শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যদি হন ব্রজের কানাই, তাহলে নিত্যানন্দ প্রভুকে বলা হয় ব্রজের বলাই। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রেম ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে তার সব থেকে বড় সহায় হয়েছিলেন নিত্যানন্দ প্রভু। ১৪৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন একচক্রা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম ছিল হাড়াই পন্ডিত, মায়ের নাম ছিল পদ্মাবতী। শৈশবে নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর নাম ছিল কুবের। বাল্যে তিনি ছিলেন অত্যন্ত শান্ত ও ধর্মানুরাগী। মাত্র ১২ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসীদের সঙ্গে তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়াতেন। এইভাবেই একদিন তিনি বৃন্দাবন ধামে এসে পৌঁছান। সেখানে পরম সাধক মাধবেন্দ্রপুরীর দর্শন লাভ করেন। ছোট্ট বালক কুবের মাধবেন্দ্র পুরীকে বলে," প্রভু কৃষ্ণ প্রেমে আমায় দীক্ষা দিন। এই অভাজনকে উদ্ধার করুন। "
দীক্ষা লাভের পর কুবেরের নতুন নাম হয় নিত্যানন্দ। এরপর তিনি আবার তীর্থ পর্যটন করতে বেড়িয়ে পড়েন। একদিন তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আহ্বান শুনতে পেলেন। যেন ভগবান তাঁকে বলছেন, নবদ্বীপে গিয়ে নিমাই পণ্ডিতের ভাগবত প্রেম প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ কর। এরপর সুদূর বৃন্দাবন থেকে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে নিত্যানন্দ নবদ্বীপে এসে পৌঁছান শ্রী গৌরাঙ্গের কাছে। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু ইতিমধ্যেই তার আবির্ভাবের কথা জানতে পেরেছেন। তিনি ভক্তদের সেই কথা জানিয়ে বললেন, "কাল রাত্রে এক অপূর্ব স্বপ্ন দেখেছি আমি, অনিন্দ্য সুন্দর এক অবধূত পুরুষ জ্যোতির্ময় মূর্তিতে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। বললেন, তিনি আর আমি নাকি অভিন্ন হৃদয়। আজি নাকি তিনি আমায় দর্শন দেবেন। তোমরা বেরিয়ে পড়ো। দেখো কোথায় সেই মহাপুরুষ রয়েছেন। তাঁকে দেখার জন্য আমার মন প্রাণ ব্যাকুল হয়েছে।"
ভক্তরা তখন নবদ্বীপের কোনখানে নিত্যানন্দ মহাপ্রভু এসে উঠেছেন সেটা জানবার জন্য সর্বত্র খুঁজতে থাকলেন, কিন্তু ভগবানের লীলা গৌর সুন্দর ব্যতীত নিতাইকে পাওয়া যাবে না, তাই ভক্তরা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও নিত্যানন্দ প্রভুকে পেলেন না পেলেন না। তখন শ্রী গৌরাঙ্গ নিজেই বেরিয়ে পড়লেন তার অন্তরঙ্গ সখার অনুসন্ধানে। নবদ্বীপের রাজপথে শ্রী গৌরাঙ্গ ও শ্রীনিত্যানন্দের দেখা হল। তাঁদের দেখা হওয়ার সেই দৃশ্য বড়ই মধুর। তাঁরা যেন দীর্ঘ সময় ধরে একে অপরের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। নিতাই ছিলেন নিমাইয়ের থেকে নয় বছরের বয়সে বড়।
পরের দিন শ্রীবাস পণ্ডিতের গৃহে নিত্যানন্দ মহাপ্রভু ব্যস পূজা করবেন বলে আবির্ভূত হন। সন্ধ্যাবেলা শ্রী গৌরাঙ্গ এসে উপস্থিত হয়েছেন শ্রীবাস অঙ্গনে, সমস্ত দেহ তার থরথর করে কাঁপছে ভাবাবেগে, অশ্রু কম্প, পুলক ইত্যাদি সাত্ত্বিক বিকারের চরম প্রকাশ ঘটেছে। নিত্যানন্দের থেকে বিদায় চেয়ে নিয়ে মহাপ্রভু চলে গেলেন নিজের বাড়িতে। অন্যদিকে সেই রাত্রে নিত্যানন্দ প্রভু থেকে গেলেন শ্রীবাস গৃহে।
প্রভাতে উঠে শ্রীবাস দেখলেন নিত্যানন্দ প্রভু সংবিৎ শূন্য , সন্ন্যাস দন্ড ও কমন্ডলু ভগ্ন। খবর পৌঁছে গেল মহাপ্রভুর কাছে খবর পেয়েই মহাপ্রভু চলে গেলেন নিত্যানন্দ প্রভুর কাছে। স্নেহভরে ভাবাবিষ্ট নিত্যানন্দের হাত ধরে তিনি নিয়ে গেলেন গঙ্গার ঘাটে ও নিত্যানন্দ প্রভুকে মহাপ্রভু সেখানে স্নান করালেন। এদিকে ব্যাস পূজার সময় উপস্থিত, শ্রীবাসের অঙ্গনে ষোড়শোপাচারে পূজার আয়োজন প্রস্তুত। মহাপ্রভু পর্ষদ-সহ কীর্তন করছেন, সেই সময় পুজোর শেষে ব্যাসদেবের উদ্দেশ্যে মালা নিবেদন করতে হবে কিন্তু নিত্যানন্দ প্রভুর সে দিকে হুঁশ নেই ভাবে বিভোর হয়ে নিশ্চুপ বসে রয়েছেন তিনি।
মহাপ্রভু ঘরের মধ্যে এসে বললেন "শ্রীপাদ কী করছ তুমি? ব্যাসদেবের উদ্দেশ্যে মালা নিবেদন কর।" হঠাৎ নিত্যানন্দের চোখে মুখে এক অদ্ভুত ভাব খেলে গেল। তিনি তাকিয়ে দেখলেন বহু বাঞ্ছিত তাঁর ভগবান নতুন রূপ ধারণ করে গৌরসুন্দর বেশে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। এরপর নিত্যানন্দ প্রভু আনন্দের সঙ্গে গৌরাঙ্গের কণ্ঠেই মালাটি পরিয়ে দিলেন। এরপর দীর্ঘ সময় নবদ্বীপ শহরে নিত্যানন্দ মহাপ্রভু চৈতন্য মহাপ্রভুর সঙ্গে ছিলেন এবং তাঁরা অনেক লীলা করেছেন। তাঁদের একাধিক লীলার মধ্যে অন্যতম একটি লীলা হল পাপী জগাই, মাধাইকে উদ্ধার।
নদীয়ার পথে এই দুই দস্যু তুল্য মানুষকে ভক্তি কথা শুনিয়েছিলেন নিত্যানন্দ প্রভু। যার জন্য মাধাই একটা ভাঙা কলসির কানা ছুঁড়ে মারেন নিত্যানন্দ প্রভুর মাথায়। মুহূর্তে রক্তধারা বয়ে যায়, কিন্তু নিত্যানন্দ প্রভুর তাতেও ক্রোধ উৎপন্ন হয় না, তিনি বলতে থাকেন, একবার হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ কর। অন্যদিকে নিত্যানন্দের শরীরে আঘাত শুনে ছুটে এলেন মহাপ্রভু , পাপিষ্ঠ মাধাই কে হত্যা করতে আহ্বান করলেন চক্র। নিত্যানন্দ প্রভু তখন মহাপ্রভুর চরণে পড়ে বললেন, প্রভু তুমি তো এবার প্রেম দিয়ে জগৎ ভাসাবে, চক্র আহ্বান করলে কেন? তোমার পায়ে পড়ি এদের ক্ষমা কর। মহাপ্রভু তখন শান্ত হলেন এবং দুই ভাই জগাই মাধাইকে উদ্ধার করলেন।
নিত্যানন্দ প্রভুর প্রেম প্রচারের সর্বপ্রথম করুণার দৃষ্টান্ত হলো এই পাপী জগাই মাধাই উদ্ধার, হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র নামে যে পতিত পাপী উদ্ধার হয় তারই দৃষ্টান্ত ছিল এরা আর নিতাই কৃপা ভিন্ন যে গৌরাঙ্গ মেলে না তাও প্রমাণ হয়ে যায় এই ঘটনায়। নিত্যানন্দ প্রভু ছিলেন মহাপ্রভু নিত্য সঙ্গী। শোনা যায় চৈতন্যদেবের সন্ন্যাস গ্রহণের পর তার জননী শচী দেবীর কাছে পুত্র রূপে অবস্থান করেন নিত্যানন্দ। সেই সময় নিত্যানন্দের আগমনে পুনরায় নবদ্বীপে হরিনামের বন্যা ওঠে।
শ্রী রাঘব পণ্ডিতের ঘরে বসে মহাপ্রভু একবার বলেছিলেন, " শুনো রাঘব তোমারে গোপ্য কথা কই। আমার দ্বিতীয় নাই, নিত্যানন্দ বই।" এত বড় মর্যাদা মহাপ্রভু আর কাউকে দেননি নিত্যানন্দ প্রভু ভিন্ন। পরবর্তীতে গোবর্ধন নামক বৈষ্ণবের অনুরোধে নিত্যানন্দ মহাপ্রভু শালিগ্রামের পণ্ডিত সূর্যদাসের দুই কন্যা বসুধা ও জাহ্নবীকে বিবাহ করেন এবং সস্ত্রীক তিনি খড়দহ গ্রামে বসবাস করেন, নিত্যানন্দ প্রভুর বীরভদ্র ও গঙ্গা নামে এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তান ছিল। চৈতন্যদেবের লীলা সংবরণের কিছু সময় পর চৈতন্যের অন্যতম লীলা সঙ্গী নিত্যানন্দ প্রভুর তিরোধান ঘটে। সালটা ছিল ১৫৩২- যে সময় নিত্যানন্দ প্রভু নিত্যধামে প্রবেশ করেন আর ব্রজের কানাই ও বলাই চলে যাওয়ায় বৈষ্ণব সমাজে তৈরি হয় হাহাকার।