আষাঢ় বিদায় নিল। শ্রাবণ দোরগোড়ায়। তবু বর্ষার বৃষ্টি কই! চামড়া পোড়া গরমে ঘামতে ঘামতে জীবন বেরিয়ে যাচ্ছে। তার উপর যেটুকু বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি হচ্ছে, তাতে মাটি ভিজলেও গরম কমছে না। উত্তরবঙ্গ ভেসেই চলছে, দক্ষিণবঙ্গ শুকনো। প্রকৃতির এই মেজাজে বেহাল অবস্থা হাওয়া অফিসের। রোজই একই পূর্বাভাস দেওয়া ছাড়া গতি থাকছে না। বৃষ্টির সম্ভাবনা, আর সম্ভাবনা। এতে কী মাটি ভেজে, চাষ তো শিকেয় উঠেছে। দক্ষিণবঙ্গে মাঠ সব চৌচির। সবজি চাষে আকাল লাগল বলে, আশঙ্কায় কৃষকরা।
এদিকে, মঙ্গলবার দুপুরে আকাশে কালো মেঘে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হলো কলকাতায়। যতক্ষণ বৃষ্টি চলেছে, ততক্ষণ শোনা গিয়েছে বজ্রপাতের তীব্র আওয়াজ। বৃষ্টির পরিমাণ তেমন না হলেও এ দিনের ক্ষণিকের বর্ষা অসহনীয়, অস্বস্তিকর গরম থেকে কিছুটা মুক্তি দিয়েছে। বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি হতে দেখা গিয়েছে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়। দিনে মেঘলা আবহাওয়া, আর হালকা বৃষ্টির জেরে অস্বস্তিকর গরম থেকে সাময়িক স্বস্তি মিলেছে। এ দিন বৃষ্টির সঙ্গে ছিল দমকা হাওয়া।
বাতাসের প্রচণ্ড গতির জেরে শহর কলকাতার একাধিক জায়গায় গাছ উপড়েছে। পার্ক স্ট্রিট-ক্যামাক স্ট্রিট, এজেসি বোস রোড-ডি এল খান রোড, শরৎ বোস রোড-বসন্ত রায় রোডের সংযোগস্থলে এ দিন ঝোড়ো বাতাসে গাছ পড়ে যায়। বেনিয়াপুকুরে পদ্মপুকুর মোড়ের কাছে ডক্টর সুন্দরীমোহন অ্যাভিনিউ, স্ট্র্যান্ড রোডে বাবুঘাট ও প্রিন্সেপ ঘাটের মাঝে এ দিন গাছ পড়ে যাওয়ায় যান চলাচলে সাময়িক ব্যাঘাত ঘটেছে। আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর জানাচ্ছে, বিক্ষিপ্ত বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকলেও আপাতত ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা নেই।
গ্রীষ্মের গরমে মাঝেমধ্যে কালবৈশাখীর দেখা মেলে। ভরা বর্ষায় কালবৈশাখীর আশা করে লাভ নেই। আর এর মধ্যে গা জ্বালানো গরম রেকর্ড করে ফেলল। চোদ্দো বছরে আষাঢ় মাসে এমন তাপমাত্রা বাড়ার ঘটনা ঘটেনি। অম্বুবাচিতে বৃষ্টি নেই, রথে বৃষ্টি নেই, যেন কোনও চিরায়ত নিয়মকেই আমল দিচ্ছে না এবারের বর্ষা। সোমবার কলকাতায় পারদ চড়ে বসল ৩৭.৭ ডিগ্রিতে। স্বাভাবিকের চেয়ে এই তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি বেশি। সেই সঙ্গে বাড়তি আর্দ্রতা ও চরম অস্বস্তি তো আছেই। শুধু গরম কেন, জুলাই মাসে কলকাতায় বৃষ্টির ব্যাপক ঘাটতিও নজির তৈরি করে ফেলেছে। এখনই এই ঘাটতি পৌঁছেছে ৭২ শতাংশে।
একদিকে কলকাতা সহ দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে যখন চলছে বৃষ্টির আকাল, তখন উত্তরবঙ্গ ভাসছে। তিস্তা, তোর্সা সহ পাহাড়ী সব নদী বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। আসাম, ভুটানের ভারী বৃষ্টির উপচে পড়া জল উত্তরবঙ্গে জেলাগুলিতে এসে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিপন্ন বনজীবন। উত্তরবঙ্গে এখনও বৃষ্টি চলবে বলে জানিয়েছে আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর। দার্জিলিঙ, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার ভেসেছে। পাহাড়ে লাগাতার বর্ষায় তরাইয়ে বৃষ্টির ঘাটতি মিটলেও টানা বৃষ্টিপাতে জনজীবন পুরোদস্তুর বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
এই পরিস্থিতিতে দক্ষিণবঙ্গে কবে ঝমঝমে বৃষ্টি নামবে, তা স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। মঙ্গলবার কলকাতা, দুই ২৪ পরগনা, হাওড়া ও হুগলিতে বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি হলেও পরিবেশ ঠান্ডা হওয়ার কোনও আশাই দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টির যে ঘাটতি হয়ে বসে আছে, তা সামান্য বৃষ্টিতে না মেটারই কথা। উত্তর ২৪ পরগনায় বৃষ্টির ঘাটতি রয়েছে ৫৯ শতাংশ। এ ছাড়া দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ৫১, হাওড়ায় ৭৭, পশ্চিম মেদিনীপুরে ৩৯, হুগলিতে ৪২, নদীয়ায় ৫০ শতাংশ ঘাটতি তৈরি হয়েছে। দক্ষিণবঙ্গের বাকি সব জেলারই একই অবস্থা। গড়ে দেখলে বৃষ্টির ঘাটতি হার ৭১ শতাংশ। টানা বৃষ্টি না হলে বিক্ষিপ্ত বৃষ্টিতে এই বিপুল ঘাটতি মিটবে না।
ওই পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১০ সালে ঘাটতি ছিল ১১ শতাংশ, ২০১২ সালে ৩৭, ২০১৩ সালে ৮, ২০১৬ সালে ৫৫ শতাংশ। সেখানে ২০১৮ সালে ঘাটতি হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। বর্ষার প্রথম মাসের বৃষ্টির পরিমাণ স্বাভাবিকের থেকে কম হলে পরের শ্রাবণ মাসে তা পূরণের একটা সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু ঘাটতি ৫০ শতাংশের বেশি হলে তা পূরণ করা কঠিন। এ বছর ইতিমধ্যেই ঘাটতি ৭০ শতাংশকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিক্ষিপ্ত বৃষ্টির সব রকমের সম্ভাবনা থাকলেও তাতে ঘাটতি মিটবে না। আবার এখন থেকে টানা বৃষ্টি হলেও কলকাতা বা শহরতলির ঘাটতি অনেকটা পূরণ হয়ে গেলেও দক্ষিণবঙ্গের রুখা জেলায় তা কখনোই মিটবে না। কিন্তু আশা ছাড়া যাবে না। তাই শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া গতি নেই। শ্রাবণের অঝোর ধারায় চেনা বর্ষার সেই সজল রূপ ফিরে আসে কি না, তারই অপেক্ষায়।