আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলার দিকেই মন দিতে চাইছেন ইস্টবেঙ্গল কোচ। আইএসএলে এখনও পর্যন্ত দু'টি ম্যাচ খেলেছে তারা। দু'টিতেই হারতে হয়েছে।
দুর্গোৎসব শেষ হতেই ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছে এই সময়ের ভারতীয় ফুটবলের শীর্ষ স্তরের পেশাদার ফুটবল লীগ ২০২২-২৩ এর আইএসএল। "সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল!" মান্না দের গাওয়া এই গানের প্রতিটা শব্দ আজও বাঙালি মেনে চলে। সত্যি "আহা কি মধু আছে ওই তোমার নামেতে আহা ফুটবল"।
এক সময় ভারতের ফুটবলের শাসন ছিল কলকাতার হাতে। চলত দুই প্রধানের জমিদারি। তাই "রকে রকে ঝগড়া, ঘরে ঘরে ডাইভোর্স, ইলিশে ঘটিতে রসাতল" লেগেই থাকত। আইএসএলের ইতিহাসে চোখ দিলেও বাংলা ফুটবলের সেই তেজ লক্ষ্য করা যায়। যদিও এটলিটিকো দ্য কলকাতা দুই প্রধানের বদলে নিজের নাম নথিভুক্ত করে ইতিহাসের পাতায়। শেষ দুই মরসুম থেকে বাঙালির আবেগ ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান যুক্ত হয় আইএসএলে।
নতুন কোচ, নতুন স্পনসর নিয়ে এবারে নতুন ভাবে মাঠে নেমেছে ইস্ট বেঙ্গল। যদিও এবারের মরসুম শুরুর আগেই ইস্টবেঙ্গলের কোচ স্টিভন কনস্ট্যান্টাইন বলেছিলেন, দল প্লে-অফে গেলে তা অলৌকিক হবে। কেন এ কথা বলেছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া গেল প্রথম ম্যাচেই। আইএসএলের প্রথম ম্যাচে কেরল ব্লাস্টার্সের কাছে ১-৩ গোলে হেরে মরসুম শুরু করল ইস্টবেঙ্গল। গত দু'বারের থেকে এ বার তাদের দল অনেক ভাল এবং অভিজ্ঞ। তা সত্ত্বেও প্রথম ম্যাচে হার আটকানো গেল না। চিন্তায় রাখল ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণ। কেরলের হয়ে জোড়া গোল করলেন ইভান কালিউঝিনি। একটি গোল আদ্রিয়ান লুনার। ইস্টবেঙ্গলের একমাত্র গোল অ্যালেক্স লিমার।
দু'বছর পরে হোম এবং অ্যাওয়ে ফরম্যাটে ফিরেছে আইএসএল। ফলে কোচির স্টেডিয়ামে আবার তৈরি হল সর্ষের ক্ষেত। হলুদ জার্সি পরে ম্যাচের অনেক আগে থেকেই ভিড় জমিয়েছিলেন সমর্থকরা। ম্যাচের এক ঘণ্টা আগেই ৬০ হাজারের স্টেডিয়ামের ৭৫ শতাংশ পূর্ণ হয়ে যায়। ভরা গ্যালারির সামনে খেলা যে চাপ, সেটা কনস্ট্যান্টাইন অস্বীকার করেননি। দেখা গেল, সেই চাপ সামলাতে না পেরে কেঁপে গেলেন তাঁর ফুটবলাররাও। শুরু থেকেই ম্যাচের দাপট ছিল কেরলের। শেষ মিনিট পর্যন্ত সেই দাপট অব্যাহত থাকল। সুযোগ ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারলে তাদের জয়ের ব্যবধান অনেক বেশি হতে পারত। ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণ ভাগের যা হাল, তা অবিলম্বে মেরামত না করতে পারলে এ বারও কপালে দুঃখ থাকতে পারে।
প্রথম ম্যাচে কেরালার বিরুদ্ধে হারার পরে দ্বিতীয় ম্যাচে নামার আগে কোচ স্টিফেন কনস্ট্যানটাইন দাবি করেন অন্য দলের বাতিল ফুটবলারদের নিয়ে দল গড়া হয়েছে। যদিও সেই ফুটবলাররাই দলের শক্তি হয়ে উঠবেন বলে মনে করছেন কোচ।
দলের মধ্যে জেতার খিদে দেখতে চাইছেন কনস্ট্যানটাইন। সাংবাদিক বৈঠকে লাল-হলুদ কোচ বলেন, "আমাদের সঙ্ঘবদ্ধ হতে হবে। শক্তিশালী হতে হবে এবং ছোটখাটো ভুল করা চলবে না। আমাদের দলের ছেলেদের অনেক কিছু প্রমাণ করার আছে। বিশেষ করে ভারতীয়দের। যাদের অন্য সব ক্লাব বাতিল করে দেওয়ার পরে তারা এই ক্লাবে যোগ দিয়েছে। তাই প্রত্যেকে প্রতি ম্যাচে নিজেদের প্রমাণ করার সুযোগ পাবে।"
কোচের দাবি কেরালার বিরুদ্ধে প্রথম ৭০ মিনিট ভাল খেলেছিল ইস্টবেঙ্গল। ওই ম্যাচে ইস্টবেঙ্গল ১-৩ গোলে হেরেছিল। কনস্ট্যানটাইন বলেন, "কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে প্রথম ৭০ মিনিটের কথা ভাবছি আমি। ওরা তো গত দু'বছর ধরে একসঙ্গে খেলছে। আমরা ভালই খেলেছি। অন্য দল হলে হয়তো আত্মসমর্পণ করত। চার-পাঁচ গোল খেয়ে নিত। কিন্তু আমাদের দল সে রকম নয়।"
ইস্টবেঙ্গল দলে সে ভাবে টাকা নেই বলে জানিয়েছেন কোচ। তিনি বলেন, "অন্যান্য দলের যে রকম বাজেট রয়েছে, আমাদের তা নেই। আড়াই-তিন মাসের প্রাক মরসুম প্রস্তুতিও করতে পারিনি আমরা। মাত্র ৪ সপ্তাহ পেয়েছি। এই প্রস্তুতির পরে লোকে যদি মনে করে আমরা সেরা চারে বা ছয়ে থাকব, তা হলে তাদের আর একটু বাস্তববাদী হওয়া দরকার। পরিবর্তনের মধ্যে আমাদের নতুন খেলোয়াড় এসেছে, নতুন দল, নতুন কোচ ও স্টাফ। একটু সময় তো দিতেই হবে।"
কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচে শেষ মুহূর্তের গোলে গোয়ার কাছে হার হয় ইস্টবেঙ্গলের, এদু বেদিয়ার ফ্রিকিকে নিশ্চিত এক পয়েন্ট হাতছাড়া হল স্টিভন কনস্ট্যান্টাইনের দলের। শেষ মুহূর্তে স্বপ্নভঙ্গ ইস্টবেঙ্গলের। খেলা শেষের কয়েক মুহূর্ত আগে গোল খেয়ে ঘরের মাঠে এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে হারে। প্রথমার্ধে ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণে দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে গোয়াকে এগিয়ে দেন ব্রেন্ডন ফের্নান্দেস। দ্বিতীয়ার্ধে পেনাল্টি থেকে সমতা ফেরান ক্লেটন সিলভা। খেলা শেষের কয়েক সেকেন্ড আগে বেদিয়ার ফ্রিকিক গোয়ার জয় নিশ্চিত করে।
ম্যাচের শুরুটা ইস্টবেঙ্গলের কাছে মোটেই ভাল হয়নি। প্রথম থেকেই ম্যাচের রাশ নিজেদের হাতে রাখার পরিকল্পনা করে নেমেছিল গোয়া। শুরুতে ইস্টবেঙ্গল একটা সুযোগ পেলেও, পাল্টা আক্রমণ শানাচ্ছিল গোয়া। তবে আচমকা যে তারা গোল পেয়ে যাবে, এটা কেউই ভাবতে পারেননি। গোয়াকে গোল কার্যত উপহার দিল ইস্টবেঙ্গল।
পরপর দুটো হারের পর স্টিফেন কনস্ট্যানটাইন দাবি করলেন, আইএসএলে ইস্টবেঙ্গল ভাল খেলে হেরেছে। লাল-হলুদ কোচের দাবি, গত ম্যাচে তাঁরা আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলেছেন। আগামী ম্যাচে দলকে আরও আক্রমণাত্মক খেলাতে চাইছেন তিনি।
আইএসএলে এখনও পর্যন্ত জয় পায়নি ইস্টবেঙ্গল। কিন্তু আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলার দিকেই মন দিতে চাইছেন কোচ। তিনি বলেন, "আমি সব সময়ই আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলতে পছন্দ করি। কেরালার বিরুদ্ধে আমার দল রক্ষণে ন'জন খেলোয়াড় দাঁড় করিয়ে খেলেনি। এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে একই খেলা খেলেছি। সব সময়ই আমি চাই আক্রমণে উঠতে। কেরালার বিরুদ্ধে যে রকম আক্রমণে উঠেছিলাম, গোয়ার বিরুদ্ধে আর একটু বেশি আক্রমণাত্মক ছিলাম। নর্থইস্টের বিরুদ্ধে আরও বেশি আক্রমণে উঠব।"
বৃহস্পতিবার নর্থইস্ট ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে খেলবে ইস্টবেঙ্গল। সেই ম্যাচে নামার আগে কনস্ট্যানটাইন বলেন, "প্রথম দু'টি ম্যাচে আমরা যে একেবারেই ভাল খেলিনি, তা নয়। কেরালা ব্লাস্টার্সকে আমরা ৭২ মিনিট পর্যন্ত আটকে রেখেছিলাম। এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে দ্বিতীয়ার্ধে যথেষ্ট ভাল ফুটবল খেলেছি। আমার মনে হয় সেই অর্ধে আমরাই বেশি দাপট দেখিয়েছিলাম। ওই দুই ম্যাচের দু'টি অর্ধে যা খেলেছি, সেই খেলাটা একটা গোটা ম্যাচে খেলতে হবে। আরও ধারাবাহিক হতে হবে। শুরুর ছন্দটা ধরে রাখতে হবে। এই ম্যাচে আমাদের একটা ইতিবাচক ফল পেতেই হবে।"
২৯ অক্টোবর ডার্বি। কিন্তু এখনই সেই ম্যাচ নিয়ে ভাবতে রাজি নন ইস্টবেঙ্গল কোচ। তিনি বলেন, "ডার্বি নিয়ে এখন আমার কোনও আগ্রহ নেই। দু'দিন পরেই আমাদের ম্যাচ নর্থইস্ট ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে। ডার্বি নিয়ে এখন ভাবতে যাব কেন? সব ম্যাচই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, সে এটিকে মোহনবাগান হোক বা নর্থইস্ট। যদিও শুরুটা যেমন চেয়েছিলাম, তেমন করতে পারিনি।"
বিপক্ষকে ইতিমধ্যেই মেপে নিয়েছেন লাল-হলুদের অভিজ্ঞ কোচ। তিনি বলেন, "বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে নর্থইস্ট দুর্ভাগ্যবশত হেরেছে। একটা পয়েন্ট পেতেই পারত। সে দিন যথেষ্ট ভাল খেলেছে ওরা। এই লিগে কোনও ম্যাচ সোজা নয়। ফল দেখলেই তা বোঝা যায়। ম্যাচ জেতার জন্য আমাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং আগ্রাসী হতে হবে।"