শীত কুয়াশার গায়ে গড়িয়ে পড়ে নলেন গুড়ের মতো আলো। হালকা হলুদ না সোনালী কী তার আসল রং সে নিয়ে খুব একটা গবেষণা চলে না, শুধু গায়ে মেখে নিতে হয় তার ওম। কী যে আরাম! চোখ জড়িয়ে আসে রোদের আদরে। এমন রোদে পিঠ পেতে বসে চুপ থাকলে হয় না। মুখও চলতে থাকে কখনও বাসি পিঠে-পায়েস কখনও গুড় মুড়ি।
বাঙালির শীত বড় মিঠে। সে শুধু সকালের ওমে নয়, গোড়া শীত জুড়ে ভোজ উৎসবের জন্য। তার একটা বড় পর্ব বরাদ্দ থাকে মিষ্টি আর গুড় বিলাসীদের জন্য। গুড় বাংলার শীতের সিগনেচার।
গুড় আবিষ্কার হয় মেসোপটেমিয়ায়। কিন্তু গুড়ের রানী থাকেন এই বঙ্গদেশে। দুই বাংলাতেই মোটামুটি তিন ধরনের গুড় দেখা যায়। আখের গুড়, তাল গুড় আর খেজুরের গুড়। তিন ধরনের গুড় পাওয়াও যায় আলাদা আলাদা ঋতুতে। শীতকাল নলেন গুড়ের। রসগোল্লা-সন্দেশ থেকে পিঠে-পুলি-পায়েস, এখন আবার কেক পেস্ট্রিতেও নলেন গুড়ের গন্ধ।
মধুর চেয়েও ভাল নলেন গুড়
কাচের শিশি বন্দী পাতলা সোনালী তরল। জলের মতো দেখতে। স্বাদে গন্ধে তুলনা পাওয়া ভার। তবু তুলনা চলে। নলেন গুড় নাকি মধু- স্বাদে সেরা কে? নলেন গুড়ের কাছে দশ গোল খায় মধু। কেউ কেউ আবার বলেন তুলনাতেই আসে না।
নলেন গুড় আসলে খেজুর গুড়। খেজুর রস থেকে তৈরী হয়। খেজুর গাছ থেকে মরসুমের শুরুতে যে রস পাওয়া যায় তার প্রথম অংশটুকু নিয়ে তৈরী হয় নলেন গুড়।
গুড়ের নাম কী করে নলেন হল তা নিয়ে বেশ কয়েকটি মত পাওয়া যায়। একটি মত বলে, ব্রজবুলি নওল শব্দটি থেকে নলিয়ান বা নলেন কথাটি এসেছে। নওল শব্দের অর্থ নতুন। মরসুমের শুরুতে খেজুর গাছ থেকে যে রস সংগ্রহ করা হয় তাতে অদ্ভুত সুবাস পাওয়া যায়। যেহেতু প্রথম বা নতুন রস তাই নওল গুড় থেকে নলেন।
আবার কেউ কেউ বলেন, খেজুর গাছের গায়ে নল কেটে এই গুড় সংগ্রহ করা হয় বলে একে নলেন গুড় বলা হয়। আবার আরও একদল ভোজন রসিকরা বলেন, দক্ষিণ ভারতে নরকু বলে একটি শব্দ প্রচলিত আছে। যার আক্ষরিক অর্থ হল কাটা বা ছেদন করা।
আরও একটি মত আছে, সেই মত অনুযায়ী খেজুর রস সংগ্রহ করার জন্য শিউলিরা প্রথমে দা দিয়ে খেজুর গাছের কিছুটা চেঁছে দেয়, তারপর নরুন দিয়ে ফুটো করে সেখান থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়া রস একটা বাঁশের ছিল বা নল লাগিয়ে খেজুর গাছের গায়ে ঝোলানো হাঁড়িতে বা ভাঁড়ে সংগ্রহ করে। নল দিয়ে খেজুরের রস সংগ্রহ করা থেকে নলেন নামের উদ্ভব হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। ‘নরুন’ শব্দটিও ‘নলেন’ নামকরণকে প্রভাবিত করেছেবলে মনে করা হয়।
বাংলা দেশে নলেন গুড় সংস্কৃতির চল অতি প্রাচীন। তার নিদর্শন রয়ে গিয়েছে ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ নামক সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থে। গ্রন্থটি খ্রিস্ট দ্বাদশ শতকের বঙ্গাধিপতি লক্ষ্মণ সেনের অন্যতম সামন্ত অধিপতি বটুদাসের পুত্র শ্রীধরদাস সংকলিত। ওই বিখ্যাত গ্রন্থেই ‘হেমন্তের নূতন গুড়ের গন্ধে আমোদিত বাংলার গ্রামের বন্দনা’ পাওয়া যায়। বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদি পর্ব’-এ নীহাররঞ্জন রায় উল্লেখ করেছেন।
শীত আসার আগে থেকেই নলেন গুড় পাওয়ার জন্য খেজুর গাছ প্রস্তুত করা হয়। হেমন্তের শুরুতে খেজুর গাছ ঝুরতে কাটতে চাঁছতে হয়। একে বলে গাছ তোলা। তারপর বাঁশের কঞ্চির নল বসাতে হয় গাছে। সেই নল বেয়ে টুপ টুপ করে রস নামতে থাকে। সূর্য পাটে যাওয়ার সময় গাছি বা শিউলি ওই রসসিক্ত নল বরাবর মাটির কলসি বা হাঁড়ি গাছে ঝুলিয়ে দিয়ে আসে। অবশ্য গ্রামবাংলায় বলে ভাঁড় পাতা। সারা রাত ধরে একটু একটু রস জমে ভাঁড়ে। ভোরের দিকে ভাঁড় যখন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে তখন গাছি এসে প্রত্যেকটা গাছ থেকে ভাঁড় নামায়। গাছ প্রথম দিন কাটার পর যে রস সেটাই হল সেরা। এ হল কাটের রস। কোনও ভাবেই ভাঁড় তোলায় দেরী করা যায় না। তাত লাগলে রস নষ্ট হয়ে যায়। দিনের বেলার রস পাওয়ার জন্যও একটি পাত্র বেঁধে দেওয়া হয় গাছে।
খেজুর গাছের প্রথম কাটাকে বলা হয় ‘পয়রা’। ৬-৭ দিন অন্তর গাছ কাটা হয়। কাটের রস পাওয়ার পর কয়েকদিন জিরতে দেওয়া হয় গাছটিকে। মানে বিশ্রাম দেওয়া। তারপর যে রস পাওয়া যায় তাকে বলে জিরেন রস।
অগ্রহায়ণ থেকেই খেজুর গাছ কাটা শুরু হয়। একটা খেজুর গাছ তিনবার কাটার পরে তাতে নলি লাগিয়ে রসের জন্য ভাঁড় পাতা হয়। একটা খেজুর গাছ থেকে দিনে দু’বার রস মেলে। ভোরের রসকে ‘জিরেন’ এবং বিকালের রসকে ‘ওলা’ বলে।
প্রত্যেক দিন রস সংগ্রহ করার পর প্রায় পাঁচ ঘন্টা ধরে আগুনে ফোটাতে হয় নলেন গুড় তৈরী করার জন্য। পৌষ মাসে পুরোদমে রস মেলার পর মাঘ থেকে রস কমতে শুরু করে। কারণ ঠান্ডা কম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রসের ঘনত্ব বাড়তে থাকে।
ভাল রস পাওয়ার জন্য শীতের রোদ ঝলমলে আবহাওয়া খুব জরুরি। মেঘ-কুয়াশা দুই রসের জন্য ক্ষতিকর। দক্ষিণ বঙ্গ, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, রুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর এবং দুই পরগণার ছবি বদলে যায় শীতকাল এলে। বলা যায় এ এক আলাদা মানচিত্র। নলেনগুড় বহু মানুষের সংস্থান। এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষরা ‘শিল্পী’র কদর না পেলেও নলেন গুড়ের স্বাদ গন্ধ নির্ভর করে অনেকটাই ‘শিউলি’দের হাতযশের ওপর।