কেউ গল্প বলে না, কেউ গল্প শোনে না

শীতের সন্ধ্যেয় লেপ মুড়ি দিয়ে গল্প শুনতে কার না ভাল লাগে! অথবা ঝমঝমে বৃষ্টির সন্ধে। লোডশেডিং। বাইরে কুয়াশা মাখা অন্ধকার। হ্যারিকেনের নিভু নিভু আলো। সঙ্গে চা আর মুড়ি। এমন পরিবেশে গল্প পড়ার চেয়ে শুনতেই বেশি ভাল লাগে। আর ভূতের গল্প হলে তো কথাই নেই। ভয়ও যত, আকর্ষণও তত। কন্কনে শীতের সন্ধ্যেয় দাদু-ঠাকুমার কোলের কাছে বসে গল্প শোনার মজাই আলাদা। ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমীর গল্প, পক্ষীরাজের গল্প, রূপকথার গল্প আরও কত কী। এই স্বাদ যারা পেয়েছে তারাই বোঝে।

আমার অবশ্য দাদুর কাছে গল্প শোনার সৌভাগ্য হয়নি। কারণ আমি পৃথিবীতে আসার অনেক আগেই আমার দাদু পরলোকে চলে গিয়েছিলেন। কাজেই ছোট থেকে বাবার কাছেই গল্প শুনতাম। বাবা চাকরি সূত্রে বাইরে থাকতেন। সপ্তাহে দু একবার বাড়ি আসতেন। আমি অপেক্ষা করতাম কখন বাবা খাওয়া দাওয়া সেরে উপরে যাবে। যেই উপরে শুতে যেত আমিও চুপচাপ গিয়ে লেপের ভেতর ঢুকে পড়ে বলতাম- ‘গল্প বলো।’ উনি কখনও বিরক্ত হতেন না। অফুরন্ত গল্পের ভান্ডার ছিল বাবার কাছে। রামায়ণ- মহাভারতের গল্প, ধূর্ত শেয়াল আর বকের গল্প, কুমির আর বাঁদরের কলজে শুকনোর গল্প, শাঁকচুন্নীর গল্প, গোপাল ভাঁড়ের গল্প আরও কত কী। মুগ্ধ হয়ে শুনতাম সব।

আসলে গল্প বলাটা একটা শিল্প। গল্প বলার ভঙ্গীতে আকর্ষণ না থাকলে শুনতে ভালো লাগে না। সেই ছোট্ট বয়সেও আমি ছিলাম খুব ভালো শ্রোতা। গল্প শুনতে শুনতে চোখের সামনে সব দেখতে পেতাম। গল্পের সেই চরিত্রগুলো আমার চোখের সামনে অভিনীত হত বলেই গল্প শুনতে এত ভালো লাগত। সব থেকে ভালো লাগত দাদুর দস্তানার গল্পটা-

একবার এক দাদু তার নাতিকে নিয়ে শীতের বিকেলে বেড়াতে বেরিয়েছে। কোন সময় দাদুর হাতের দস্তানা খুলে রাস্তায় পড়ে গেছে। দাদুর সেদিকে খেয়ালই নেই। এমন সময় এক ইঁদুর সেই দস্তানা দেখতে পেয়ে তার ভেতরেই থাকতে শুরু করে দেয়। শীতকালে এমন গরম দস্তানার ওম সে আর কোথায় পাবে! সেই রাস্তা দিয়ে একটা খরগোশ যাচ্ছিল।

সে দস্তানার ভেতর ইঁদুরকে দেখতে পেয়ে বলল- ‘ইঁদুর ভায়া ইঁদুর ভায়া আমাকে থাকতে দেবে?’ ইঁদুর বলল ‘থাকো। তার পরে একটা দস্তানাটা দেখতে পেয়ে একইভাবে জিজ্ঞাসা করল, ‘ইঁদুর ভায়া ইঁদুর ভায়া আমায় থাকতে দেবে?’ ‘থাকো’। একে একে হাতি, ঘোড়া, বাঘ, সিংহ, হরিণ সবাই ইঁদুর ভায়ার অনুমতি নিয়ে ওই দস্তানার মধ্যেই থাকতে শুরু করে দেয়।

এমন সময় দাদু বাড়ি গিয়ে দেখে তার হাতের একটা দস্তানা নেই। খুঁজতে খুঁজতে যখন দাদু সেই দস্তানা খুঁজে পায়, তখন দেখে এতগুলো জন্তু জানোয়ার ওর ভেতরে ঢুকে নোংরা করে দিয়েছে। আর দস্তানাও ছিঁড়ে গেছে।’

তখন যুক্তি বুদ্ধি কাজ করত না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলতায় ভুগতাম না। সরল মনে সবই বিশ্বাস করতাম। দাদুর কথা ভেবে মজাও পেতাম আবার দুঃখও হত। এখনও কানে বাজে বাবার সুর করে বলা সেই লাইনগুলো- ‘ইঁদুর ভায়া ইঁদুর ভায়া আমায় থাকতে দেবে? থাকো।’

বাবা যখনই আসতেন তখনই কোনও না কোনও গল্প বাবাকে বলতেই হত। না বললে নিস্তার নেই। কোনও কোনও গ্রীষ্মের লোডশেডিং এর রাত্রিরে বাবার সঙ্গে ছাদে যেতাম। বাবা তারা চেনাতেন। সপ্তর্ষিমন্ডল, কালপুরুষ, বৃহস্পতি, মঙ্গল, বুধ। সৌরজগতের গল্পও কী সুন্দরভাবে বলতেন। মহাভারতের যুদ্ধের শেষে কুন্তী গান্ধারীর অনবদ্য কথপোকথন এমন করে রসিয়ে রসিয়ে বলতেন যেন মনে হত সেইসময় বাবা ওখানে উপস্থিত ছিলেন। আর তার পরেই বলত- ‘জা এ জা এ কখনও ভাব হয় না।’

বাবার নিজস্ব মহিমাও এই সব কাহিনিতে খুব সঙ্গোপনে মিশিয়ে দিতেন। ছোটবেলায় বুঝিনি। এখন বুঝি। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ছিপ্কান্ তিন্ দাঁড়’ কবিতাটা এত সুন্দর আবৃত্তি করতেন যে এখনও সেই অনুরণন কানে বাজে। বিশেষ করে-

‘ঝকঝক কলসীর
বক্ বক্ শোন্ গো
ঘোমটার ফাঁক বয়
মন উন্মন গো’

যখন বলতেন তখন সত্যিই সত্যিই কলসীতে জল ভরার সেই আওয়াজটাই শুনতে পেতাম। সুকুমার রায়ের ‘অবাক জলপান’ এমন করে বলতেন যেন মনে হত আমিই সেই তৃষ্ণার্ত পথিক। আমারই প্রচন্ড জল তেষ্টা পেয়েছে।  ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিসের’ পাউন্ড অফ ফ্লেসের গল্প সেই ছোট্ট বেলাতেই শোনা হয়ে গিয়েছিল।

তারপর এক এক করে সেই গল্প শোনার আসর ফুরোল। এল একা একা গল্প পড়ার পালা। এখন ভাবি ভাগ্যিস সেই সময় মোবাইল ছিল না। ছিল না বলেই গল্প শোনার এমন ঐশ্বর্য পেয়েছি। এখন গল্প বলারও কেউ নেই।  শোনারও কেউ নেই। দাদু ঠাকুমা নাতি নাতনিকে গল্প শোনাতে চাইলেও তারা শুনতে চায় না। কারণ তাদের কাছে গল্প শুনে সময় নষ্ট করার মত সময় কোথায়! সেই সময় এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস করলে জীবনে কাজে লাগবে।

আর পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো এই জীবনে যেটুকু অবসর সময় পাওয়া যায়; সেখানে স্মার্ট ফোন থাকলেই যথেষ্ট। ব্যাকডেটেড আনস্মার্ট দাদু ঠাকুমার বস্তাপচা ঝুলির গল্পের কী দরকার! একুশ শতকের মানুষ সত্যিই বড্ড স্মার্ট। ইউটিউব খুললেই গল্প শোনা যায়। তার জন্য দাদু ঠাকুমা জ্যাঠা কাকার কী দরকার! আজ আমাদের হরেকরকম বিনোদন আছে; কিন্তু যাপন নেই। জীবন বড় বেশি বাস্তব। তাই রূপকথা আজও খুঁজে ফেরে তার শৈশব।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...