কার্ল মার্ক্স সরনী ও মনিলাল ব্যানার্জি রোডের মুখে এক পাইস হোটেল। নাম ইয়ং বেঙ্গল হোটেল।
শহর কলকাতার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে খিদিরপুর। বন্দর এলাকার খুব পুরনো পাইস হোটেলগুলির মধ্যে একটি ইয়ং বেঙ্গল। হেনরী লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও র বিপ্লবী অনুপ্রেরণায় এই হোটেলের নামকরণ।
নামের গায়ে লেগে থাকা ইতিহাসের গন্ধ বলে দেয় এই শহরের বদলে যাওয়া সময়ের অনেকটা গল্প তার কাছে রাখা।
ইয়ং বেঙ্গল হোটেলের প্রতিষ্ঠা করেন তারাপদ গুহ রায়। ১৯৩০ সালে।
বাংলাদেশ থেকে ভাগ্যের সন্ধানে পা রেখেছিলেন কলকাতা শহরে।
শোনা যায় একবার তাঁর দেখা হয়েছিল মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে। গোটা দেশ তখন জাতীয়তাবাদের আগুনে ফুটছে। অসহযোগ আন্দোলনে উত্তাল। স্বাধীনতার দাবীতে পথে নেমেছে মানুষ।
তারাপদও চাইলেন সেই পথের শরিক হতে। কিশোর তারাপদ ঠিক করলেন দেখা করবেন তাঁর সঙ্গে। দেখা হল। ভেবেছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেবেন। কিন্তু কিশোর ছেলেটিকে ফিরিয়ে দিলেন গান্ধীজী। বললেন, “কঠিন পরিশ্রম করো। ইংরেজদের বুঝিয়ে দাও আমরাও পারি।”
মহাত্মার কথা সাড়া জীবন মনে রেখেছিলেন তিনি। ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন নিজের ভাগ্য নিজে গড়ে নিতে। ঘামে রক্তে, পরিশ্রমে উদ্যোগী বাঙালি।
ওপার বাংলা না ওপার বাংলা ঠিক কোথায় দেখা হয়েছিল তাঁর গান্ধীজীর সঙ্গে সে নিয়ে ধোঁয়াশা থাকলেও সেদিনের সেই কিশোর মর্মে ধারণ করেছিলেন কিন্তু গান্ধীজীর বাণী।
কলকাতার বুকে ব্যস্ত হাইকোর্ট পাড়ায় শুরু করলেন ‘নন্দন কানন’। পাইস হোটেল। তাঁর প্রথম প্রতিষ্ঠান।
তাঁর তৃতীয় প্রতিষ্ঠান ‘ বঙ্গলক্ষী’। একসময় মধ্য কলকাতার অন্যতম সেরা হোটেল ছিল। বাঙালি খাবারে সেরা। সেই টানেই এখানে এসেছিলেন রিচি বেনো। বিখ্যাত অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার।
প্রথম আর তৃতীয়ের কথা আগে এল কারন এই দুই হোটেলের অস্তিত্ব আজ আর নেই। কিন্তু এখনও উজ্জ্বল ‘ইয়ং বেঙ্গল’।
‘ইয়ং বেঙ্গল হোটেল’। তাঁর দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান।৯০ ছুঁতে চলা এই প্রতিষ্ঠান আজও কলকাতার খাদ্যরসিকদের কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। এতগুলো বছরেরও এতটুকু বদল আসেনি হোটেলটিতে।
পুরনো বাড়ি। লম্বা টানা দালান। সেই নিয়ে হোটেল। পুরনো চেয়ার টেবিল থেকে শুরু নুন, লেবু কলাপাতা, মাটির ভাঁড়ে জল। দেওয়ালের বোর্ডে লেখা দিনের মেনু আর তার দাম। সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে।
তারাপদ গুহ রায়ের জীবনাবসানের পর তাঁর স্ত্রী চালাতেন প্রতিষ্ঠানটি। সেই বাঙালিনীর তেজে মুগ্ধ ছিল কলকাতা। তাঁর পর এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেন পৃথা গুহ বর্ধন। তাঁর মেয়ে। পেশায় ধ্রুপদী সঙ্গীতশিল্পী দক্ষ হাতে সামলাতেন ইয়ং বেঙ্গল।
এই এই হোটেলে কোনও ফ্রিজ আসেনি। রান্না হয় বাটা মশলায়। ধোঁকার ডালনা, মোচার ঘন্ট, লাউচিংড়ি, শুক্তো, বড়ির ঝাল। ইলিশ-চিংড়ি-পার্শে-পাবদা-রুই, ‘ঘরের রান্না’র স্বাদ জাতে পুরোপুরি বজায় থাকে সেদিকে রাখা হয় কড়া নজর। পুরনোর কোনও চিহ্নকেই বদলাতে দেননি। সেই ধারাতেই আজও একই ভাবে রাখা পুরনো গ্রামোফোন। পুরনো আলবোলা। সবই আগের মতই...
প্রাচীন শহর এভাবেই ধরে রাখার চেষ্টা করে চলেছে পুরনো সময়। অলি, গলি আনাচে-কানাচে প্রতিটা অগোছালো বেঁচে থাকায় মুখ গুঁজে আরও একটু বেশিক্ষণ বাঁচতে চায় তারা।