হিন্দু বাঙালির ৩৩ কোটি দেবদেবীর তালিকার এক্কেবারে প্রথম সারিতে যিনি স্বমহিয়ায় বিরাজমান তিনি হলেন - মা কালী। বাঙালি সমাজে তার পুজোর ঐতিহ্য বেশ পুরোনো । শুধু তাই নয় তার মহিমা এতটাই প্রবল যে সমগ্র বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার অসংখ্য মন্দির এবং ভক্তকুল। এই ভক্তকুলের মধ্যেই কিন্তু শুধু বাঙালি নয় বিদেশীও ছিলেন এবং এখনো আছেন, যার অন্যতম ফিরিঙ্গি ব্যবসায়ী এন্টোনি সাহেব। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই কালী মন্দির আজ ফিরিঙ্গি কালী বাড়ি নামেই খ্যাত।
তবে খ্যাতির লাইমলাইট থেকে দূরে থাকা কালী মন্দিরের সংখ্যাও নেহাত কম নয়, সে রাস্তার মোড়ে হোক বা বাড়ির। বঙ্গ সংস্কৃতির স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য হলো, হয় তাকে ভিন্ন ভাষীরা আপন করেছে বা সে তাদের। আর এভাবেই মা কালীও কালপ্রবাহে অন্যসম্প্রদায়ের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছেন। আর তাতেই খোদ হিন্দু দেবীর দৈনন্দিন ফুড হ্যাবিটে এসেছে বড়ো পরিবর্তন। এর আগেই ফিরিঙ্গি সাহেবের কথা বললাম এবার বলি চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর দেশের মানুষের কথা মানে চীনাদের কথা, যারা উপাসনার তাগিদেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কালী মন্দির, এমনকি চিনা সম্প্রদায়ই মন্দিরের নিত্য পুজো করে - তবে তাদের মতো করে। আর ভোগও হয় অভিনব। এই ভোগের কথা আপামর ভক্তকুল আগে শুনেছেন বলে মনে হয় না ।
আশ্চর্য এই মন্দিরের দেখা মিলবে কলকাতা বাইপাসের কাছে ট্যাংরা এলাকায়। এই এলাকা কলকাতার ‘চায়না টাউন’ নামে পরিচিত । যদিও এটি বয়েসে খানিক নবীন , পুরোনো চায়না টাউন বলা হতো টেরিটি বাজারকে। কয়েকশো বছর ধরেই এখানে চিনাদের বাস । মন্দিরের সামনেই বড়ো হরফে ইংরেজিতে লেখা ‘চাইনিজ কালী টেম্পল’। মন্দিরটি ছোটো। মূল কালী বিগ্রহের পাশে রয়েছে আরেকটি ছোটো কালীমূর্তি । আছে শিবের বিগ্রহও । স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, অনেক বছর আগে এক চিনা দম্পতির সন্তান খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে ডাক্তারবদ্যি দেখিয়েও তার রোগ সারেই নি, বরং ক্রমশ বেড়ে যায়। ওই এলাকার এক গাছের তলায় দু’টি পাথরকে আশেপাশের লোকজন পুজো করত । শেষ চেষ্টা স্বরূপ সন্তানের আরোগ্য কামনায় সেই পাথরগুলির কাছেই প্রার্থনা জানান ওই চিনা দম্পতি। তারপর ঘটে অবাক কাণ্ড। সত্যিই সুস্থ হয়ে ওঠে তাঁদের সন্তান । তখন থেকেই দেবী কালীর প্রতি তাঁদের অটুট আস্থা গড়ে ওঠে । তার পরেই এই মন্দির গড়ে ওঠে । এখনও মন্দিরে আছে সেই গাছ এবং দুটি পাথর ।
এখন স্থানীয় হিন্দুদের সহায়তায় চীনা বাসিন্দারাই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ করেন। দেবীর বর্তমান সেবায়েত জন চেং। চিরাচরিত রীতি মেনেই এখানে শিবকে পরানো হয় সাদা ফুলের মালা, লাল জবার মালা দেওয়া হয় কালীকে । প্রতি শনিবার বিশেষ পুজোর ব্যবস্থা থাকে। প্রত্যেক বছর কালীপুজোর রাতে এখানেও ধুমধাম করে উৎসব হয় । বিশেষ তিথিতে পুজোর দায়িত্ব নেন ব্রাহ্মণ পুরোহিত । দেশীয় ধূপকাঠির সঙ্গে চিনা ধূপকাঠি জ্বালানো হয় মন্দিরে। এখানেই দেবীর দৈনন্দিন ফুড হ্যাবিট গেছে বদলে । এখানে দেবীর মূল ভোগ নুডলস আর চপসি । তবে ফল, মিষ্টি, পায়েসও মেলে প্রসাদ হিসেবে । কিন্তু এই মন্দিরের বিশেষত্ব হলো নুডলস ভোগ । সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনে মা কালীও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন চীনে খাবারে । খিচুড়ি ভোগ তো অনেক খেয়েছেন, ভোগের নুডলস চেখে দেখতে হলে ঘুরেই আসুন চীনে পাড়ায় ।