মানবদেহের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ তিনি। তার চলন থামলে, থেমে যায় জীবনের চলন। মানবদেহ যদি হয় একটি যন্ত্র, সেই যন্ত্রের প্রধান চালকও তিনি। তাই প্রয়োজন পড়ে তার খেয়াল রাখার। যন্ত্র মানেই তো সে বিগরোবে। আবার ঠিকও হয়ে যাবে সঠিক পরিচর্যা পেলে।
তিনি হলেন হার্ট। হৃৎপিণ্ড। একটা সময় পর্যন্ত ভারতবর্ষে হার্ট সার্জারি ছিল অত্যধিক ব্যয়বহুল। ছিল সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। অতএব সাধারণ মানুষের সেই সাধারণ যন্ত্র বিকল হওয়া শুরু করলে, সম্ভব হতোনা সঠিক সময়ের সঠিক চিকিৎসার। প্রাণ খোয়াতে হতো অগুনতি মানুষকে। কারণ দেশের সিংহভাগই তো সাধারণ। আর সাধারণের কথা কেই বা... এর পরের অসম্পূর্ণ কথাটি সম্পূর্ণ করেন এক মানবদরদী। এক ডাক্তার। হয়ত ঈশ্বর না হলেও, বলা চলে ত্রাতা। তাঁর দৌলতেই দেশের সাধারণ মানুষ আজ স্বপ্ন দেখে বাঁচার।
বিশ শতকের প্রথমদিকের কথা। মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি। যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চবিত্ত সমাজের বিলাসিতার উপকরণ তখন গাড়ি। আর স্বাভাবিক ভাবেই মূল্যের নিরিখে তা ছিল মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। তাহলে সাধারণ মানুষ স্বপ্ন দেখবেন না গাড়ি কেনার? এই প্রশ্নের উত্তরে মানুষের জন্য গাড়ি তৈরি করলেন হেনরি ফোর্ড। হ্যাঁ, ফোর্ড কোম্পানির প্রাণপুরুষ।
কিন্তু ফোর্ড শুধু স্বপ্ন টুকুই দেখেছিলেন। কোন রাস্তায় হাঁটলে পূরণ করা যাবে সেই মহার্ঘ্য স্বপ্ন, জানা ছিল না সেই রাস্তা। বুঝলেন একমাত্র উৎপাদন কৌশলীর বদলেই সম্ভব স্বপ্ন পূরণ। শুরু হল ‘অ্যাসেম্বলি লাইন’ নামের নতুন প্রক্রিয়া। একটা গাড়ি তৈরির পিছনে যে সময় ব্যয় হতো, সাশ্রয় হলো তাও। বিভিন্ন ভাগে ভেঙে দেওয়া হলো গাড়ি তৈরির প্রক্রিয়া। বেঁচে গেলো সময় আর বেঁচে গেলো অর্থের অপচয়।
ঘুরে গেলো মধ্যবিত্তের ভাগ্যের চাকা। এবারে গাড়ির দোকানে বুক ফুলিয়ে লাইন দিলেন সাধারণ বাড়ির মানুষ। স্বপ্ন পূরণ হলো অনেকের। এরপরের গল্প, নব্বইয়ের দশকের কলকাতা। বিড়লা হার্ট ফাউন্ডেশনের এক ডাক্তার মুখোমুখি হলেন অদ্ভুত অভিজ্ঞতার। এমন অনেক হৃদরোগী দেখতে পেলেন, যাদের অধিকাংশেরই অবস্থা গুরুতর। বাঁচানো সম্ভব নয় অস্ত্রোপচার ছাড়া। কিন্তু বেপাত্তা সেই রোগীদের অধিকাংশই। ডাক্তারবাবু ঠিক করলেন এর একটা বিহিত প্রয়োজন। কেন এতটা অযত্ন রোগীরা? বুঝলেন, এর কারণ একমাত্র অর্থ। হার্ট সার্জারির ব্যয়বহুলতা। সেসময়ের নিরিখে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা।
সেসময় দেশের মাত্র পাঁচ শতাংশ জনগনের হেলথ ইন্স্যুরেন্স রয়েছে। সকল স্বাস্থ্যসেবার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই আসে সরাসরি রোগীর পকেট থেকে। আকছার খবর পাওয়া যায় চিকিৎসা ব্যয় বহনের জন্য জনগণের এক বড় অংশকে হয় টাকা ধার নিতে হয়, অথবা বিক্রি করতে হয় তাদের সম্পত্তি। কেউ কেউ বেছে নেন আত্মহননের পথ।
ডা. বুঝলেন, অবস্থার উন্নতি করতে হলে সার্জারির খরচ কমানোর কোনও বিকল্প নেই। তবে? প্রয়োজন এমন কোনও প্রক্রিয়ার যেখানে বিনা বাঁধায় সম্ভব হবে সাধারণ মানুষেরও অস্ত্রোপচার। তৈরি হলো এক আদর্শ মডেল। তিনি আরও জানতেন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে একেবারেই সম্ভব নয় হার্ট সার্জারি। কারণ তাতে সাহায্য করা সম্ভব হবে মাত্র কয়েকশো লোককে। তারপর অর্থের টানে থেমে যাবে ব্যবস্থা। একুশ শতকের শুরু তখন। ২০০১ সালে ব্যাঙ্গালুরুতে প্রতিষ্ঠা হলো ‘নারায়না হেলথ’ (NH)। মাত্র ২২৫ শয্যার হাসপাতাল হিসেবে শুরু হলো মানবসেবার অন্য যাত্রা।
এ পর্যন্ত নারায়না হাসপাতালে লক্ষাধিক অস্ত্রোপচার হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক রোগীই দরিদ্র শ্রেণীর। কেউ স্বল্পমূল্যে, কেউ বিনামূল্যে চিকিৎসা পেয়েছেন। প্রতিনিয়ত বেড়েছে রোগীর সংখ্যা। দেড় লক্ষ্য থেকে খরচ কমিয়ে আনা হয় নব্বই হাজারে। যুক্তরাষ্ট্রে ১,৪৪,০০০, মেক্সিকোতে ২৭,০০০ ও কলাম্বিয়ায় ১৪,৮০০ ডলার প্রয়োজন হতো যেখানে একটা অপারেশন এর জন্য।
আর এই অসাধ্য সম্ভব হয়ছে শুধুমাত্র একটা প্রকৌশলীর বদল আনায়। সেই অ্যাসেম্বলি লাইন! একটি অপারেশনাল থিয়েটারের প্রথম কক্ষে একজন রোগীকে অস্ত্রোপচারের পর সেলাই করা হচ্ছে। তখন পাশের কক্ষে হয়ত অন্য রোগী প্রস্তুত হচ্ছেন অস্ত্রোপচারের জন্য। এভাবে, প্রতি মুহূর্তে প্রায় পাঁচজন রোগীর অপারেশন করা হয় একইসঙ্গে। একজন ডাক্তার বা নার্স একই কাজ করে থাকেন সকল রোগীর ক্ষেত্রে।
বিশেষজ্ঞ সার্জনের সংখ্যা যেহেতু সীমিত, তাই প্রয়োজন সময়ের যথাযথ ব্যবহার। সাধারণত যা হয়, একজন বিশেষজ্ঞ সার্জন ও অন্য সকল ডাক্তার নার্সরা উপস্থিত থেকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অপারেশন করে থাকেন। অথচ কিছু কাজের ক্ষেত্র কেবলমাত্র কিছু ডাক্তার বা নার্সের তত্ত্বাবধানেই সম্ভব। বিশেষজ্ঞ সার্জনের পুরোটা সময় এক্ষেত্রে ব্যয় করার কোনও প্রয়োজনই পড়ে না।
এই ভাবনার বদলেই সম্ভব হলো সুলভ মূল্যের সার্জারি। অন্যান্য ডাক্তার নার্সরা একজন রোগীকে সার্জারির জন্য সম্পূর্ণ তৈরি করে রাখেন। তারপর আসেন সার্জেন। একটা অপারেশন হতে না হতেই তৈরি থাকেন অন্য রোগী। যেখানে অন্যান্য হাসপাতাল গুলোতে প্রতিদিন গড়ে মাত্র চার-পাঁচটি অস্ত্রোপচার করা হয়, সেখানে এই হাসপাতালে এ সংখ্যা ত্রিশেরও বেশি। সময়ের সাশ্রয়ই কমিয়ে আনে অস্ত্রোপচারের ব্যয়।
নারায়না হাসপাতাল কখনও তার কোনও রোগীকে অর্থের অভাবে পিঠ দেখায়নি। দান নয়, এ সম্ভব হয়েছে ‘ভর্তুকি মডেল’ অনুসরণ করে। ধনী ব্যক্তিরা দরিদ্রদের জন্য ভর্তুকি দেন, আর তাতেই সম্ভব হয় চিকিৎসা। ঘাটতি থাকেনা মানে, সুবিধা ধনী দরিদ্র্য নির্বিশেষে সকলের জন্য এক। নারায়না হেলথ এখন ২৩টি হাসপাতাল, ৭টি হার্ট সেন্টার ও ১৯টি প্রাথমিক সেবা কেন্দ্রের এক বিশাল নেটওয়ার্ক। রয়েছে ছয় হাজারেরও অধিক শয্যা। আর এই স্বপ্ন সাধনের রূপকার অন্য কেউ নন, তিনি ডা: দেবী শেট্টি। এগিয়ে চলুক চিকিৎসার বিজ্ঞান, এগিয়ে চলুক মানবসেবা। জন্মদিনের শুভেচ্ছা ডাক্তারবাবু কে।