১৭৭৮ সালে আনুমানিক আজকের দিনটিতেই অর্থাৎ ৬ সেপ্টেম্বর বাংলার মাটিতে প্রথমবারের জন্য মুদ্রিত হরফে পাওয়া গিয়েছিল বাংলা ভাষাকে। এ বছরই ন্যাথানিয়ান ব্রাসি হালেদের ‘বাংলা ভাষার ব্যকরণ’ (A Grammer of the Bengal language) পুস্তিকাকারে এই ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হয়। ঐতিহাসিক ছাপাখানাটি সে সময় ‘অ্যান্ড্রুজ প্রেস’ নামে খ্যাত ছিল। অ্যান্ড্রুজ নামক এক ব্যক্তি তাঁর নিজস্ব ছাপাখানা থেকে হালেদের বইটি ছাপেন। হালেদের অনুরোধে স্যার চার্লস উইলকিন্স পাশাপাশি বসানো ধাতুনির্মিত চলনশীল বাংলা হরফ তৈরী করেন। সেই সূত্রে উইলকিন্স ছিলেন বাংলা ছাপাখানা ও মুদ্রণশিল্পের জনক। লন্ডন থেকে তিনি ছেনি কেটে হরফ তৈরীর কৌশলবিদ্যা আয়ত্ত করে ভারতে এসে তা পূর্ণভাবে কাজে লাগান। হুগলীর ত্রিবেণীর বাসিন্দা পঞ্চানন কর্মকার উইলকিন্সের এই প্রকল্পে সহকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বাঙালি খোদাইশিল্পী পঞ্চানন কর্মকারই প্রথম বাঙালি যিনি ছেনি কেটে হরফ তৈরীর কৌশল করতলগত করেছিলেন। তাঁর নির্মিত হরফেই ১৭৮৫ সালে ডানকানের ‘ইম্পে কোড’এর বঙ্গানুবাদ এবং ১৭৯৩ সালে কর্নওয়ালিসের কোড মুদ্রিত হয়। ডানকানের এই গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ দিয়েই বাংলা গদ্যের সূচনা হয়।
১৭৯৩ সালের ১১ই নভেম্বর কলকাতায় আসেন উইলিয়াম ক্যারে। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার মাটিতে ছাপাখানা তৈরীর প্রথম অভিযান ব্যর্থ হলেও তৎকালীন ড্যানিশ অধ্যুষিত শ্রীরামপুরের মাটিতে ছাপাখানা নির্মাণের অনুমতি আদায় করেন ক্যারে। ১৮০০ সালের ১০ই জানুয়ারি, উইলিয়াম ক্যারে, জোশুয়া মার্শম্যান ও উইলিয়াম ওয়ার্ডের যৌথ সমন্বয়ে হুগলির শ্রীরামপুরে, শ্রীরামপুর ব্যাপ্টিস্ট মিশন প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলা মুদ্রণশিল্পের ইতিহাসে এক অনস্বীকার্য ভূমিকায় স্থানাধিকার করে রয়েছে এই প্রাচীন ছাপাখানাটি। শ্রীরামপুর তখন ফ্রেডেরিক্স্ নগর নামে পরিচিত। বাংলায় ‘নিউ টেস্টামেন্ট’ ছাপার বাসনায় ধীরে ধীরে কাগজ, কালি ক্রয় করতে শুরু করেন ক্যারে। ফন্ট কাটিং ফাউন্ড্রি থেকে হরফ কেনার জন্য যোগাযোগ করেন পঞ্চানন কর্মকারের সঙ্গে। পঞ্চাননের পাশাপাশি আরেক বাঙালি এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। প্রথম বাঙালি প্রকাশকের পাশাপাশি গঙ্গাকিশোর ছিলেন একাধারে একজন পুস্তকবিক্রেতা, মুদ্রণশিল্পী ও গ্রন্থকার। বাংলা ভাষার প্রথম সংবাদপত্র ‘বাংলা গেজেট’ তাঁরই ছাপাখানা থেকে মুদ্রিতাকারে প্রকাশিত হয়।
১৮০০ সাল থেকে ১৮৩৪ সালের মধ্যে এই প্রেস থেকে প্রায় ৫০টি ভাষায় বাইবেল প্রকাশিত হয়, যার মধ্যে ৩৮টি ভাষার অনুবাদ সম্পন্ন করেছিলেন শ্রীরামপুরের ক্যারে ও তাঁর সহকারীরা। সব মিলিয়ে বাইবেলের ১১৭টি প্রিন্ট প্রকাশ করা হয় যার মধ্যে ২৫টি আবার বাংলা ভাষায়। পূর্বের ইন্দোনেশিয়া থেকে পশ্চিমের আফগানিস্থান পর্যন্ত সমস্ত ব্যাপ্টিস্ট মিশনে বাইবেল সাপ্লাই করতো এই প্রেস।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ব বাংলায় যে মুদ্রণযন্ত্র ছিল, তা নিতান্তই ক্ষুদ্রাকৃতির। তখন অধিকাংশ প্রকাশনা কোলকাতা থেকে মুদ্রিত হতো। ক্রমে ঢাকায় নিজের প্রয়োজনে আধুনিক ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে।
কাগজ প্রস্তুতের জন্য ১৮০৯ সালে শ্রীরামপুরে স্টিম ইঞ্জিন চালিত ট্রেডমিল স্থাপন করা হয়। বাইবেলের পাশাপাশি ১৮০২-০৩ নাগাদ প্রথমবারের জন্য মুদ্রিত হরফে ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’ প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ বাংলাই হল প্রথম ভাষা, যে ভাষায় মুদ্রিত হরফে এই দুই মহাকাব্য উপস্থাপিত হয়। ১৭৭৫ সালে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় এই ছাপাখানা। ইংল্যান্ডের মিশনে ক্যারে চিঠি মারফত জানান, ‘নিউ টেস্টামেন্ট’এর অনুদিত ১০,০০০ কপি ছাপতে ৪৩,৭৫০ টাকা খরচ পড়ছে। তাঁর মানে এই দাঁড়ায় যে, পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে বাংলায় বাইবেল ছাপার কাজ আপাতত স্থগিত রাখতে হবে। আবেদনে সাড়া দিয়ে ইংল্যান্ডের মিশনারী তাদের থেকে কিছু বাইবেল ক্রয় করে প্রত্যেককে দুটি করে স্বর্ণমোহর প্রদান করেন। এবং ছাপাখানাটি সক্রিয় রাখতে তারপর থেকে প্রতি বছর ছাপাখানার তহবিলে ইংল্যান্ড থেকে ১০,০০০ টাকা করে পাঠানো হত।
১৮৩৭ এ কিছুদিনের জন্য বন্ধ থাকে প্রেসটি। পরে আবার কিছু বছর আগের মতো চললেও ১৮৪৫ সালে ডেনমার্কের রাজা শ্রীরামপুরকে ব্রিটিশ সরকারের হাতে তুলে দেয়। ১৮৫৪ সালের মধ্যে ছাপাখানাটির সঙ্গে জড়িত প্রায় সকলেরই মৃত্যু হয়। পর্যাপ্ত কর্মচারী ও উদ্যোক্তা না থাকায় এবং অর্থের অভাবে ১৮৫৫ সালে ছাপাখানার সমস্ত কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ছাপাখানা বন্ধ হলেও বাংলা মুদ্রণশিল্পের ইতিহাসে এখনও এক বিরাট জায়গা জুড়ে অবস্থান করছে এই প্রেস। ছেনি কেটে বাংলা হরফ বের করা থেকে আজকের মেহেদি হাসানের অভ্র ফন্ট; বাংলা হরফের ক্রমবিবর্তনকালে এই দিনটি তাই বিশেষভাবে স্মরণীয়।