তাঁর কাহিনি একাধিক বার উঠে এসেছে রূপালী পর্দায়। কিন্তু তিনি থেকে গিয়েছেন আড়ালেই। ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’, ‘শ্যামলী’র মতো বিখ্যাত সিনেমা হয়েছিল তাঁর কাহিনী নিয়ে। কিন্তু লেখিকার খোঁজ কেউ রাখেনি। তিনি নিরুপমা দেবী।
যোগমায়া ও নফরচন্দ্র ভট্টর কন্যা নিরুপমা। বহরমপুরের গোরাবাজার অঞ্চলে রক্ষণশীল বনেদি পরিবার।
বাবা নফরচন্দ্র ছিলেন ইংরেজি শিক্ষিত। কিন্তু গোঁড়া রক্ষণশীল।
১৮৯৩ সালে মাত্র দশ বছর বয়সে নিরুপমার বিয়ে হয় নদিয়া জেলার সাহারবাড়ির নবগোপাল ভট্টর সঙ্গে। বিয়ের চার বছরের মাথায় যক্ষ্মা রোগে নবগোপাল মারা যান ১৮৯৭ সালে। মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে বালবিধবা হয়ে নিরুপমা ফিরে আসেন ভাগলপুরে তাঁর পিতৃগৃহে।
তাঁর বাবা তখন কাজের সূত্রে ভাগলপুরে। শোকের ধাক্কায় কথা হারিয়ে গিয়েছিল তাঁর। চঞ্চল চতুর্দশী কারুর সঙ্গে কথা বলতেন না। সবকিছু থেকে ক্রমশ গুটিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে। বিধবা বিবাহ আন্দোলন এবং বিদ্যাসাগরের চরম বিরোধী ছিলেন নফরচন্দ্র। কাজেই নিরুপমার পরবর্তী জীবন কেমন হতে চলেছে সহজেই অনুমান করা সম্ভব।
সেই সময় তাঁর বাল্যবন্ধু অনুরূপা দেবী তাঁকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনেন। নিরুপমা দেবী হাতে কলম তুলে নেন। কবিতা লিখতে শুরু করেন। পরে গদ্যে সাহিত্যে।
চোদ্দোর কিশোরী বুঝিয়েছিলেন তিনি বৈধব্য নারী জীবনের একমাত্র দুর্গতি নয়, জীবন তার চেয়ে বড়।
‘অনুপমাদেবী’ ছদ্মনামে লিখতেন নিরুপমা দেবী। ১৯০৪ সালে ‘প্রত্যাখান’ গল্পটি লিখে কুন্তলীন পুরস্কার পান। তার পরে ১৯৪১ পর্যন্ত একে একে তিনি লিখে গিয়েছেন ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ (১৯১৩), ‘দিদি’ (১৯১৫), ‘আলেয়া’ (১৯১৭), ‘বিধিলিপি’ (১৯১৯), ‘শ্যামলী’ (১৯১৯), ‘বন্ধু’ (১৯২১), ‘আমার ডায়েরী’ (১৯২৭), ‘যুগান্তরের কথা’ (১৯৪০), ‘অনুকর্ষ’র (১৯৪১) মতো উপন্যাস ও ছোটগল্প।
এই সময়টায় মহিলা সাহিত্যিক হিসেবে তাঁকে আলাদা করে চিনেছিল বাঙালি। খুব গালভারি বিষয় নয়, বাঙালি বাড়ির অন্দরমহলে মহিলাদের বেঁচে থাকা, তাদের সুখ- দুঃখ, অপ্রাপ্তির ছবিকে তুলে ধরেছিলেন। সেসব কাহিনীর দাবী ছিল পাঠকের মরমের কাছে।
নিরুপমা দেবীর জীবনে তাঁর দাদা বিভূতিভূষণ ভট্ট এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ভীষণ প্রভাব ফেলেছিলেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর দাদার বন্ধু ছিল। অসম্ভব স্নেহ করতেন নিরুপমা দেবীকে। লিখেছিলেন, “আমার সত্যকার শিষ্যা, এবং সহোদরার অধিক একজন আছে, তাহার নাম নিরুপমা’।
শরৎচন্দ্র তাঁকে সোনার পেন উপহার দিয়েছিলেন।
তাঁর আর শরৎচন্দ্রের সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক নিয়ে কটুক্তিও কম হয়নি। সাহিত্যিকদের এক অংষের মতে নিজের জীবনী লিখতে গিয়ে শরৎ অনুরাগীদের অসম্মান ও লাঞ্ছনার মুখে পড়তে হয়েছিল। সাহিত্যের জগৎ থেকে সরে যাওয়ার সেটাও একটা কারণ বলে মনে করা হয়।
লেখালেখি প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সরাসরি জড়িয়ে পড়েন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। বিপ্লবীদের আশ্রয় দিতেন নিজের বাড়িতে।
হিন্দু সমাজের রক্ষণশীলতা বারবার তাঁর জীবনের স্বাভাবিক গতিকে রোধ করেছিল। তাই রক্ষণশীলতার অন্ধকারকে চিনতেন খুব ভাল ভাবে। সেই অন্ধকার থেকে মুক্তি দিতে পারে এক মাত্র শিক্ষা। মেয়েদের শিক্ষার জন্য স্কুল তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন বন্ধু সুষমা সিংহকে নিয়ে সাধারণ মানুষের দরজায় দরজায় ঘুরে অর্থ সংগ্রহ করে বহরমপুরে মেয়েদের জন্য চালু করেছিলেন ‘কাশীশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়’।
তাঁর কর্মকাণ্ড শুধু মাত্র জেলার পরিধিতে আটকে ছিল না। কলকাতাতেও মেয়েদের অধিকারের জন্য কণ্ঠ তুলেছিলেন। কলকাতার টাউন হলে বিধবা-বিবাহের প্রস্তাবের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন।
১৯৩৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘ভুবনমোহিনী’ স্বর্ণপদক ও ১৯৪৩ সালে ‘জগত্তারিণী’ স্বর্ণপদকে সম্মানিত করে।
ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত ব্যক্তিত্বময়ী ছিলেন। এক সময় বহরমপুর এবং ভাগলপুর ছেড়ে বৃন্দাবন চলে যান। অসুস্থ মায়ের কাছে। জীবনের শেষ দশ বছর সেখানেই কাটে। চেনা পরিসর থেকে অনেক দূরে অসুস্থ মাকে নিয়ে থাকতেন। আর্থিক সংকটেও পড়তে হয়েছিল এক সময়।
১৯৫১ সালের শীতে প্রয়াত হলেন নিরুপমা। ততদিনে বাংলা সাহিত্য তাঁকে ভুলেছে।