দুর্গাপুজো শেষ হতেই উত্তরবঙ্গ মেতে ওঠে ভাণ্ডানি পুজো নিয়ে। ঠিক তেমনই দুর্গাপুজোর পর উত্তরবঙ্গ আরও এক মাতৃ আরাধনা পরিলক্ষিত হয়। মূলত আশ্বিন সংক্রান্তিতেই এই পুজো করা হয়। কোচবিহারের এই পুজো বুড়িমাতার পুজো নামেই পরিচিত। দিনহাটার পুঁটিমারি গ্রামের এই পুজোর বয়স একশো বছরেরও বেশি। পুজোর পাশাপাশি সাতদিন দিন ধরে মেলাও চলে এখানে। মেলায় কুশান যাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। উত্তরের লোকসংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য হল কুশান গান। এই পুজো সম্প্রীতির বার্তাও বহন করে, কারণ হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায় মিলেই এই পুজো আরম্ভ করেছিলেন। এই পুজো বুড়িমাতার পুজো নামেই জনপ্রিয়। শিবের লৌকিক নাম বুড়োশিব, তাঁর স্ত্রীর লৌকিক নাম বুড়ি। তাই দেবীর নাম বুড়িমা। সন্তানলাভের আশায় দেবীর পুজো করা হয়।
পুটিমারি গ্রামেই রয়েছে বুড়িমাতা মন্দির। জনশ্রুতি অনুযায়ী, প্রায় ১৪০ বছর আগে পুঁটিমারি গ্রামের তিন বাসিন্দা শ্রীনাথ বর্মা, হেমানন্দ বক্সি ও আসমাত আলী বক্সি ব্যবসায়িক কাজে অধুনা বাংলাদেশের রংপুরে যান। তারা তিনজন বন্ধুও ছিলেন। সেখান থেকে ফেরার পথে দেবী চৌধুরানী গ্রামে বনদুর্গার পুজো দেখেন এবং কুশান গান শোনেন। গ্রামে ফিরে পরের বছর নিজেদের গ্রামেই দুর্গাপুজো করবেন বলে ঠিক করেন তারা। এর মধ্যেই দেবী তাদের মধ্যে একজন শ্রীনাথ রায় বর্মা স্বপ্নাদেশ পান, দশভূজা নয়, দেবীকে এখানে বনদুর্গা রূপেই পুজো করতে হবে। দেবীই স্বপ্নাদেশে বলেন, দুর্গা হিসেবে নয়, বুড়িমা রূপে তিনি পুজো নেবেন। তখন থেকেই গ্রামে বুড়ি মায়ের পুজো শুরু হয়। সময়টা আনুমানিক ১৮৮৪ সাল।
১৩৯তম বর্ষে পদার্পণ করছে দেবী মায়ের আরাধনা। দেবী মূর্তি এখানে বৃদ্ধা, দেবী সিংহবাহিনী। দেবীর কোলে শিশু রয়েছে। দেবীর মাথার চুল পাকা। দেবী দ্বিভূজা, বাম দিকের কোলে রয়েছে একটি শিশু এবং ডান হাতে দেবী আশীর্বাদরতা ভঙ্গিমায় বিরাজমানা। মন্দিরে আশ্বিন সংক্রান্তিতে গভীর রাতে পুজো শুরু হয়, তারপর সারারাত ধরে চলে পুজো। এই পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট হল দেবীকে নৈবেদ্যে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে হাঁসের ডিম উৎসর্গ করা হয়। পাঁঠা ও কবুতর বলি দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। সেই সঙ্গে চালকুমড়ো এবং আখ বলির রেওয়াজ রয়েছে।
স্বপ্নে দেখা মূর্তিতেই প্রতিমা গড়া হয়ে আসছে। ভেটাগুড়ি নিবাসী লোকনাথ মালাকার প্রথম মায়ের এই মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন। আজও বংশপরম্পরায় বুড়িমায়ের প্রতিমা গড়ে আসছেন ভেটাগুড়ির মালাকার পরিবার। ভক্তদের বিশ্বাস দেবী মানত পূরণ করেন। পুজোতে অনেক ভক্তই মানত করেন। মানত পূরণ হলে তারা অনেকেই পুজোর খরচ বহন করেন। তাও লম্বা তালিকা রয়েছে ইচ্ছে করলেই পুজোর খরচ বহন করা যাবে না। পুজোর খরচ দিতে চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে তা হবে না৷ যার মানত পূরণ হয়েছে এমন এক এক জনকে এক এক বছর প্রতিমা দেওয়ার জন্যে ঠিক করা হয়। আজও আশ্বিন সংক্রান্তিতে নিয়ম-নিষ্ঠার সঙ্গে এখানে বনদুর্গা পুজো অর্থাৎ বুড়িমায়ের পুজো হয়ে আসছে।