‘অফসাইড’ শব্দটা হঠাৎই মনে এল। ইরানী পরিচালক জাফার পানাহি ২০০৬-সালে একটি সিনেমা বানিয়ে ছিলেন। ‘অফসাইড’। কেন মনে এল, সে প্রসঙ্গেই এই প্রবন্ধ।
২০০৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত একটানা এশিয়া কাপ ‘চ্যাম্পিয়ন্স’ ট্রফি ঘরে এনেছেন ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল। ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটবাহিনীকে ধরাশায়ী করে গতবছর ১০ই জুন (২০১৮) এশিয়া কাপ-এ দুর্দান্ত জয়ের মাধ্যমে আমাদের প্রতিবেশী ‘বাংলাদেশ’-এর মেয়েরা সেদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে আজীবনের জন্যে একটি ‘মাইলফলক’ তৈরি করে ফেলেছিলেন, যা স্থান-কাল-কাঁটাতার পেরিয়ে বাংলা-বাহিনীকে ভাসিয়ে নিয়েছিল প্রশংসা-বাহবায়। বিশ্ব ক্রিকেটে এভাবেই স্বীকৃতির লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন দেশের মেয়েরা। এদিকে ২০১৯-এ আমরা দেখেছি ভারতীয় ‘পুরুষ’ ক্রিকেট দলের ওয়ার্ল্ড কাপ সফর। দাপট, হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চালিয়ে শেষে সেমিফাইনাল থেকে ছিটকে গেলেও, সারা দেশ জুড়ে তাঁদের ঘিরে উন্মাদনার কোনও ঘাটতি চোখে পড়েনি। এখন কথা হল, ২০২১-এ আসতে চলেছে আইসিসি ‘উইমেন্স’ ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ। ২০১৯-এর মতো ২০২১-এও ধরে রাখা যাবে তো সেই ‘উন্মাদনা’?
প্রশ্নটা শুধু ‘ক্রিকেট’ কেন্দ্রীক নয়, এটা শুধুমাত্র একটা উপলক্ষ্য হিসেবে ধরা যেতে পারে। আসল প্রশ্নটা হল, বর্তমান প্রেক্ষাপটে মেয়েরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে জয়ের নজির রাখছে আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে লিঙ্গ নিরপেক্ষতার ‘মহানুভবতা’ এবং যাঁরা তাঁদেরকে ‘ঐতিহাসিক’, ‘অনন্য’, ‘বাঘিনী’, ‘কালজয়ী’ ইত্যাদি আখ্যা দিয়েছেন বা দিয়ে চলেছেন, তাঁরা এর আগে ঠিক কতবার স্বেচ্ছায় ‘মহিলা’ ক্রিকেট অথবা অন্যান্য যেকোনও খেলা টেলিভিশনে দেখেছেন?
কতবার নিজের দেশের (ভারত/বাংলাদেশ সব দেশের উদ্দেশেই) মেয়েদের খেলা স্বচক্ষে ধোনি-কোহলি-শাকিব’দের ম্যাচ থামিয়ে দেখেছেন? তাঁরা কি আদৌ জানেন তাঁদের দেশে কোন কোন মহিলা ক্রিকেটার রয়েছেন? তাঁদের নাম কি? জানেন, মহিলা ক্রিকেটে ভারত ‘আন্তর্জাতিক স্তরে’-এ কত নম্বর পজিশনে রয়েছে এই মুহুর্তে? বিরাট কোহলির কুকুরের নাম কিন্তু সবাই জানেন, মহেন্দ্র সিং ধোনি’র মেয়ে তার বাবাকে কিভাবে ‘ফ্লাইং কিস’ দিল সেই ছবি নেটে ভাইরাল! হালফিলের মহম্মদ শামি কবে তাঁর পরবর্তী বিয়ের খবর দিচ্ছেন, সেই খবরে মিনিটে হাজার ‘ভিউয়ারস’!
মহিলা ক্রিকেট দলের একতা বিস্ত বা পুনম যাদবের মতো বোলাররা কোন হাতে ‘বোলিং’ করেন জানেন? দলের অল-রাউন্ডার যে কোনো একজন ক্রিকেটারের নাম বলতে পারবেন? টেস্ট এবং টি-২০ দলের ক্যাপ্টেন কে জানেন? এটা নিশ্চয়ই জানবেন, এরকম আরও হাজারটা প্রশ্ন আপনার বিবেক-বুদ্ধির বিরুদ্ধে ছুঁড়ে দেওয়া যেতে পারে। ‘যে কোনও পরিবর্তনের জন্য নির্দিষ্ট সময় লাগে’ জানি এটাই বলবেন। তাহলে আর কি!
এবার শুরু করুন…জানুন, যে মেয়েরা কঠোর পরিশ্রম-নিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের জন্যে ‘সম্মান’ বয়ে আনেন, ম্যাচ প্রতি তাঁদের পারিশ্রমিকের অঙ্ক তুলনায় কতটা অসম্মানজনক! জানুন, বাংলাদেশ-ভারত-ইরান-পাকিস্তান-আয়ারল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া এরকম আরও আরও দেশে খেলা কতটা লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার! জেনে নিন, কীভাবে উগ্র জাতীয়তাবাদ পিতৃতন্ত্র এবং কালচারাল ফিন্যান্স, ক্যাপিটালিস্ট মিডিয়ামকে মাস মিডিয়ার সঙ্গে মিশিয়ে তার প্রসার-প্রচার ঘটায়। পুঁজিবাদ, রাষ্ট্রবাদ ও পিতৃতন্ত্রের অসাধু চক্র কীভাবে দিনের পর দিন ‘জেন্ডার ইকুয়ালিটির’ ঝান্ডা উড়িয়ে প্রত্যেকটি প্রচলিত খেলায় একটা ‘ফেমিনিন ভার্সন’ তৈরী করে! শুধু ক্রিকেট নয়, যেকোনও খেলাতে মহিলারা যেন হয়ে ওঠে্ন যৌন ‘কমোডিটি’ বা ‘ভোগ্যপণ্য’!
২০০৬’এ যখন জাফার পানাহি ‘অফসাইড’ বানিয়েছেন। তিনি তুলে ধরেছেন- যাঁরা নিয়মের ‘সিসি ক্যামেরায়’ আটকে রয়েছেন, তাঁরা কীভাবে এক এক করে নস্যাৎ করছেন বিধি-আইন-কায়দা-প্রভুত্ব-নিয়ন্ত্রণ-আধিপত্য-রীতি-অপশাসন-পদ্ধতি। শুরুতে বলেছিলাম, আবারও বলছি, এ প্রবন্ধ ‘ক্রিকেট’ সম্বন্ধীয় নয়, এটা উপলক্ষ্য মাত্র। ‘মহিলা’, ‘সমকামী’, ‘উভকামী’, ‘রূপান্তরকামী’, ‘লেখক’, ‘কবি’, ‘শিল্পী’, ‘সাংবাদিক’ ‘স্পষ্টবাদী’ -যতই আইন-কানুন লাগু হোক, ‘না-পসন্দ’ হলে এরকম অনেকেরই বিরুদ্ধাচরণ চাইলেই করতে পারে মহামান্য পাবলিক-সোসাইটি, যখন-তখন। ‘প্রতিবন্ধী’ বানিয়ে ‘একঘরে’ করে দেওয়ার প্রথায় এখন বদল এসেছে, ‘স্টাইল’ বা ‘ধরন’ পাল্টেছে, তা নির্মূল হয়নি, হবেও না। ‘ইউনিভার্সাল ট্রুথ’। দর্শন। এ প্রবন্ধ সমাজের সেইসব অনুর্বর মানসিকতার বিরুদ্ধে সামান্য আস্ফালন মাত্র।
অতঃপর...... চিন্তার কিছু নেই, যাঁরা জানেন তাঁরা প্রকৃতই জানেন ‘প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম’-এর অর্থ। তাঁরা ইতিমধ্যেই অপ-নিয়মের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে বেরিয়ে পড়েছেন। নতুন করে নয়, আদি লগ্ন থেকেই কেউ না কেউ 'নিয়ম'-এর বিরুদ্ধে দৃঢ় আঙুল তুলেছেন, তুলছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই ‘অফসাইডার’, নিয়মবিরুদ্ধ অবস্থান গ্রহণকারী।