বৈশাখে আজ পান্তা ভাতের গল্প। পান্তা ভাতের মাধ্যমে জীবনের সারল্য প্রকাশ পায়। সাধারণত খেটে খাওয়া মানুষের খাবার বলেই এটি পরিচিত। গ্রীষ্মে শরীরকে ঠান্ডা রাখতে এর জুড়ি মেলা ভার।
হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী, ভগবানের ভোগ হিসাবে পান্তাভাতের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। চণ্ডীমঙ্গলে পান্তাভাতের উল্লেখ আছে। পান্তা ভাতের আরেক নাম কাঞ্জি। পান্তা ভাতের জলকে কাঞ্জি বলা হয়। কাঞ্জি বড়াও খাওয়া হয়। জ্যৈষ্ঠ মাস জুড়ে বৈষ্ণবরা রাধাকৃষ্ণকে পান্তা ভোগ দেন, এর নাম পাকাল ভোগ বা পাকাল ভাত। এতে থাকে পান্তাভাত, দই, চিনি, কলমি শাক ভাজা এবং দুই-এক রকমের নিরামিষ তরকারি। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে জগন্নাথ দেবের ভোগ হিসেবে পান্তা ভাত দেওয়া হয়।
মা দুর্গাকেও দশমীতে পান্তা ভাত ভোগ দেওয়া হয়। কথিত আছে গ্রামের মেয়ে উমা অনেক দূর পেরিয়ে শ্বশুর বাড়ি যাবেন। বিগত চারদিন বাপের বাড়িতে ভাল মন্দ খাওয়ার পরে, শেষ সহজপাচ্য ও শরীর ঠান্ডা করার জন্য এই ভোগ দেওয়া হয়। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে যাতে ছেলেপুলেরা শ্মশানবাসী বাপের কাছে ভাল খাবারের গল্প না করতে পারে, তার জন্য দেওয়া হয় পান্তাভোগ। আবার অনেকের মতে, মেয়ে চলে যাচ্ছে। এই দুঃখে মা-বাবা আগের দিনের রান্না করা খাবার খায়। অনেক বনেদি বাড়িতে এখনও এই রীতি মানা হয়। একই ভোগে থাকে পান্তাভাত, ইলিশ মাছ, কচুর শাক, কচুরলতি বাসি তেঁতুল অথবা আমসির চাটনি এবং মাছের মাথা দিয়ে অম্বল। আবার এও বলা হয়, কৈলাসে ফিরে মহাদেব মাকে জিজ্ঞাসা করবেন, কী খেয়ে এলে? মা উত্তর দেবেন গরিব বাবা এর বেশি কিছু খাওয়াতে পারেননি।
বাঙালির প্রিয় এই পান্তা ভাতের সঙ্গে কী থাকবে, তা নিয়ে অঞ্চলভেদে পার্থক্য দেখা যায়। মাটির হাঁড়িতে রাখা পান্তাভাত পরিবেশন করা সময় জল ছেঁকে নেওয়া হয়। দরিদ্র মানুষেরা পান্তাভাতের সঙ্গের বাহারি পদ দিয়ে সাধারণত খান না। কাঁচালঙ্কা, শুকনো লঙ্কা পোড়া, কাঁচা পেঁয়াজ, নুন আর সরষের তেল, আবার কখনও শাকভাজা, তেঁতুল ইত্যাদি দিয়েও খাওয়া হয়।
পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূমের মানুষেরা এর সঙ্গে মাছের টক, পোস্তবাটা অথবা বড়া খেতে ভালবাসেন। কুড়তি কলাইবাটা, কলাইগুড়ো, শাকভাজা, গন্ধরাজলেবু এবং ডালের বড়া দিয়ে পান্তা ভাত খুব উপাদেয় লাগে খেতে। পূর্ববঙ্গে পান্তা ভাতের সঙ্গে শুঁটকি মাছের ভর্তা খাওয়ার প্রচলন আছে। বরিশালে একে পুস্তি বলা হয়। ঢাকায় বাংলা নববর্ষের খাবার হিসেবে পান্তা ভাত খাওয়ার চল রয়েছে।
গ্রীষ্মের রাতে লণ্ঠনের আলোয় মাটির দাওয়ায় বসে মাঝখানে মাটির হাঁড়িতে পান্তাভাত গ্রীষ্মকালে গ্রাম বাংলার একটি পরিচিত দৃশ্য। কিছুটা এলিয়ে পড়া পান্তাভাত ও আমানি বাংলার এক নিজস্ব খাবারও বলা যেতে পারে। তবে নিছক রসনা তৃপ্তিই নয়। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণিত, গরম ভাতের তুলনায় পান্তার উপকারিতা বেশি। অনেক পুষ্টিবিদদের দাবি, পান্তা ভাতের পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা থাকে এবং গরমে শরীর ঠান্ডা রাখে। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় দেখা গেছে, গরমে শরীরে জলের অভাব দূর করে তাপমাত্রার ভারসাম্য বজায় রাখে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। দীর্ঘক্ষণ ভাত ভিজিয়ে রাখার ফলে সহজপাচ্য হয় এর ফলে পেটের রোগ, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
'পান্তাভাতে টাটকা বেগুন পোড়া'- গরম পড়লেই বাংলার মাঠে-ঘাটে-ঘরে এই গানটির গুনগুন প্রায়ই শোনা যায়। এককথায়, গরমের ঠান্ডা হওয়ার আদি প্রথা। রাতের গরম ভাতে জল ঢেলে মাটির হাঁড়িতে রাখা হয়। বাংলাদেশে জলকে বলা হয় পানি। পানিতে ভাত ভেজানো হয় বলে হয়ত এর নাম 'পান্তাভাত' হয়েছে। একে আবার ভাত সংরক্ষণের প্রাচীন পন্থাও বলা যেতে পারে। গ্রামবাংলার খেটে খাওয়া মানুষদের কাছে এই ভাত গরমে যেমন তাদের শরীর ঠান্ডা রাখে, পাশাপাশি শক্তিও জোগায়। দিনের প্রধান খাবার হিসাবে তারা পান্তা খেয়ে থাকে। পান্তাভাতের সঙ্গে থাকে কাঁচালঙ্কা বা শুকনো লঙ্কা পোড়া, কাঁচা পেঁয়াজ, সরষের তেল ও নুন। আর সঙ্গে থাকে ডালের বড়া অথবা মাছ ভাজা বা তরকারি। এই পান্তাভাতের জল থেকে তৈরি করা হয় আমানি। এই আমানি একধরনের দেশি ঠান্ডা পানীয়। তবে এটি বেশি গেঁজিয়ে একধরনের সুরাও তৈরি করা হয়। গ্রামেগঞ্জে এর প্রচলন দেখা যায়। বাংলার লোকজ ছড়া, গানে পান্তা ভাতের ছড়াছড়ি, একটি রাখালের ছড়ায় রয়েছে; -" পান্তা খেয়ে শান্ত হয়ে কাপড় দিয়ে গিয়ে। গরু চড়াতে পাঁচন হাতে রাখল ছেলে যায়।" পান্তাভাত হল বাঙালির নস্টালজিয়া। এর সঙ্গেই বাঙালির সুখ-দুঃখের স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে।