রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা কবিতায় জীবনানন্দের পর অবধারিতভাবে যার নাম উঠে আসবে তিনি বিনয় মজুমদার। সমস্ত স্থূলতা পিছনে ফেলে যিনি বেছে নিয়েছিলেন একাকীত্বপূর্ণ দিনযাপন। তাঁর রচিত কাব্যগুচ্ছ এখনও সময়ের সাক্ষ্য বহন করে চলে। আজ এই মহান কবির জন্মবার্ষিকীতে স্মরণ করে নেব তাঁর জীবন তথা কাব্যসমগ্র।
১৯৩৪ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর মায়ানমারে জন্মগ্রহণ করেন কবি। পরবর্তীকালে ছিন্নমূল হয়ে এপার বাংলার ঠাকুরনগরে এসে আশ্রয়ভিটে নির্মাণ করেন তাঁর পরিবার। ছাত্রজীবনে প্রেসিডেন্সি থেকে ইন্টারমেডিয়েট পর্ব শেষ করে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকপর্ব সম্পন্ন করেন গণিতপ্রিয় বিনয়। সে সময় বেশ কিছু বিজ্ঞানভিত্তিক গ্রন্থ সোভিয়েত থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। সেগুলি রয়ে গিয়েছিল তাঁর অবচেতনে। পরবর্তীকালে কবিজীবনের দিকে অগ্রসর হলে তাঁরই ছায়া প্রতিফলিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নক্ষত্রের আলোয়’।
পরবর্তীকালে বিনয়ের কবিতায় গণিতের ব্যবহার নিয়েও গবেষণা করেছেন বহু সাহিত্যিক। পয়ার ছন্দে লিখে চলা জীবনকাব্য ক্রমে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল দিনপঞ্জীর দিকে। ফলে একটা সময়ের পর প্রায় দিনলিপির আদলে পাওয়া যায় তাঁর কবিতা। ১৯৬০ সালে বাংলা সাহিত্যের অন্দরে ঘটে যায় বেশ কিছু আন্দোলন, যার মধ্যে হাংরি ও শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন বিশেষ অবদান রেখেছিল বাংলা সাহিত্যে। আন্দোলনগুলি মূলত ছিল প্রতিষ্ঠানের বিরূদ্ধে। তখন কোলকাতায় দিন কাটাচ্ছিলেন বিনয়। প্রায়ই চলে যেতেন কফিহাউস। সে সময় বাংলা সাহিত্যে শুরু হয়ে গিয়েছে অন্যধারার কবিতা জোয়ার। তুষার রায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উতপল কুমার বসু, শৈলেশ্বর ঘোষ, ফাল্গুনী রায়ের কবিতা তারই ইঙ্গিত করছিল নতুন পথের যাত্রার দিকে। হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন শক্তি। বিনয়ের বেশ কিছু কবিতা সে সময় প্রকাশিত হয় হাংরি বুলেটিনে, যার মধ্যে ‘একটি উজ্জ্বল মাছ’ কবিতাটি পরবর্তীকালে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পাঠকমহলে।
“অনেক ভেবেছি আমি, অনেক ছোবল নিয়ে প্রাণে
জেনেছি বিদীর্ণ হওয়া কাকে বলে, কাকে বলে নীল-
আকাশের হৃদয়ের; কাকে বলে নির্বিকার পাখি।
অথবা ফড়িঙ তার স্বচ্ছ ডানা মেলে উড়ে যায়।
উড়ে যায় শ্বাস ফেলে যুবকের প্রাণের উপরে।
আমি রোগে মুগ্ধ হয়ে দৃশ্য দেখি, দেখি জানালায়
আকাশের লালা ঝরে বাতাসের আশ্রয়ে আশ্রয়ে।
আমি মুগ্ধ; উড়ে গেছ; ফিরে এসো, ফিরে এসো, চাকা
রথ হয়ে, জয় হয়ে, চিরন্তন কাব্য হয়ে এসো”
জীবনে একবারই কোনো নারী এসেছিল বিনয়ের জীবনে। তাঁকে নিয়েই লিখেছিলেন কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘ফিরে এসো চাকা’। গ্রন্থটির চাকায় কোনো আড়াল রাখেননি তিনি। উৎসর্গপত্রে সরাসরি লেখা ছিল গায়ত্রী চক্রবর্তীর নাম। কবিতার নামকরণে চক্রবর্তীর চক্রকেই বেছে নিয়েছিলেন চাকার রূপকে। যতদূর জানা যায় বিনয়কে বিশেষ পাত্তাই দেন নি গায়ত্রী। এর কারণ বিস্তারিত আলোচনা করতে পারবেন বিনয় গবেষকেরা। পরবর্তীকালে গায়ত্রী খ্রীস্টান ধর্মে উপনীত হয়ে পদবীর সঙ্গে যোগ করেছিলেন স্পিভাক। তা নিয়েও শেষ জীবনে লিখে গেছেন বিনয়,
“আমরা দুজনে মিলে জিতে গেছি বহুদিন হলো
তোমার গায়ের রঙ এখনো আগের মতো, তবে
তুমি আর হিন্দু নেই, খৃষ্টান হয়েছো
তুমি আর আমি কিন্তু দুজনেই বুড়ো হয়ে গেছি
আমার মাথার চুল যেরকম ছোটো করে ছেঁটেছি এখন
তোমার মাথার চুলও সেইরূপ ছোটো করে ছাঁটা,
ছবিতে দেখেছি আমি দৈনিক পত্রিকাতেই; যখন দুজনে
যুবতী ও যুবক ছিলাম
তখন কি জানতাম বুড়ো হয়ে যাব?
আশা করি বর্তমানে তোমার সন্তান নাতি ইত্যাদি হয়েছে
আমার ঠিকানা আছে তোমার বাড়িতে,
তোমার ঠিকানা আছে আমার বাড়িতে,
চিঠি লিখব না।
আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায়।“
‘বাল্মিকীর কবিতা’ পাঠ করে বিনয় গবেষক অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সেন মনে করেছিলেন, বিনয়ের ‘বাল্মিকীর কবিতা’ রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্মিকী প্রতিভার’ই বিনির্মান। ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’তে তাঁর যৌনজীবন ও দর্শনের নির্মোহ প্রকৃতি ফুটে উঠেছে প্রতিটি পংক্তিতে। যার মধ্যে ‘আমার ভুট্টায় তেল’ কবিতাটি পাঠকমহলে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। বস্তুত গ্রন্থটি ফ্রয়েডিয়ান ডিসকোর্সে সমৃদ্ধ। এই গ্রন্থগুলি ছাড়াও ‘অধিকন্তু’ ও ‘ঈশ্বরীয়’ গ্রন্থ দুটি বিশেষ উল্লেখযোগ্যতা দাবি করে। তাঁর সৎ উন্মুক্ত লেখনীতে বারবার ধরা দিয়েছে অতিচেতনার দর্শন। একটা সময়ের পর কোলকাতা ছেড়ে সুদূর ঠাকুরনগরের পৈতৃক ভিটেতে চলে আসেন বিনয়, সেখানেই কাটিয়েছিলেন বাকি জীবন। প্রকৃতির সাথে দীর্ঘদিন নির্জনবাস করার পর বুঝেছিলেন সৃষ্টির আদি সূক্ষ্ম রহস্য। তিনি কি ভেদ করেছিলেন জন্মরহস্য? আমৃত্যু দাক্ষিণাত্যে খর ভূমিকম্পের আশ্রয়ে? জীবনানন্দের পর বিনয়ই একমাত্র কবি যিনি মহাকালকে ছুঁতে পেরেছিলেন, যার কবিতা জীবনানন্দেরই মতো গ্রথিত হয়ে রয়েছে আধিভৌতিক নক্ষত্রপুঞ্জের দৈবালোকে।
‘কবিতা বুঝি নি আমি ; অন্ধকারে একটি জোনাকি/যৎসামান্য আলো দেয়, নিরুত্তাপ, কোমল আলোক’
‘ধূসর জীবনানন্দ’ গ্রন্থে অকপট স্বীকার করেছিলেন জীবনানন্দকে নকল করার চেষ্টার কথা, নকল করতে গিয়ে বুঝেছিলেন, এই মহান কবিকে নকল করা তাঁর সাধ্য এলাকার বাইরে। জীবনানন্দ লিখেছিলেন, “মানুষের মৃত্যু হলে/ তবুও মানুষ থেকে যায়”, বিনয় লিখলেন, “মানুষ নিকটে এলে/প্রকৃত সারস উড়ে যায়”। এই যে ছন্দ, যা নিঃসন্দেহে জীবনানন্দীয়, তাঁকেই পয়ারে বেঁধেছিলেন ‘একা একা কথা বলি’র সৃষ্টিকর্তা বিনয়। কবিতা সম্বন্ধে একটি স্থানে অনেকটা এইরকম বলেছিলেন, যখন দেখবে লুকিয়ে রাখার পরও পাঠক বিছানার তলা থেকে বার করে তা পড়ছে, তখন বুঝবে কবিতা লেখা হচ্ছে।
‘অভ্যন্তরে ঘ্রাণ নাও/হৃদয়ের অন্তর্গত ঘ্রাণ’
লেখায় অতিচেতনার উপস্থিতি থাকায় সমলোচক আর্যনীল বন্দোপাধ্যায় বিনয়ের জঁর’কে ‘সায়েন্টিফিক ফিল্ড জর্নাল’-এর সাথে তুলনা করেছিলেন। পাগলামি যে আসলে অতিচেতনারই নামান্তর, তা বিনয় পাঠকালে খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সমসাময়িক কবিদের থেকে অতিচেতনায় অনেক এগিয়ে থাকলেও জীবিতাবস্থায় গুটিকয়েক পাঠক ছাড়া বিশেষ সমাদর জোটেনি বিনয়ের ভাগ্যে। জীবনানন্দের ক্ষেত্রেও অনেকটা এইরকম হয়েছিল।
একটি সাক্ষাৎকারে কোলকাতা ছাড়ার প্রসঙ্গ উঠলে বিনয় বলেন, “কত কিছুই তো ছাড়লাম। চাকরি ছাড়লাম, কফিহাউস ছাড়লাম, ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়লাম…. খ্যাতি, যশ প্রতিপত্তি সবকিছুই তো ছাড়লাম।“ কবিতা লেখার প্রসঙ্গে বলছেন, “আমি বছর পঁচিশ বয়সে টের পেলাম যে, সমস্ত জড়ের ভিতরে, উদ্ভিদের ভিতরে, মানুষের ভিতরে সৃষ্টির নিয়মগুলি, সূত্রগুলি সম্পূর্ণ এক। এই কথাটা টের পাওয়ার পর আমি চাকরি বাকরি ছেড়ে শুরু করলাম কবিতা লেখা, এইভাবে শুরু হল আমার কবিতার জগতে নিজস্বতা ও তার যাত্রা।“ অর্থাৎ ‘ওয়াননেস’-এ বিশ্বাস করতেন কবি। একের ভিতরেই যে বহু আমির বাস, আবার বহুতেই যে একের বাস, তা তিনি পঁচিশ বছর বয়সেই প্রথম টের পেয়েছিলেন। ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ গ্রন্থে তারই নির্যাস আমরা পাই, “শরীরই অন্তর আর অন্তরই শরীর/এই অনাদি একের থেকে সৃষ্টি হয়েছিল ভবিষ্যের সবকিছু”।
একটা সময়ের পর কবিতা লেখা বন্ধ করে দেন বিনয়। বদলে মাইকেলের মতো মুখে মুখে রচনা করতে শুরু করেন পয়ার ছন্দের কবিতা, “দিনপঞ্জী লিখে লিখে এতটা বয়স হল/ দিনপঞ্জী মানুষের মনের নিকটতম লেখা।“ অথবা “পৃথিবীর ঘাস, মাটি/মানুষ, পশু ও পাখি/সবার জীবনী লেখা হলে/আমার একার না হলেও চলে যেত বেশ/আমার সকল ব্যথা প্রস্তাব প্রয়াস তবু/সবই লিপিবদ্ধ থেকে যেত”।
রবীন্দ্র পুরষ্কার ও কৃত্তিবাস পুরষ্কারে ভূষিত হওয়ার পর মৃত্যুর এক বছর আগে সাহিত্য আকাদেমী পুরষ্কারে সন্মানিত করা হয় বিনয়কে। তা সত্ত্বেও কোনোদিন প্রতিষ্ঠানের তাবেদারি না করায় এখনও বহু জায়গায় উপেক্ষিত রয়ে গেছেন তিনি। তবে সে যন্ত্রণা তাঁর কোনোকালেই ছিল না। একা থাকতে থাকতে একাকীত্বকে জয় করে উঠতে পেরেছিলেন, যা দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক স্তরে মানব জীবনের অন্যতম প্রাথমিক উদ্দেশ্য। আত্মপরিচয় প্রবন্ধের একটি অংশে তিনি লিখছেন, “১৯৭০ খ্রীস্টাব্দের মাঝামাঝি থেকে আমি ফের কবিতা লেখার দিকে খুব বেশী মনোনিবেশ করেছি। গত দেড় বছরে আমি দুইশত-র বেশী কবিতা লিখে ফেলেছি। এখনও অব্যাহত গতিতে লিখে চলেছি। বিষয়বস্তুর অভাব হচ্ছে না, কারণ মানব জীবনের সম্পূর্ণ অজ্ঞাত এক লোক আমি আবিষ্কার করেছি। পৃথিবীর জড়, উদ্ভিদ ও মানুষের একত্রিত বাসের কারণ, উপায় প্রভৃতি ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি।“
“কে কোথায় নিভে গেছে তার গুপ্ত কাহিনী জানি না।
নিজের অন্তর দেখি, কবিতার কোনো পঙতি আর
মনে নেই গোধূলীতে; ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই।“
শেষ বয়সে বিবিধ শারীরিক পীড়ায় আক্রান্ত হলে পরিবার না থাকার ফলে দেখাশোনা করার তেমন লোক ছিল না। ফলস্বরূপ ২০০৬ সালের ১১ই ডিসেম্বর ৭২ বছর বয়সে ঠাকুরনগরে নিজের বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বিনয় মজুমদার। পাঠ্যপুস্তকে ঠাঁই না হলেও অনন্তকালের জন্য পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন তিনি। সময়ের সাথে সাথে আগামীদিনে আরও বেশী মাত্রায় আবিষ্কার হবে তাঁর অতিচেতনাপূর্ণ কাব্যসম্ভার… ততদিন আমরা পাঠ করব বিনয়ের কবিতা… পয়ার ছন্দে, বাতাসের আলোকসংশ্লেষে।