ভারতীয় চলচ্চিত্র-সাহিত্য-নাট্য জগতের এক যুগের অবসান

ভারতীয় চলচ্চিত্র, সাহিত্য, নাট্যজগৎ এর এক অপূরণীয় ক্ষতি বললে বোধহয় তা কমই বলা হয়, কারণ প্রায় একটা গোটা যুগ তিনি অবিকৃত ধরে রেখেছিলেন তাঁর অনুশীলন, প্রজ্ঞা আর শিরদাঁড়া; কখনই ক্ষমতা-জবরদস্তি'র কাছে খাটো হতে দেননি তাঁর ব্যক্তিগত ভাবধারা, ভাষা, কাজ কে। ১০ জুন, সোমবার ৮১ বছর বয়সে বেঙ্গালুরুতে ভারতীয় চলচ্চিত্র-সাহিত্য-নাট্য জগতের এক যুগের অবসান ঘটিয়ে চলে গেলেন সেই 'সোজা শিরদাঁড়া'র ব্যক্তিত্ব গিরীশ কারনাড।

বার্ধক্যজনিত সমস্যায় বহুদিন ধরেই ভুগছিলেন তিনি। চার দশকের বেশি সময় ধরে তিনি যুক্ত ছিলেন নাট্যচর্চার সঙ্গে। লিখেছেন বহু কিংবদন্তি নাটক। তিলোত্তমার সঙ্গে তাঁর ছিল আত্মিক টান, যে টানে শহরবাসীর কাছে গিরিশ ঘোষের শহরে গিরিশ কারনাডও হয়ে উঠেছিলেন রীতিমত নাট্য-লেজেন্ড। তাঁর নাটক থেকে দেবেশ চট্টোপাধ্যায় যখন 'হয়বদন' করেন, অবন্তী চক্রবর্তী করেন 'নাগমন্ডলা' অথবা সঞ্জীব রায় করেন 'ঘোড়ামুখো পালা' তখন নাট্য-সংস্কৃতিপ্রেমীদের ভিড় উপচে পড়ে থিয়েটারের কোনায় কোনায়। ১৯৬১ সালে তাঁর কলমে প্রথমবার উঠে আসে ঐতিহাসিক-পৌরাণিক প্রেক্ষাপটের নাটক 'যযাতি', যা বর্তমানে অক্সফোর্ডে সংরক্ষিত রয়েছে। চতুর্দশ শতাব্দীর সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলককে কেন্দ্র করে তাঁর 'তুঘলক'(১৯৬৪) নাটক নাট্যজগতের এক অন্যতম মাইলস্টোন তাতে দ্বিমত নেই।

কন্নড় ভাষায় লেখা তো বটেই তাঁর সৃষ্ট সাহিত্য আপামর পৃথিবীর কাছে নন্দিত। থিয়েটার ও সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন সর্বশ্রেষ্ঠ 'জ্ঞানপীঠ' পুরস্কারও। তাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞার বাতাবরনে সমৃদ্ধ ছিল তাঁর প্রতিটি কাজ, অক্ষর। ১৯৭৪-এ পেয়েছেন 'পদ্মশ্রী' এবং ১৯৯২-এ ভারত সরকারের তাঁকে দিয়েছে 'পদ্মভূষণ' সম্মাননা। 

হিন্দি ছাড়া আরও বেশ কিছু ভাষায় অভিনয় করেছেন। বহু কালজয়ী নাটক এবং সিনেমায় নির্দেশক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। ১৯৭০ সালে ‘সংস্কার’ ছবি দিয়ে বড় পর্দায় যাত্রা শুরু করেন তিনি। অভিনয় করেছেন ‘নিশান্ত’, ‘মন্থন’, ‘স্বামী’, ‘পুকার’-এর মতো সাড়া জাগানো ছবিতে। বড়পর্দার সঙ্গে ছোট পর্দায়েও গিরিশ কারনাড সমান জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৮৬-৮৭ সালে জনপ্রিয় টিভি ধারাবাহিক ‘মালগুড়ি ডেজ’-এ তাঁর অভিনয়-উপস্থিতি এখনও স্মরণীয়।  ১৯৭১ সালে কন্নড় ছবি ‘বংশবৃক্ষ’র মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে যাত্রা শুরু করেন গিরিশ কারনাড। এ ছবির জন্য তাঁর হাতে উঠে এসেছিল 'সেরা পরিচালক' এর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ১৯৮৪ সালে শুদ্রক রচিত চতুর্থ শতাব্দীর সংস্কৃত নাটক 'মৃচ্ছকটিকা' অবলম্বনে বানিয়েছিলেন হিন্দি ছবি 'উৎসব', যা সেসময় ব্যপক সমালোচিত হয়েছিল। 'কমার্শিয়াল' নয় তাঁর উপস্থিতি ছিল ভিন্ন ঘরানার ছবিতে, তবে বেশ কিছু তথাকথিত বাণিজ্যিক ছবিতেও দেখা মিলেছে তাঁর। ২০০৫ সালে মুক্তি পায় ‘ইকবাল’। এই ছবিতে তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হয় দর্শকমহলে। সলমান খানের সঙ্গেও তিনি দুটি অভিনয় করেন, একটি ২০১২ সালে ‘এক থা টাইগার’ এবং অন্যটি ২০১৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘টাইগার জিন্দা হ্যায়’।

শুধু নিজের কাজ নয়, বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক, সামাজিক নানা ঘটনায় বারবার সাহসী-অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন প্রকৃত সচেতক শিল্পীর মতোই। সমাজের বিভিন্ন সমস্যা বারংবার উচ্চারিত হয়েছে তাঁর কলমে। তাঁর নাটকে বারবার মাথাচাড়া দিয়েছে বিতর্ক, তবু চুপ করে থাকেননি কখনও। অসুস্থ অবস্থায় নাকে নল গুঁজে সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদেও সামিল হতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে এবং ওই সময় নিজেকে ‘আরবান নকশাল’ বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা করতেও কোনও সংশয় প্রকাশ করেননি ১৯৩৮ সালের ১৯ মে মহারাষ্ট্রের মাথেরানে জন্মগ্রহণ করা গিরিশ কারনাড। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। পড়াশোনার সূচনা হয়েছিল কর্ণাটকে। অঙ্ক ও সংখ্যাতত্ত্বে স্নাতক করেন। পরবর্তী পড়াশোনা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন নিয়ে। বিয়ে করেন সরস্বতী গণপতিকে। তাঁদের দুই সন্তানও রয়েছে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় শোক জ্ঞাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে সিনেমা-নাট্য-শিল্পসংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত অগনিত ব্যক্তিত্ব। তাঁর মত মহীরুহ পতনে শোকের ছায়া সারা দেশ জুড়ে।

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...