেখব। কিন্তু, উঠে দেখি, ওমা এ কী! এ যে জল-টল কিচ্ছুটি থেমে নেই, নিজেরা বেমালুম তো গেছেই, যাবার সময় উঠোন-রাস্তার তেতো মাটি নিকিয়ে যেন সব চেঁছেপুঁছে নিয়ে গেছে! 

তারপর কী হল জানিস, একটু একটু করে রোগের প্রকোপ কমতে শুরু করল। কী আশ্চর্য, কয়েকদিনের মধ্যেই কোথায় কী, মহামারীর আর নামগন্ধ রইল না! বৃষ্টি যেন একদিনেই এতদিনের সব বিষ ধুয়ে মুছে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে! যেন, 'মহামারী লো, অনেক হয়েছে, এবার চল দিকি!'-বলে ঘেঁটি ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেছে! 

তখন আমার প্রখর অনুভূতি ছিল। তাই গপ্পোটা শুনে সত্যিকারের কাঁটা দিয়ে উঠেছিল গায়ে। এখন রূপকথা মনে হয়। রূপকথারা আমার কাছে নিছক অলস দুপুর। তবু ভালো লাগে। তাই চৈতন্যে অপেক্ষা থাকে, আমি আশায় আশায় দিন গুনি, চরাচরে কখন অমন একটা বালাই ভাসানো বৃষ্টি হবে!

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...