কয়েক মাস আগের কথা, এক ভদ্রলোক একদিন আমেরিকা থেকে হোয়াটসঅ্যাপে জিজ্ঞেস করলেন, "কি রে এক্ষণ পত্রিকাটা কি বন্ধ হয়ে গেছে?" - ভদ্রলোক চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমেরিকায় থেকেও ভোলেননি এই পত্রিকার কথা। তারপর কত কথা এই পত্রিকা নিয়ে। ওই মানের পত্রিকা নাকি বাংলায় খুব কমই হয়েছে। কমলকুমার মজুমদার, মহাশ্বেতা দেবী, অমিয়ভূষন মজুমদার, রাধারমন মিত্র এদের মতো দিকপালরা এক্ষণ পত্রিকায় লিখতেন। "এক্ষণ" ছিল বাংলা ভাষার অপ্রতিদ্বন্দ্বী সাহিত্য পত্রিকা। বাংলা ভাষার এমন কোনো বড় লেখক নেই যিনি কোনো না কোনো সময়ে "এক্ষণ" পত্রিকায় লেখেননি। আর এই এক্ষণ পত্রিকার দুজন সম্পাদক ছিলেন। একজন নির্মাল্য আচার্য্য এবং অপরজন..... সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়... হ্যাঁ.... জীবন্ত কিংবদন্তী অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়.... পৃথিবী বিখ্যাত অভিনেতা ছাড়া সাহিত্য প্রেমী হিসেবেও যিনি তুলনাহীন।
বাংলা সিনেমার এমন কোন অভিনেতা আছেন বলুন তো যার নাম শুনলেই বাঙালির হৃদয় উদ্বেলিত হয়? ঠিক ধরেছেন... সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। জন্ম ১৯৩৫-এর ১৯ জানুয়ারি, নদিয়ায়। বাড়িতে নাট্যচর্চার পরিবেশ ছিলই। ছোট বয়স থেকেই নাটকে অভিনয় করা শুরু। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে সৌমিত্র ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে বাংলা সাহিত্য নিয়েই স্নাতকোত্তর করেন । কলেজের ফাইনাল ইয়ারে হঠাৎই একদিন মঞ্চে শিশির ভাদুরির নাটক দেখার সুযোগ হয়। জীবনের মোড় ঘুরে যায় সে দিনই। নাটকে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন তিনি। তাঁর থিয়েটার কেরিয়ারে চিরকাল শিশির ভাদুরিকে গুরু বলে মেনে এসেছেন সৌমিত্র। নিজেও বলেছেন, অদ্ভুত এক বন্ধুত্ব ছিল তাঁদের মধ্যে। সব রকম আলোচনা হত দু’জনের মধ্যে। "নীলাচলে মহাপ্রভু" ছবিই তাঁর প্রথম অভিনীত ছবি হওয়ার কথা ছিল। সব কথাও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে স্ক্রিন টেস্টে বাদ পড়ে যান সৌমিত্র। তাঁর জায়গায় নেওয়া হয় অসীম কুমারকে।
১৯৫৮ সাল। সৌমিত্র গিয়েছেন সত্যজিতের ‘জলসাঘর’ ছবির শুটিং দেখতে। সেট ছেড়ে বেরোবেন, এমন সময়ে ডাক পড়ে তাঁর। ডাকেন স্বয়ং পরিচালক। এর পর ঘটনা ঘটেছিল তার জন্য বোধ হয় প্রস্তুত ছিলেন না সৌমিত্র নিজেও। বাংলা সিনেমা জগতের আর এক কিংবদন্তি ছবি বিশ্বাসের কাছে সৌমিত্রকে সত্যজিৎ পরিচয় করিয়েছিলেন এই ভাবে, “এই হল সৌমিত্র। আমার পরবর্তী ছবি অপুর সংসারে ও অপু করছে।”
তারপরের অধ্যায়টা বোধহয় সব বাঙালির জানা। সিনেমার জগতে হাতেখড়ি হয় সৌমিত্রর। "অপুর সংসার"-এর হাত ধরে। প্রথম ছবিতেই বাজিমাত। ফার্স্ট শটেই সিন ওকে। ছবিতে "খাওয়ার পর একটা করে, কথা দিয়েছ", তাঁর আর শর্মিলা ঠাকুরের সেই সংলাপ, তাঁদের রসায়ন, বাঙালি মননে চির-অমলিন।
এসেই যেন লাইমলাইট কেড়ে নিয়েছিলেন এই দীর্ঘাকৃতি, সুদর্শন পুরুষ। মহিলা মনে তুমুল আলোড়ন তোলা অভিনেতাটিকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এর পর একে একে "ক্ষুধিত পাষাণ", "দেবী", "ঝিন্দের বন্দি", "চারুলতা", "কিনু গোয়ালার গলি"... তালিকাটা গুনে শেষ করা যাবে না। সত্যজিতের ১৪টি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন তিনি।
সত্যজিতের সৃষ্টি ফেলুদাকে বড় পর্দায় জীবন্ত করেছিলেন তিনিই। ফেলুদা চরিত্রে এর পরেও বহুবার হয়েছে বড় পর্দায়, ছোট পর্দায় অভিনয় করেছেন অনেকেই। কিন্তু প্রত্যেক বাঙালি একবাক্যে স্বীকার করে নেবেন, সৌমিত্রের মতো কারও পক্ষে ওই চরিত্র ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়নি। অথবা কখনো কি ভুলে যাওয়া সম্ভব হীরক রাজার দেশের উদয়ন পণ্ডিতকে?
জীবনে পেয়েছেন প্রচুর পুরস্কার। ২০০৪ সালে তাঁকে পদ্মভূষণে সম্মানিত করা হয়। এ ছাড়াও তাঁর ঝুলিতে রয়েছে জাতীয় পুরস্কার, দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার আরও অনেক কিছু।
অভিনয় তাঁর একটি সত্তা মাত্র। কবিতাচর্চা, রবীন্দ্রপাঠ, সম্পাদনা, নাট্যসংগঠন তাঁর বিশাল প্রতিভার এক একটি দিক। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সব কিছু নিয়েই অনন্য।এই ৮৬ তে এসেও একই প্রাণশক্তি নিয়ে কাজ করে চলেছেন তিনি।
এত এনার্জি কী করে পান? হেসে বলেছিলেন, “এনার্জি-টেনার্জি নয়, এটিই তো আমার কাজ। এটি না করলে আর কী করব আমি?"..
একবার তাঁকে প্রশ্ন করা হয় যে কোনও দুর্যোগে পতনের মুখে কী ভাবে মোটিভেট করেন নিজেকে?
তাঁর উত্তর ছিল...
"কোনির একটা বিখ্যাত সংলাপ আছে, যা প্রায় আইকনিক হয়ে গিয়েছে। খিদ্দা বলছে, ‘‘ফাইট কোনি, ফাইট।’’ আমিও চূড়ান্ত বিপর্যয়ে নিজেকে বলি, ফাইট, সৌমিত্র ফাইট।"...
মহাকালের সঙ্গে জীবনের এই যুদ্ধটায় বহু ফাইট করেও আর জিততে পারলেন না "খিদ্দা"।
অমৃতলোকের পথে রওনা দিলেন আমাদের সকলের প্রিয় সৌমিত্র 'অপু' চট্টোপাধ্যায়...