আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি

বর্তমান সময়ের ব্যবসাভিত্তিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে এ যেন এক আদর্শ। একটা স্কুল। ভারি বইয়ের বোঝা নেই। হোম-ওয়ার্কের চাপ নেই। সিলেবাস শেষ করার দৌড় নেই। শিক্ষকের বকুনি নেই। মার নেই। কান্না নেই। ভয় নেই।

 নেই বাবা-মা এর টেনশন আর চাপও। চেনা ছকের বাইরে একটা ক্লাসরুম।

তাহলে এই নেই-রাজ্যের ইস্কুলে আছেটা কী?

আছে পড়ার আনন্দ। ইচ্ছে-খুশির মজা। ছাত্রছাত্রীদের ঝকঝকে হাসি মুখ।

ছাত্র-ছাত্রীদের ইউনিফর্মে সবুজ-নীল-সাদা গাছ নদী আর আকাশের কথা মনে করিয়ে দেয় বারবার। সকলের জামার পিঠে ‘বেঁধে বেঁধে’ থাকার লোগো। লেখা ‘ফোরাম’। বলতে চায় যেন আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।’

গাছগাছালি ঘেরা ক্লাসরুমে চলে নিয়ম-নীতি আর সহানুভূতির পাঠ। গাছ-পাহাড়- প্রকৃতিকে ভালবাসতে শেখায় মাস্টারমশাইরা।

কিন্তু তার জন্য কোনও বেতন দিতে হয় না এই স্কুলে। বদলে দিতে হয় শুধু প্লাস্টিক। হ্যাঁ, এমনই অদ্ভুত নিয়ম এই স্কুলের।  

প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীদের থেকে প্রতি সপ্তাহে ১০-২০টি প্লাস্টিক প্যাকেট জমা নেয় স্কুল। একইসঙ্গে নিজেদের অভিভাবক এবং আত্মীয়বন্ধুদের আবেদন রাখে প্লাস্টিক প্যাকেট না পুড়িয়ে তাদের হাতে দিয়ে দিতে। 

গুয়াহাটির ওই স্কুলটিই সম্ভবত বিশ্বের প্রথম কোনও স্কুল যেখানে বেতন ব্যাগ ভর্তি প্লাস্টিক।

গুয়াহাটি শহর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরত্বে পামোহিতে গাছপালা ঘেরা এই স্কুলের নাম ‘অক্ষর’। ২০১৬ সালে যাত্রা শুরু।

পামোহিতে বেশির ভাগ মানুষ আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর। এখানকার মানুষজনের পেশা হয় পাথর কাটা, না হলে রাজমিস্ত্রি। চা শ্রমিকও আছেন কেউ কেউ। নুন আনতে পান্তা ফুরনোর সংসার। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানো এখনও বিলাসিতা।

বাঁশের কুঁড়েঘর দিয়ে তৈরি অক্ষর স্কুলের ক্লাসরুম। কোথাও কোনও ‘কংক্রিট টাচ’ নেই। মেইন গেট বাদে স্কুল ক্যাম্পাসের সমস্ত কিছুই বাঁশ আর কাঠের তৈরি।

শুরুতে  ছাত্রছাত্রী ছিল মেরেকেটে ১৫ কিংবা ২০। তাদের নিয়ে চালু হয়েছিল অক্ষর স্কুল। তিন বছরে স্কুলের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাটা ১০০ ছাড়িয়েছে।

অক্ষর স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মজিন মুখতার এবং পারমিতা শর্মা।

২০১৬ তে নিউইয়র্ক থেকে পড়াশোনা শেষ করে গুয়াহাটি ফিরে আসেন মজিন। পারমিতা টাটা ইন্সটিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সের ছাত্রী ছিলেন।

স্থানীয় দরিদ্র ঘরের ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে দু’জন মিলে শুরু করেছিলেন অক্ষর বিদ্যালয়। সঙ্গে আরও কয়েকজন উৎসাহী যুবক।

শুরুর দিকটা অবশ্য সহজ ছিল না। বাড়ি বাড়ি ঘুরে শুরু হয়, শিশুদের স্কুলে ধরে আনার কাজ।

মজিন মুখতার জানান, অক্ষর বিদ্যালয়ে নিঃশর্তে ভর্তি করা হয় ছাত্রছাত্রীদের। পড়াশোনায় গরিব শিশুদের আগ্রহ বাড়াতে প্রতি শুক্রবার ক্লাস টেস্ট হয়। সাহিত্য, ভূগোলের মতো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বড় হয়ে যাতে নিজেরাই নিজেদের আয়ের পথ খুঁজে নিতে পারে সেজন্য হাতেকলমে বিভিন্ন কাজও শেখানো হয় ছাত্র-ছাত্রীদের। আশপাশের এলাকা থেকেও বাচ্চাদের এই স্কুলে ভর্তি করাতে আনেন অভিভাবকরা।

দারিদ্র সীমার নিচে থাকা শিশুদের জন্য শিক্ষার পাশাপাশি প্লাস্টিক দূষণের বিষয়টিও শুরু থেকেই তাঁদের ভাবনায় ছিল। বর্জ্য প্লাস্টিক রিসাইকেল করে যদি একটু হলেও পরিবেশটা বাঁচিয়ে রাখা যায়।

পারমিতা বলেন, স্কুল তখনও শুরু হয়নি। এই এলাকায় পা দিলেই পোড়া প্লাস্টিকের গন্ধে নাভিশ্বাস উঠত। পরে জানতে পারি এখানকার মানুষজন সারাদিনের ব্যবহার করা প্লাস্টিক পুড়িয়ে ফেলে, যার বিষ ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় গোটা এলাকা। অভিভাবকদের সঙ্গে শিশুরাও এই প্লাস্টিক পোড়ানোর কাজে অংশগ্রহণ করে। একটা বিরাট এলাকা জুড়ে প্লাস্টিকের জিনিসপত্র ডাঁই করে আগুন দিয়ে দেন বাসিন্দারা। এই প্লাস্টিক যে কতটা বিষাক্ত, প্রাণহানির কারণ সেটা এলাকাবাসীকে বোঝাতেই অনেকদিন সময় লেগে যায়। এই রাজ্যের মানুষ প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক ব্যবহার করে। আর এই অতিরিক্ত পরিমাণে প্লাস্টিকের ব্যবহার যে শুধু পরিবেশের ক্ষতি করছে তাই নয়; ধ্বংস করছে বাস্তুতন্ত্রও। 

অক্ষর স্কুলে পড়াশোনার জন্য কোনও টাকা লাগে না। লাগে শুধু প্লাস্টিক। শিক্ষার্থীদের কড়া নির্দেশ দেওয়া আছে, নিজের বাড়ির বা এলাকার, যেখানে যত প্লাস্টিক রয়েছে ব্যবহৃত বা অব্যবহৃত সব কিছু নিয়ে এসে জড়ো করতে হবে স্কুলে।

 কোনো প্লাস্টিক পোড়ানো যাবে না। গড়ে সপ্তাহে ২৫টি করে প্লাস্টিকের যেকোনো সামগ্রী জমা করতেই হয় স্কুলে।

সপ্তাহে যত প্লাস্টিক জমা হয় স্কুলে, সেগুলো দিয়ে ইকো-ব্রিক তৈরি করা হয় অক্ষরে।

মজিন জানান, স্কুলের ভিতরেই প্লাস্টিক থেকে বায়োডিগ্রেডেবল সামগ্রী তৈরির অনুমোদন দিয়েছে নর্থ-ইস্ট এডুকেশন রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন।

ছাত্রছাত্রীরাই বানায় এই ইকো-ব্রিক। একটা প্লাস্টিকের বোতলের ভিতরে অন্তত ৪০টি প্লাস্টিক বর্জ্য ঠেসে মুখ বন্ধ করে তৈরি করা হয় এই ইকো-ব্রিক। এই বোতল বছরের পর বছর সংরক্ষণ করা যায়। বাড়ি তৈরিতে বা কোনো নির্মাণ কাজে ইটের বদলে পরিবেশবান্ধব এই ইকো-ব্রিক ব্যবহার করা হয়। যার ফলে ইট-ভাটার দূষণও রোধ করা যায়।

এই স্কুলের আরো একটি বৈশিষ্ট্য হলো ছাত্রছাত্রীদের স্বনির্ভর করে তোলার প্রচেষ্টা।

ইকো-ব্রিক তৈরি করে স্কুলের বেশিরভাগ খরচ তোলে শিক্ষার্থীরাই। একটা প্লাস্টিকের বোতলের ভিতরে অন্তত ৪০টি প্লাস্টিক বর্জ্য ঠেসে মুখ বন্ধ করে তৈরি করা হয় এই ইকো-ব্রিক বা PET Bottle। এই বোতল বছরের পর বছর সংরক্ষণ করা যায়। বাড়ি তৈরিতে বা কোনও নির্মাণ কাজে ইটের বদলে পরিবেশবান্ধব এই ইকো-ব্রিক ব্যবহার করা হয়। যার ফলে ইট-ভাটার দূষণও রোধ করা যায়।

তাছাড়াও নানা হস্তশিল্পের জিনিসপত্রও তৈরি করে তারা নিজেরাই। বিদ্যুৎ খরচ বাঁচাতে স্কুলে রয়েছে সোলার প্যানেল। সেগুলিরও দায়িত্বে রয়েছে ছাত্র-ছাত্রীরাই।

২০১৭ সালে মজিন ও পারমিতার কাজের প্রশংসা করে জাতিসংঘ। ২০১৮ সালে এই স্কুলের খরচ চালানোর দায়িত্ব নেয় অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেড।

আসামের ‘অক্ষর’কে অনুকরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দিল্লির পাঁচটি সরকারি স্কুল। মুম্বইতেও এমন স্কুল তৈরির জন্য অক্ষর ফাউন্ডেশনের সাহায্য চাওয়া হয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে দেশ জুড়ে এমন একশোটিরও বেশি স্কুল তৈরির স্বপ্ন রয়েছে মজিন-পারমিতার।

অভিনেত্রী দিয়া মির্জা তাঁদের এই সুস্থসুন্দর ভাবনার প্রশংসা করেছেন।

 

গত বছরেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন মজিন মুখতার এবং পারমিতা শর্মা। এখন এই স্কুলটিকে এগিয়ে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।

মজিন- পারমিতার ‘অক্ষর ফাউন্ডেশন’ অসুস্থ, দুর্গত কুকুরদের নিয়েও কাজ শুরু করেছে সম্প্রতি। অসুস্থ, আহত। কেউ হয়ত মা হারা। সঙ্গী ভাই- বোনদের থেকে হারিয়ে গিয়েছে। রাস্তা থেকে কুকুর ছানাদের উদ্ধার করে তারা। অক্ষর স্কুলের ক্যাম্পাসেই গড়ে তোলা হয়েছে অ্যানিমাল শেল্টার। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাই দেখাশোনা করে। আহত কুকুরদের কীভাবে শুশ্রুষা করতে হয় তার পাঠও ছাত্রছাত্রীদের দিচ্ছে মনিজ- পারমিতাদের স্কুল। প্রথম ৬ মাসে প্রায় ২০ টি কুকুরকে আশ্রয় দিয়ে সুস্থ করে তুলেছে তারা।

    

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...