পালরাজাদের স্মৃতি বহন করছে নোয়াখালী

                   প্রশাসনিক তাগিদে জমি জরিপের কাজে বুকানন হ্যামিল্টন পাহাড়পুরে এসে প্রাচীন স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষের সন্ধান পান। এর পরে ওয়েস্টম্যাকট নামে এক ব্রিটিশ সাহেব পাহাড়পুরে এসেও একই ধরনের সম্ভাবনার কথা ইংল্যান্ডের কিছু পত্রিকাতে প্রচার করেন। সেই সূত্র ধরে বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ আলেকজান্ডার কানিংহাম তথ্যানুসন্ধান করেন। তিনি পাহাড়পুরের উঁচু ঢিবিগুলো খুঁড়ে দেখতে চাইলেও বাধাপ্রাপ্ত হন জমিদার বলিহারের। তবে ঢিবি এলাকার খুব সামান্য অংশ তিনি খনন করতে পেরেছিলেন, তাতেই একটা বড়ো ইমারতের সন্ধান পাওয়া যায়। এভাবেই আধুনিক যুগে নতুন করে খুঁজে পাওয়া যায় হারিয়ে যাওয়া সোমপুর মহাবিহার। ১৯০৪ সালের প্রত্নতাত্ত্বিক আইনের বলে এই জায়গাকে ১৯১৯ সালে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করেছিল ব্রিটিশ সরকার। তারপর থেকে আর গবেষণার কাজে সমস্যা হয়নি।

               অঞ্চলটি এখন বাংলাদেশের নওগাঁ জেলায়।এই মহাবিহার ছিল পাল সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশ পুণ্ড্রবর্ধনের রাজধানী পুণ্ড্রনগর এবং আরেক শহর কোটিবর্ষর মাঝামাঝি অঞ্চলে। তবে সোমপুর মহাবিহারের প্রতিষ্ঠাতা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ আছে। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, পাল সম্রাট ধর্মপাল এই বৌদ্ধবিহার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং বিহারের বিক্রমশীলা মহাবিহারের মতো এই মঠও তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছিল। আবার কেউ কেউ দাবি করেন, ধর্মপালের ছেলে দেবপালের আমলেই এই মহাবিহার গড়ে উঠেছিল। তবে পাল যুগের আগে সোমপুর বিহারের কোনো অস্তিত্ব ছিল না, তার প্রমাণ, হর্ষবর্ধনের সমকালীন চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাঙের লেখা যেখানে এই মঠের কোনো উল্লেখই নেই।

                      পাল এবং সেন যুগে সোমপুর মহাবিহারের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল চিন, তিব্বত, ব্রহ্মদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে। এইসব দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে এখানে আসতেন। যে কোনো বৌদ্ধ বিহারই প্রাচীনকালে ছিল অধ্যয়ন এবং অধ্যাপনার কেন্দ্র। সোমপুরও তার ব্যতিক্রম নয়। একটা সময়ে বিশ্ববিখ্যাত পণ্ডিত এবং বৌদ্ধ সন্ন্যাসী অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ছিলেন এই মহাবিহারের অধ্যক্ষ। আয়তনে প্রায় নালন্দা মহাবিহারের মতোই বিশাল এই মঠে ছিল ১৭৭টা থাকার ঘর, প্রশস্ত প্রবেশপথ, অনেকগুলো বৌদ্ধ স্তূপ, ছোটো ছোটো মন্দির, পুকুর এবং মাঝখানে অসাধারণ কারুকার্য করা একটি বিশাল মন্দির। সেই মন্দিরের গায়ে খোদাই করা অসংখ্য পোড়ামাটির  কারুকার্যে ফুটে উঠেছে তখনকার সমাজের নানা দৃশ্য। সোমপুর মহাবিহার থেকে পাওয়া গেছে পাথর এবং ধাতুর তৈরি অনেক মূর্তি, পোড়ামাটির ফলক, মাটির বাসনপত্র, তামা এবং পাথরে খোদাই করা নির্দেশনামা। বাগদাদের খলিফা হারুন-অল-রশিদের নাম খোদাই করা রুপোর মুদ্রাও পাওয়া গেছে এখান থেকে। পাহাড়পুর প্রত্নক্ষেত্র এখন রয়েছে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যস্থান তালিকায়।

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...