নিস্তারিণী মন্দির, বাংলা বহুদিন ধরেই মাতৃশক্তির আরাধনা করে আসছে। দীর্ঘকাল আগের কথা, তখন শেওড়াফুলির নাম ছিল সাড়াপুলি। গঙ্গা তীরের জনপদ সাড়াপুলিতেই স্থাপিত হয়েছিল নিস্তারিণী কালী মায়ের মন্দির। মন্দির থেকে গঙ্গার দূরত্ব হাঁটাপথে মিনিট খানেক। শেওড়াফুলি রাজবংশের রাজা হরিশ্চন্দ্র রায় ১৮২৭ সাল, বাংলার ১২৩৪ সনে জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গঙ্গার তীরবর্তী নিজ রাজ্যে পঞ্চমুণ্ডী আসনে শিবপত্নী দক্ষিণকালিকা শ্রীশ্রী নিস্তারিণী মাতার পাষাণময়ী মূর্তি তথা মন্দির ও সেবা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা। মন্দিরের দেবসেবা ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে শেওড়াফুলি রাজপরিবার।
মন্দিরের দেওয়ালে প্রস্তর ফলকে লেখা রয়েছে,
বর্ধমান জেলার অন্তর্ভুক্ত পাটুলির দত্ত রাজবংশজাত সাড়াপুলি বা শেওড়াফুলি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা, ক্ষত্রিয়রাজ রাজা মনোহর রায়ের পুত্র রাজা রাজচন্দ্র রায়, রাজচন্দ্রের প্রপৌত্র রাজা হরিশ্চন্দ্র রায় ১৮২৭ সালে (১২৩৪ সালে জ্যৈষ্ঠ মাসে)। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠাকাল ও প্রতিষ্ঠাতার দুই পাওয়া যায়। শোনা যায়, শেওড়াফুলি রাজবংশের রাজা হরিশ্চন্দ্র রায়ের প্রথম স্ত্রী সর্বমঙ্গলা দেবীর অপমৃত্যু হয়েছিল। অপঘাত মৃত্যুর জন্য পণ্ডিতদের বিধান মেনে আত্মার শান্তির জন্য নিস্তারিণী কালী মন্দির নির্মাণ করেন। আদপে মন্দিরে দেবী হলেন দেবী কালিকা।
মন্দিরটি বেদির উপর প্রতিষ্ঠিত, সমতল ছাদযুক্ত, দক্ষিণমুখী দালান। মন্দিরের সামনের দিকে সাতটি খিলান এবং পাশে পাঁচটি খিলান রয়েছে। যা থামের উপর স্থাপিত। কলাগেছ্যা স্থাপত্য রীতিতে মন্দির তৈরি। মন্দিরের সামনের দিকের ঘরটিতে দেবী নিস্তারিণী ও দু-পাশের দুটি ঘরে দুটি শ্বেত পাথরের শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত। এখানে কৃষ্ণপুজো হয়। কৃষ্ণের সঙ্গে রাধা থাকেন না। নিস্তারিণী কালী মায়ের হাতে খাড়ার বদলে থাকে তলোয়ার। অষ্ট কল পদ্মের উপর বিরাজমান, পাশের ঘরে বিরাজমান মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা। নিস্তারিণী মায়ের মন্দিরে দুটি প্রবেশ-দ্বার। গর্ভগৃহের সামনেই অলিন্দ। শেওড়াফুলি রাজবংশের আদি নিবাস ছিল বর্ধমান জেলার পাটুলি-নারায়ণপুর। তাদের বংশের আরাধ্য দেবদেবীর প্রাচীন কয়েকটি বিগ্রহ এই মন্দিরে রাখা রয়েছে। মন্দিরে কৃষ্ণ রায় ও গোপাল প্রতিষ্ঠিত। তাদের নিত্য পুজো চলে। মহিষমর্দ্দিনী দশভুজা ছাড়াও লক্ষ্মী, গণেশ ও শ্বেতপাথরের দেবী অন্নপূর্ণার মূর্তিসহ কষ্টিপাথরের বহু প্রাচীন বিগ্রহ রয়েছে। কাঠের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত বাঁশি হাতে শ্রীকৃষ্ণের মূর্তিও দেখা যায়। ঠাকুরের নিত্য ভোগ মন্দিরেই রাঁধা হয়।
নিস্তারিণী দক্ষিণা কালিকার আরেক রূপ, শিবের উপর দণ্ডায়মান দেবী চতুর্ভূজা। দেবীর বাম দিকের উপরের হাতে তলোয়ার ও তার নিচের হাতে নরমুণ্ড এবং ডান দিকের দু-হাত বর ও অভয় মুদ্রায় রয়েছে। বড় পদ্মের উপর দেবীকে স্থাপন করা হয়েছে। প্রচলিত লোক বিশ্বাস মতে, শেওড়াফুলির এই দেবী খুবই জাগ্রত। দেবী নিস্তারিণীর আরাধনা করলে দুঃখের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যায়, এটাই মানুষের বিশ্বাস। কথিত আছে, নিত্যদিন সাংসারিক অশান্তি থেকে নিস্তার পেতেই প্রথম স্ত্রীকে হত্যা করেছিলেন পাটুলির রাজা হরিশ্চন্দ্র দত্ত রায়। সঙ্গে এও শোনা অপঘাতে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর স্ত্রীর। মৃত্যুর কারণ নিয়ে ধন্দ থাকলেও, আদপে কোন কিছু থেকে নিস্তার পেতেই নিস্তারিণী কালীপুজো শুরু করেন রাজা।
১৮২৭ সালের ঘটনা, বর্ধমানের পাটুলির রাজা হরিশ্চন্দ্রের তিন রানি ছিল। তাঁদের মধ্যে নিত্যদিন অশান্তি লেগেই থাকত। একদা একদিন নারায়ণপুর প্রাসাদে ফিরে তিন রানির ঝগড়া দেখে চোটে যান রাজা। তরবারি দিয়ে বড় রানিকে হত্যা করেন। বর্ধমানের পাশাপাশি শ্রীরামপুর, শেওড়াফুলি, বৈদ্যবাটি অঞ্চলে রাজার অনেক সম্পত্তি ছিল। ঘটনার দিনকয়েক পরে বিষণ্ণ রাজা একদিন রাতে ঘোড়া ছুটিয়ে শ্রীরামপুরে চলে আসেন। সেখানে পূর্বপুরুষ প্রতিষ্ঠিত রামসীতা মন্দিরে সারারাত বসে থাকেন। ক্লান্তি অবসাদে তিনি এক সময় ঘুমিয়ে পড়েন, স্বপ্ন দেখেন। গঙ্গা থেকে পাওয়া কষ্টি পাথর দিয়ে তৈরি হয় কালী মূর্তি।
শেওড়াফুলিতে গঙ্গার পাড়ে মন্দির গড়েন। দেবীর অধিষ্ঠান পঞ্চমুণ্ডির আসনে। মন্দিরে কোনও ঘট নেই। দেবীর হাতে রয়েছে তরবারি, যা আজও সেই রাজ পরিবারের স্মারক বহন করে চলেছে। রাজা হরিশ্চন্দ্রের বড় রানির নাম ছিল সর্বমঙ্গলা। এমনও কথা প্রচলিত রয়েছে, মন্দিরে সেই বড় রাণীকেই দেবীর রূপ দিয়েছিলেন রাজা।
সারা বছর নিস্তারিণী মন্দিরে পুজো হয়। প্রত্যেক অমাবস্যায় বিশেষ পুজোপাঠ। এখানে ছাগ বলির প্রথা এখনও প্রচলিত। অমাবস্যায় ছাগবলি দেওয়া হয়। কৌশিকী অমাবস্যার রাতে বিশেষ পুজো হয়। সারাদিন ধরে চলে পুজো, যজ্ঞ, চণ্ডীপাঠ। পরদিন হয় ভোগ-বিতরণ। ভক্তদের ঢল নামে নিস্তারিণী মন্দিরে।
রাণী রাসমণি দেবী হঠাৎ একদিন স্বপ্নে দেখলেন, দেবী তাঁকে আদেশ করছেন ভাগীরথীর তীরেই মন্দির প্রতিষ্ঠার। দেবীর আদেশমতই রাণী রাসমণি ভাগীরথীর তীরে মন্দির স্থাপন করবেন বলে মনস্থির করলেন। জায়গা খুঁজতে রাণী রাসমণি বজরায় করে প্রতিদিনই গঙ্গাবক্ষে ঘুরে বেড়াতেন। খুঁজে বেড়াতেন মনের মত জায়গা। একদিন তিনি বজরা করে শেওড়াফুলি ঘাটের দিকে যাচ্ছিলেন। রাণী শুনেছিলেন শেওড়াফুলিতে অধিষ্ঠাত্রী নিস্তারিণী দেবী অত্যন্ত জাগ্রত। নিস্তারিণী দেবী দর্শনের উদ্দেশ্যেই রাণী পাড়ি দিলেন শেওড়াফুলির পথে। ঘাটের কাছে বজরা আসতেই রাণীমা এবং মাঝিমাল্লারা দেখলেন ঘাটের কাছে দাঁড়ানো এক কিশোরী তাদের ডাকছেন। পরনে লাল পাড় সাদা শাড়ি। রাণীমার আদেশে বজরা ভিড়ল। রাণীমা কিশোরীকে নিস্তারিণী মন্দিরে যাওয়ার পথ দেখাতে বললেন। রাণীমাকে কিশোরীটি বলল, 'আমি তো সেখানেই থাকি গো।' রাণীমাকে বজরা থেকে নেমে আসতে বলল সে। রাণীমাও বজরা থেকে নেমে কিশোরীকে অনুসরণ করলেন। মন্দিরের কাছাকাছি আসতেই রাণীমাকে নিস্তারিণী মায়ের থান দেখিয়ে হঠাৎ হারিয়ে গেল কিশোরীটি। কিশোরীটির কথা ভাবতে ভাবতে তিনি দেবীদর্শন করলেন। রাণী দেবীর মুখের দিকে তাকাতেই চোখ আর মনমোহিনী হাসির সঙ্গে মেয়েটির মিল খুঁজে পেলেন। এই ঘটনার ২৪ বছর পরে দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা হল।
মা নিস্তারিণী মন্দির অনাড়ম্বর। মন্দির প্রাঙ্গণে নাটমন্দির, সামনেই হাড়িকাঠ। পঞ্চমুণ্ডির আসনের উপর তামার বেশ বড় একটা পাপড়িওয়ালা পদ্ম। তার উপরেই দুহাত মাথার দিকে তোলা মহাদেবের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে মা নিস্তারিণী। কষ্টিপাথরে দক্ষিণাকালীর রূপ মনকাড়া, ত্রিনয়নী এলোকেশী। করুণা ভরা চোখ। দেবীমূর্তি উচ্চতা আড়াই-তিন ফুট।
রাজা হরিশ্চন্দ্র রায়ের নিস্তারিণী মন্দির নির্মাণের এক কাহিনী রয়েছে। লোকমুখে শোনা যায়, হরিশ্চন্দ্র ছিলেন ধার্মিক, নিষ্ঠাবান। কিন্তু ওই স্ত্রী হত্যার কারণে অনুতপ্ত ও অনুশোচনায় জর্জরিত রাজা কাউকে কিছু না জানিয়েই আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু রাজার আর আত্মহত্যা করা হয়ে ওঠেনি।
ঘুরতে ঘুরতে রাতে গভীর জঙ্গলের মধ্যে এক বৃক্ষতলে রাজা আশ্রয় নেন। ক্লান্ত রাজা ঘুমের মধ্যে দেবীকে স্বপ্নে দেখলেন। দেবী স্বপ্নাদেশ দিলেন রাজাকে, তিনি যেন গঙ্গাতীরে মন্দির ও দক্ষিণা কালীর মূর্তি স্থাপন করেন। যে শিলাখণ্ডের উপর তিনি শুয়ে আছেন সেটি দিয়েই নির্মাণ করতে হবে দেবী বিগ্রহ। রাজা ঘুম থেকে উঠে দেখলেন, যার উপর শুয়েছিলেন সেটি সত্যিই একটি শিলাখণ্ড।
এরপরই রাজা ফিরলেন রাজদরবারে। রাজকর্মচারীদের আদেশ দিলেন ওই জঙ্গল থেকে শিলাখণ্ডটি তুলে আনার। পরে তিনি জানতে পারলেন শিলাখণ্ডটি আসলে একখণ্ড মূল্যবান কষ্টিপাথর। তারপরেই ঘটল অত্যাশ্চর্য এক ঘটনা। হঠাৎ একদিন রাজবাড়িতে আবির্ভাব ঘটল এক ভাস্করের। ভাস্কর জানালেন দেবী কালিকার আদেশেই তিনি দেবীর মূর্তি গড়তে এসেছেন। তিনি মূর্তি নির্মাণের আদেশ দিলেন। মায়ের মূর্তি তৈরি হয়ে মন্দিরে স্থাপিত হল। রাজা হরিশ্চন্দ্র মন্দিরের পশ্চিমে একটি কুটির নির্মাণ করলেন। জীবনের সেদিন পর্যন্ত সেখানেই থাকতেন রাজা।