কালবেলা-র স্রষ্টার জন্মদিনে
জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কাহনেই তাঁর লেখক সত্তার সাত কাহন।
জন্ম চা-বাগানে।বড় বড় নাম না জানা গাছ আর জঙ্গলের কোলে বেড়ে ওঠা। সেখানেই কল্পলোকের সঙ্গে হাত মেলান।সেই আঁতাতেই তো আগামীর উত্তরাধিকার ; লেখক হিসাবে।
মাত্র চার বসন্ত পেরোতে না পেরোতেই সেখান থেকে রদ বদল। খুদের কান্নাকে তখন কেউ প্রশ্রয় দেননি।
ফেরত আসার সময় ওখানকার মাটি রুমালে বেঁধে নিয়ে এসেছিলেন। মাঝে মাঝে দেখে নিতেন সেই মাটির রঙ বদল।
চোদ্দো বছর বয়সে লুকিয়ে চরিত্রহীন পড়া-
তিনি সমরেশ মজুমদার। যাঁর প্রতিটি লেখায় বাংলা ভাষার পাঠক আজও গল্পের স্বাদ মুখে তুলে জীবনের কপালে চুমু খায়।
অনিমেষ-মাধবীলতা সম্পর্কের ঘোরে আজও বিভোর হন সকলে।তাঁর গল্পে ঘরে বাইরের আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠা নারী চরিত্ররা আজও বাঙালির সহিত্য মননে এক কিংবদন্তী।
বিধবা বড় পিসিমা আর ঝাড়িকাকু ছিল শৈশবের গল্পের নায়ক-নায়িকা। জীবন তখন রঙিন আয়না।
প্রাথমিক শিক্ষা জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে। বাংলায় স্নাতক হলেন কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে এবং স্নাতকোত্তর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
তাঁর লেখনি শুধু গল্প বা উপন্যাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী থেকে কিশোর উপন্যাসেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার।
এছাড়া তিনি বেশকিছু সফল টিভি সিরিয়ালেরও কাহিনীকার।পাশাপাশি বাংলা চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও দূরে থাকতে পারেনি তাঁর লেখার স্পর্শ থেকে।
বন্ধুদের কফি খাওয়াবেন- এই তাড়না থেকেই লেখার কলম হাতে তোলা। প্রিয় পাঠক শুনে অবাক হলেও এটাই দীপাবলি-র জনকের বচন।
তাঁর সাহিত্য যাপনের প্রথম পর্বে হাতে আসে ধারাবাহিক ব্যর্থতা। সেই দশকের কলকাতা থিয়েটারে বুঁদ। আন্দোলনের নতুন এক পরিশীলিত মাধ্যম।
গণমাধ্যমও বলা চলে। কারণ সেই সময়ের নাটকের দর্শক আজ ডিজিটাল হয়ে বাড়ির অন্দরমহলে বন্দী। আর বেরোতে পারেননা। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগে সেসময় চতুর্থ দেওয়ালটি ছিল নামমাত্র।
সেই গ্রুপ থিয়েটারই ছিল লেখকের আঁতুড় ঘর। মৌলিক নাটকের দরকার হলে বন্ধুরা অনুরোধ করেন নাটক লেখার জন্য। তিনি নাটক লিখলেন। পরদিন সেই নাটক সবাইকে শোনালেন। সবার মুখ গম্ভীর।
আর যা–ই হোক, নাটক হয়নি। তখন এক বন্ধু বললেন আগে গল্প লিখে তারপর নাট্যরূপ দিতে।সেই মত কলম দৌড় দিল।গল্প রচনা হল। অন্যমাত্রা- তাও হয়ে উঠল না নাটক।
দেশ পত্রিকায় পাঠানো হল সেই গল্প। বেশ কয়েকবার যোগাযোগের পর সম্পাদক লেখাটা ছাপা হবে আশ্বাস দিয়েছিলেন। আশ্বাস পেয়ে খুশিতে সাত বন্ধুকে কফি হাউসে খাইয়ে দিলেন।
কিন্তু পরের সংখ্যায় ছাপা হলনা সেটা।আঠারোর রাগে বশীভূত সমরেশ পাবলিক ফোন থেকে দেশ পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক বিমল কর-কে দূরভাষে অশ্রাব্য কটূক্তিও করেন।
পরে কাগজে গল্পটা ছাপা হল। ১৫ টাকা সম্মানী পেয়ে সেটাও বন্ধুদের কফির চুমুকে ফুড়ুৎ হয়ে গেল।
এই খাওয়ার লোভেই বন্ধুরা তাঁকে আবারও লিখতে বলেন। এইভাবেই কফি খাওয়া ও খাওয়ানোর তাগিদ থেকেই সাহিত্যিক সমরেশের পূর্ণ আবির্ভাব।
কর্মজীবনে তিনি বহুল প্রচলিত এক প্রকাশনার সঙ্গেও ছিলেন যুক্ত।
উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলির মধ্যে সাতকাহন, তেরো পার্বণ, স্বপ্নের বাজার, উজান গঙ্গা, ভিক্টোরিয়ার বাগান, আট কুঠুরি নয় দরজা, অনুরাগ আজও পাঠক মহলে রৈ-রৈ তোলে।
ট্রিলজি উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ বাংলা সাহিত্য জগতে তাঁকে দিয়েছে নক্ষত্রের স্থান।
এই উপন্যাসত্রয়ীর মধ্যে শেষ দুটি অনেকটা জোর করে লেখা।উত্তরাধিকার প্রকাশের পর পাঠকদের আগ্রহের কথা ভেবে প্রকাশক সাগরময় ঘোষের নির্দেশে বাকি দুই পর্ব লেখা।
১৯৮২ সালে আনন্দ পুরষ্কার। ১৯৮৪ সালে সাহিত্য আকাদেমী পুরষ্কার, বঙ্কিম পুরস্কার এবং আইয়াইএমএস পুরস্কার। চিত্রনাট্যকার হিসাবে বিএফজেএ, দিশারী এবং চলচ্চিত্র প্রসার সমিতির অ্যাওয়ার্ড-তবুও অব্যাহত কালি ও কলম।
এই অব্যাহতির কারণ গল্পকারের চোখ; জীবনকে দেখার এবং উপভোগ করার।সেই উপভোগের ভাষারাই আবার পাঠক-পাঠিকার মন জয়ের রসদ।
যখন আমি থাকব না, তখন আমার মন তো থেকেই যেতে পারে এই পৃথিবীতে। এই আকাশে, গাছের পাতায়, ঝরনায়, শিশিরে...
দুর্ভাগ্যক্রমে মৃত্যু এই জগতের সবচেয়ে বড় সত্যি। হ্যাঁ দুর্ভাগ্য, কেননা তার অবকাশ না থাকলে প্রিয় লেখক-ঔপন্যাসিক মৃত্যুর হাতছানিতে এরূপ আবছায়ার মুখোমুখি হতেন না হয়ত।
তাঁর জন্মদিবসে তাঁর কলমের দীর্ঘায়ু কামনা করি। এ এক ভঙ্গুর সময়। তবুও ভাঙ্গনের সঙ্গেই তো নতুন সৃষ্টির আলো ছায়ার খেলা।