প্রয়াত মার্কিন লেখিকা টনি মরিসন

বয়স ৮৮ ছাড়িয়েছিল। শেষ কয়েক মাস ধরেই বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। সোমবার নিউইয়র্কের এক হাসপাতালে দেহত্যাগ করেন নোবেলজয়ী মার্কিন ঔপন্যাসিক টনি মরিসন। মঙ্গলবার তার পরিবার ও স্বজনদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, “গতকাল রাতে, খুব শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রয়াত হয়েছেন মরিসন। মুদ্রিত অক্ষর ওঁর সবচেয়ে প্রিয় ছিল।“

১৯৩১ সালে ওহিয়োর লরেইন-এ জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। বাবা ছিলেন একটি ইস্পাত মিলের শ্রমিক, পরিচারিকার কাজ করতেন মা। ওয়াশিংটন, ডি.সি’র হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আফ্রিকান, ব্রিটিশ ও আমেরিকান সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। সেখানে উইলিয়াম ফকনার ও ভার্জিনিয়া উলফের বিষয়ে অধ্যাপনার সুযোগ হয় তার। চিনুয়া আচেবে থিংস ফল পার্টগ্রন্থটি তাঁর জীবনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।

FotoJet (111)

শুধু ঔপন্যাসিকই নয়, একাধারে তিনি ছিলেন একজন প্রবন্ধকার, সম্পাদক অধ্যাপক। ১৯৭০ এ, ৪০ বছর বয়সে তার প্রথম উপন্যাস দ্য ব্লুয়েস্ট আই প্রকাশিত হয়। প্রথম গ্রন্থ প্রকাশ হওয়ার ২৩ বছর পর ১৯৯৩ সালে তাঁকে সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এরপর সং অফ সলোমন’, ‘বিলাভড্’, ‘জ্যাজ’, ‘প্যারাডাইস’, ‘লাভএর মতো উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলির জন্ম দিয়েছেন তিনি। নিজস্ব লেখনীর মাধ্যমে, বর্ণবৈষম্যে আক্রান্ত মার্কিনি সাম্রাজ্যে আফ্রিকান-আমেরিকানদের জন্য স্বাধীনতা ও পরিচয়ের নবদিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছিলেন। লিখেছেন শিশুদের জন্য সাহিত্য। এছাড়াও দু’টি নাটক সহ বেশ কিছু নন ফিকশনও রচিত হয়েছে তাঁর হাতে।

নোবেল পুরস্কারদাতা মন্ডলী তার রচনাগুলির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, “ওনার রচনাগুলি স্বয়ং ভাষাচেতনা, যা বর্ণবিদ্বেষ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চায়।

FotoJet (113)

(স্পেনের ভিতোরিয়া-তে তাঁকে ঘিরে নির্মিত একটি গ্রাফিত্তি)

বিয়ের পর দুই সন্তানকে নিয়ে তিনি একজন ‘সিঙ্গেল মাদার’ রূপে জীবনযাপন শুরু করেন। সে সময় নিউইয়র্কে ‘গ্রন্থ সম্পাদনা’র একটি কাজ বেছে নিতে হয় তাঁকে। একাধিক প্রকাশনীর প্রত্যাখ্যানের মুখ দেখেছিল প্রথম গ্রন্থ ‘দ্য ব্লুয়েস্ট আই’ এর পান্ডুলিপি । কিন্তু পাকচক্রে তা ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস্’ এর গ্রন্থ সমালোচক জন লিওনার্দের দৃষ্টিতে পড়ে। এবং সেই মূহুর্তেই তিনি গ্রন্থটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। জন বিশ্বাস করতেন মরিসন নতুন প্রজন্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ কন্ঠস্বর। তাঁর লেখনী সম্বন্ধে একটি মন্তব্যে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, “গ্রন্থগুলি বিস্ময়ে আর যন্ত্রণায় এতটাই সমৃদ্ধ যে তা উপন্যাসগুলিকে কবিতার পর্যায়ে নিয়ে যায়।

বিলাভড্উপন্যাসটির জন্য ১৯৮৮ সালে তাঁকে পুলিৎজার পুরষ্কারে সন্মানিত করা হয়। উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট এক মা’কে ঘিরে, যিনি তাঁর কন্যা সন্তানকে হত্যা করেন; কারণ তিনি মনে করেছিলেন দাসত্বে জীবনযাপন করার থেকে মৃত্যু সংবরণ অনেক সুখের। অচিরেই গ্রন্থটি ‘বেস্ট সেলার’ এর স্বীকৃতি পায়। পরবর্তীকালে উপন্যাসটিকে ভিত্তি করে চলচ্চিত্রকর ওপরাহ উইনফ্রে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।

অজস্র পুরস্কার সহ প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম-এর অধিকারী তিনি, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নাগরিকত্বের সন্মান বহন করে।

FotoJet (112)

বর্ণবিদ্বেষ ও দাসত্বের বিরূদ্ধে তার কলমকে বারবার তিনি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। অনন্য লিখনশৈলী ও কাব্যসুষমায় মন্ডিত তার লেখকজগত বিশ্বের অসংখ্য পাঠক’কে একত্র করতে সক্ষম হয়েছিল। জীবনানন্দ বলেছিলেন, মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানুষ রয়ে যায়”, ঠিক কোন আঙ্গিকে তিনি বাক্যটি বলেছিলেন তা দীর্ঘ গবেষণার বিষয়, এ নিয়ে বিস্তর তর্কে যাওয়া যেতে পারে, সে অন্য বিষয়। তবে আমরা ধরে নিতে পারি একটি দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনানন্দ ব্যক্ত করতে চেয়েছেন যে, মানুষ দেহত্যাগ করলেও তার কাজগুলি পৃথিবীতে রয়ে যায়। ঠিক সেভাবেই আপামর পাঠক মহল মনে রাখবেন এই মার্কিন লেখিকা’কে, আরও অনন্ত বছর পাঠক মহলে সমাদৃত হোক তার কাজ, এই আশাই কাম্য। 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...