‘কসমোপলিটন’ কলকাতার কেকের কাব্য

ডিসেম্বর মানেই বাঙালির কাছে কেকের মাস। কেকের গন্ধ আর ক্রিসমাসের আনন্দ মিলেমিশে এক। কেক তো শুধু ২৫-এর নয়, নতুন বছর পর্যন্ত টানা চলল। জলখাবার থেকে ডিনার তো বটেই বছর শুরুর উপহারেও চাই কেক!

কেকের দোকানে লাইনের তাই কমতি নেই। প্লাম কেক, ফ্রুট কেক, জিঞ্জার কেক , বাটার কেক, রাম কেক কত নামরকম নাম তার!

 এ চল অবশ্য আজকের নয়। সেই আঠারো শতক থেকেই চলছে। ‘উইলসন সাহেবের হোটেলে’ বড়দিনের হুল্লোড় শিরোনাম হয়ে আসত খবরের কাগজে। ‘ফুফু’ বাজত নিউমার্কেট অঞ্চলে।  

সাহেব বাড়িতে ক্রিসমাসে ‘স্পেশাল’ পদের আয়োজনে ব্যস্ত থাকত খানসামা, খিদমদগার, বাবুর্চিরা। টার্কি, হ্যাম, কেক, বিস্কুট, জিঞ্জার কুকি, ব্রেড, জ্যাম কী নেই সেখানে! সঙ্গে থাকত বিলিতি পানীয়।

ইংরেজদের পঁচিশযাপনে মজে ছিলেন রাজা, মহারাজা, বাবুরা। এলাহী আয়োজন পাল্লা দিতে চাইত লন্ডন নগরীর সঙ্গে।

 সেই সংস্কৃতি ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ল মধ্যবিত্তের অন্দরমহলেও। ইংরেজের ‘যীশু দিবস’ আর তার একার থাকল না। হয়ে উঠল ‘কসমোপলিটন’ কলকাতার বছর শেষের পার্বণ।

বড়দিনের কেকেও লাগল সেই ছোঁয়া।

শুধু কলকাতার দিকেই যদি তাকানো যায় তাহলে কলকাতার ‘কেক পট্টি’ বোধহয় বলা হবে এন্টালি, তালতলা অঞ্চলকে।

sal

নভেম্বর শেষ হতেই এসব অঞ্চলে বদলে যায় হাওয়ার গন্ধ। গলির পাশ দিয়ে চলতে গেলেই বেকিং-এর গন্ধ বলে দেবে উৎসব কড়া নাড়ছে দরজায়। অজস্র বেকারী। দিনরাত চলে কেক নিয়ে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা। বেক ওভেন থেকে বেরিয়ে গরম গরম কেক সোজা চলে যায় হগ সাহেবের মার্কেটে। সেখান থেকে আমার-আপনার বাড়ি।

এই শহরে আরও এক ধরনের কেক আছে। কেকহ্যাংলাদের কথায় যার নাম ‘ অ্যাংলো পাড়ার কেক’। বো-ব্যারাক, চাঁদনিচক, কলুটোলা অঞ্চলে বহু মানুষ ভিড় জমান কেকের টানে।  ঝকঝকে মোড়ক নয়, এ কেকের আসল চমক তার স্বাদে।

 একেবারে আলাদা। ঘরোয়া স্বাদে বেকারীর কেক। পুরনো কলকাতায় সেইসব বেকারী আজও বাঙালির বছর শেষের উদযাপনের অঙ্গ। কখন যেন এক হয়ে গেছে এ শহরের বনেদী আভিজাত্যের সঙ্গে।

এমনই এক নাম জেএন বরুয়া কেকশপ। রঙ-চঙে নামের ভিড় থেকে অনেকটা দূরে আটপৌরে এক নস্টালজিয়া।

বরুয়ার কেক এক হারানো সময়ের গল্প । রবার্ট স্ট্রিটের এক চিলতে দোকানে আজও ভিড় জমে থাকে মাঝরাত বরুয়ার কেক জনপ্রিয় ‘মন্টুদার কেক’ নামেও। প্রায় ১০০ বছর ধরে এক ভাবে চলছে।

১৯১৪ সালে বরুয়া বেকারী শুরু করেন মনোরঞ্জন বরুয়া। চট্টোগ্রাম থেকে কলকাতায় এসেছিলেন তিনি।  

jn

বো-ব্যারাকের পাশেই রবার্ট স্ট্রিটে ছোট্ট বেকারী। বো-ব্যারাকের মানুষরা বলেন,’একবার যে বরুয়ার কেক খেয়েছে তাকে বছর বছর ফিরে আসতেই হবে এখানে।

ফ্রুট কেক, প্লাম কেক তো আছেই বরুয়ার ছানা পোড়া কেক শহরের সেলিব্রিটি। একে যদি ভাবেন ওড়িশার ‘ছানাপোড়া’ তাহলে ভুল ভাবছেন। ছানার মধ্যে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা ড্রাই ফ্রুট। মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়!

jn1

ক্রিসমাসের আগের দিন সারারাত খোলা থাকে দোকান। বছরের অন্য দিনগুলোতেও সকালবেলা ৯’টার সময় খুলে যায়। চলে রাত ৯ টা। এখন বেকারী সামলান ‘মন্টুদা’।

এমনই আর একটি নাম ‘সালদানা বেকারী’।

রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডে থেকে নবাব আব্দুর রহমান স্ট্রিটের গলি, সেখান থেকে কিছুটা হাঁটলেই একতি হলুদ বাড়ি। বাড়ির গায়ে লেখা নাম ‘সালদানা বেকারী’।

 ‘সালদানা’ প্রথমে ছিল বাড়ির বেকারী। কেকের ঘরোয়া রেসিপিই হয়ে ওঠে সালদানা’র আকর্ষণ।

sal-1

প্রতিষ্ঠাতা মিস্টার সালদানা ছিলেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। মেয়ে দেবরা অ্যালেক্সান্দ্রা ব্যাঙ্ক চাকরী করত। ওয়ালনাট কেক, কোকানাট ম্যাকারন, ব্রিটিশ কেক, অ্যাপেল টার্ট, চিকেন প্যাটি তো আছেই এখানের চেরি বান আর ম্যাকরন বেশ কাবু করে ভোজনরসিকদের!

কলোনিয়াল কলকাতার বর্ষবরণ অসম্পূর্ণ এইসব স্বাদের উদযাপন ছাড়া। বছর বছর তাই ফিরে আসতে হয়। করতে হয় গলির খোঁজ, কিংবা পুরনো ঠিকানা। এভাবেই বেঁচে থাকে ঐতিহ্য। সময়কে হার মানিয়ে...   

  

    

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...