পাড়ায় পাড়ায় ছেলে-বুড়ো মিলে পুজো বার্ষিকী প্রকাশের টান আজও অটুট

“ পূজা সমাসন্ন। শহুরে মনের আকাশে ছুটির বাঁশি বেজে উঠব, শহরের একদল বাইরে বেরোবার জল্পনা- কল্পনায় মুখর, সাজ সরঞ্জাম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আর যারা থাকবে তারা সার্বজনীন উৎসবের আয়োজনে চাঁদার খাতা পাড়ায় পাড়ায় হুড়োহুড়ি লাগাবে, পূজার বাজার নরনারীর ভিড়ে ঠাসাঠাসি। আর আমরা যারা সংবৎসর প ত্রিকার পাতা ভ্রাবার কাজ নিয়ে কাটাই, এ সময়টা তাদের কাছে রস-কষহীন। মহালয়ার আগেই পূজাসংখ্যা বার করতে হবে, তাও যে-সে আকারেরে নয়, একখনা পুরু টালি...”

শারদীয়া পত্রিকা ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে যে দীর্ঘ তোড়জোড় পর্ব তারই স্মৃতি উঠে এসেছে সাগরময় ঘোষের স্মৃতিকথায়। পুজো তখনও বাঙালির কাছে ‘পূজা’। ফি বছর শারদ উৎসব শুরুর আগে প্রবাসী আত্মীয়দের যেমন চিঠি আসত পুজো বার্ষিকীর টানও ছিল ঠিক সেরকম। পাঠক, লেখক, সম্পাদক থেকে সাহিত্যচারী জনতা সকলের কাছে এ ভারী আকর্ষণের। কিন্তু সেই পত্রিকা জন্মের কাহিনীও কম রোমাঞ্চকর নয়।

পুজোর প্রায় তিন মাস আগে থেকে চিঠি যেত সাহিত্যিকের কাছে। চিঠির বয়ান থাকত অনেকটা এরকম-

“শারদীয়া পত্রিকার উদ্যোগ-আয়োজন শুরু হইয়াছে। এই কাজে আপনার সক্রিয় সহযোগিতা সর্বদাই আমরা পাইয়াছি, এবারেও তাহা হইতে বঞ্চিত হইব না, ইহাই আমাদের বিশ্বাস। আপানার কাছে আমাদের একান্ত অনুরোধ, একটি রচনা পাঠাইয়া শারদীয়া সংখ্যার সমৃদ্ধি বর্ধনে সহায়তা করুন। আশাকরি, আগামী ৭ আগস্টের মধ্যে আপনার রচনা আমাদের হস্তগত হইবে। আপনার সম্মতিসূচক পত্র পাইলে কৃতজ্ঞ হইব। ইতি-...”

পত্রিকার নাম ও দফতর ভেদে বদলে যেত চিঠির বয়ান। দশ দিনের মধ্যে উত্তর আশা করা হত। ডাকে উত্তর না মিললে সাহিত্যিকদের বাড়ি পর্যন্ত চলে যেতেন পত্রিকার উদ্যোক্তারা। উদ্দ্যেশ্য শারদীয়া পত্রিকার রসদ সংগ্রহ।

শারদীয়া পত্রিকার রসদ সংগ্রহের এমন ধারা বড় পত্রিকা থেকে ছোট পত্রিকা সব জায়গাতেই। কখনও পাড়ার আড্ডার ঠেক,রক, মায় চায়ের দোকান থেকেও জন্ম নিয়েছে বাঙালির ‘পূজা বার্ষিকী’র আইডিয়া। শুধুমাত্র নামকরা সাহিত্যিক নয় এখানে লিখিয়ে সবাই। কেউ কবিতা কেউ গল্প। কেউ ভ্রমণ কাহিনি। অশীতিপরের মনেও বাল্যের ছটফটানি আর উৎসাহ। অনেক সময় ক্লাব থেকেও বেরত এমন পুজো সংখ্যা। চাঁদার বিল কাটার সময় সঙ্গে একটু বেশি চাওয়া। বিলের সঙ্গে গোলাপী বা সবুজ মলাটের রোগা পাতলা ম্যাগাজিন। সেবারের পুজো সংখ্যা। ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখার আনন্দ দুগগা ঠাকুর দেখার আনন্দের থেকে কিছু কম নয়। সাহিত্যমান নয়, নিজের কথা নিজের কলমে লেখার আনন্দে মশগুল।

সাহিত্যপাঠের অভ্যাস ফি বছর এভাবেই ছড়িয়ে যেত বাঙালির অন্দরে। লেখকের সঙ্গে পাঠক-পাঠিকাদের উৎসাহ কিছু কম নয়। পুজো বার্ষিকীর বিজ্ঞাপনে থাকত চোখ। কে কে লিখছে, বিষয় কী, কবিতা বেশি না গল্প- কৌতুহল হাজাররকম। বিজ্ঞাপনের সূচিতে পেনের দাগ পড়ত হলুদ লাগা আঙ্গুলেও। হেঁশেলে পুজোর আয়োজন সামলে দুপুরবেলা বই পড়ার নেশা। তখনও সিরিয়াল আসেনি বাঙালির জীবনে। নভেলের চরিত্ররাই হয়ে উঠত আড্ডার দোসর। পাড়ার রক থেকে মেয়েলি আড্ডার অন্দরমহলে। এমন কি প্রেমিক-প্রেমিকার চিঠিতেও।

পুজো সংখ্যা বেরনোর সঙ্গে সঙ্গে হাতে পাওয়া যেন এক কী দারুণ গৌরব। পুজোর চারটে দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে। তারপর যেন আমেজ থাকে না। অনেকটা সকালের গরম চায়ের মতো। রোদ চড়লে আর সেই আমেজ থাকে না।

অনেক সময় পুজোর উপহার হয়ে উঠত পুজো বার্ষিকী। ছোট থেকে বড়ো সকলের পুজোর বই। বৈঠকখানা ঘরে পুজো বার্ষিকী যেন আলাদা গ্ল্যামার। তাতে খানিক ভান থাকলেও, সাহিত্যের মূল্যকে অস্বীকার করবে কে!

পুজো বার্ষিকী এখনও বার হয়, তবে মহালয়ায় না, তারও অনেকটা আগে। উদ্দীপনাও দেখা যায়। কিন্তু পুজো বার্ষিকীর ডাকে আগমনীর সেই ঘ্রাণ কোথাও যেন খানিক ফিকে হয়ে গিয়েছে। এত পুজো বার্ষিকীর ভিড়ে যেন হারিয়ে যায় পাঠের আসল মজাটাই। তবে পাড়ায় পাড়ায় ছেলে-বুড়ো মিলে পুজো বার্ষিকী প্রকাশের টান আজও অটুট।       

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...