বাংলা চলচ্চিত্রে সঙ্গীতবিহীন সিনেমা বানিয়ে ইতিহাস গড়েছিলেন নীরেন লাহিড়ী

অভিনেতা হিসেবে, চিত্রপরিচালক হিসেবে, সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে, চিত্রনাট্যকার হিসেবে নীরেন লাহিড়ী প্রায় চার দশক ধরে বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্র জগতে অসাধারণ অবদান রেখে গেছেন। হিন্দি-বাংলা মিলিয়ে পরিচালনা করেছেন প্রায় চল্লিশখানা ছায়াছবি। তাঁর পরিচালিত উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত ‘ইন্দ্রানী’ (১৯৫৮) ছবিটি বাংলা ছবির জগতে মাইলস্টোন। এই ছবিতে আজও যেমন আমরা প্রত্যেকের অনন্যসাধারণ অভিনয় উপভোগ করি, তেমনি দেখি ক্যামেরার অনবদ্য কাজ, আর মুগ্ধ হয়ে শুনি অসাধারণ সব গান।

‘ইন্দ্রানী’ ছবিতে নচিকেতা ঘোষের সুরে ‘ভাঙরে ভাঙরে ভাঙ, পাথর ভাঙ’ গানে আদ্যন্ত যেমন আমরা গণসঙ্গীতের অসাধারণ উন্মাদনা শিরায় শিরায় উপলব্ধি করি, তেমনি গানটি শুধু কানে শুনেই উৎসাহী শ্রমিকদের যূথবদ্ধভাবে হাতুড়ি চালিয়ে পাথর ভাঙার দৃশ্যটি যেন আমরা চোখের সামনে দেখতে পাই। এছাড়াও এই ছবির ‘সূর্য ডোবার পালা’, ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই’, ‘ঝনক ঝনক কনক কাঁকন বাজে’, ‘ওগো সুন্দর জানো নাকি’ গানগুলো তো ক্লাসিক; সমসময়ে সাধারণের মুখে মুখে ফিরত, আজও ফেরে। নীরেন লাহিড়ী শুধু সঙ্গীতবোদ্ধা পরিচালকই ছিলেন না, ছিলেন একজন সঙ্গীতজ্ঞও। ছবির জন্য লাগসই গানটি সঙ্গীত পরিচালকের কাছ থেকে বের করে নিতে জানতেন।

আসলে, খুব ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়েছিল নীরেন লাহিড়ীর। তিনি ছিলেন বড়লোকের সন্তান। ১৯০৮ সালের ১৭ জুলাই তাঁর জন্ম হয় কলকাতায়। তাঁর পিতা যতীন্দ্রনাথ লাহিড়ী ছিলেন সেই সময়কার বিখ্যাত আইনজীবী। তাছাড়া নাটোরের রাজবাড়িতে ছিল তাঁর মামাবাড়ি। মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায় ছিলেন তাঁর মাতামহ। সেকালে রাজবাড়ি হোক বা বড়লোকবাড়ি, সঙ্গীতের চর্চা অবশ্যই থাকত, বড় বড় ওস্তাদ ও বাঈ আনিয়ে সঙ্গীতের আসর বসত। বাড়ি হোক বা মামাবাড়ি—সেই সাঙ্গীতিক পরিবেশের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন নীরেন। পেয়েছিলেন উপযুক্ত গুরুর কাছে সঙ্গীতের শিক্ষা। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য—উভয় ধারার সঙ্গীতেই তিনি সমান অনুরক্ত ছিলেন। ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন পাশ্চাত্য সঙ্গীতে উচ্চশিক্ষার জন্য। সঙ্গীতকে এভাবে নির্বিশেষে আত্তীকরণ করেছিলেন বলেই নীরেন লাহিড়ী পরিচালিত ছায়াছবিতে দেখা যায়, সঠিক প্রয়োগে সঙ্গীত নাটকীয় ভূমিকা রাখে, কাহিনির অগ্রগতিতে সাহায্য করে।

যাই হোক, সঙ্গীতজ্ঞ এই মানুষটিই আবার সঙ্গীতবিহীন ছবি বানিয়ে ইতিহাস তৈরি করে দিয়েছিলেন। বাংলা ছায়াছবি কথা বলতে শেখার পর থেকে এমন কোন ছায়াছবি তৈরি হয়নি; যাতে গান ছিল না। দর্শক ছায়াছবিতে গান দারুণ উপভোগ করতেন। এখনও আমরা আপামরের উপভোগ্য ছবি গান ছাড়া ভাবতেই পারি না। যাই হোক, গায়ক-নায়ক গায়িকা-নায়িকার যুগ পেরিয়ে বাংলা সিনেমা যখন প্লেব্যাক সিস্টেমে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, তখন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম সঙ্গীতবিহীন ছবিটি তৈরি করেন নীরেন। সময়ের নিরিখে, দর্শক রুচির বিপ্রতীপে এটি ছিল এক দারুণ সাহসী পদক্ষেপ। ছবির নাম, ‘ভাবীকাল’ (১৯৪৫)। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, হরিধন মুখার্জি, তুলসী চক্রবর্তী, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, চন্দ্রাবতী দেবীর মতো দাপুটে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। প্রচলিত ফর্মুলার বাইরে হেঁটেও ছবিটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল।

বাংলা ছায়াছবির জগতে নীরেন আসেন চব্বিশ বছর বয়সে। পরবর্তীকালের বিখ্যাত পরিচালক দেবকী বসুর প্রথম ছবি ‘একদা’ (১৯৩২)-তে নায়কের চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তাঁর এই জগতে আসা। ‘একদা’ আসলে ছিল একটি শর্টফিল্ম, কুড়ি মিনিটের কাহিনিচিত্র। যাই হোক, ছবিতে অভিনয় করতে এসে ক্রমে চিত্রপরিচালক হওয়ার বাসনা জাগে নীরেনের মনে। অভিনয়ের পাশাপাশি তাই নিউ থিয়েটার্সের দুই বিখ্যাত চিত্রপরিচালক প্রমথেশ বড়ুয়া ও সুশীল মজুমদারের সহকারী হিসেবে কাজ করে পরিচালনার খুঁটিনাটি শিখতে থাকেন। এরই মাঝে ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালকরূপেও আত্মপ্রকাশ করেন একইসঙ্গে নিউ থিয়েটার্সের তিনটি ছবিতে ১৯৩৬ সালে। ছবি তিনটির নাম—‘আশিয়ানা’, ‘তরুবালা’ ও ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ ছবিতে।

নিউ থিয়েটার্সে দীর্ঘ আট বছর অভিনেতা, সঙ্গীত পরিচালক ও সহকারী চিত্রপরিচালক হিসেবে কাজ করার পর অবশেষে নীরেন সুযোগ পান স্বাধীনভাবে চিত্রপরিচালনার। ১৯৪০ সালে দেবকী বসু পরিচালিত ‘অভিনব’ ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি নিজে পরিচালনা করেন ‘ব্যবধান’ ছবিটি। ‘ব্যবধান’ মুক্তি পায় ১৯৪১ সালে। ছবিটি অসাধারণ সাফল্য লাভ করে।

প্রথম ছবি সফলতা পাবার পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি নীরেনকে। পরের বছরই পরিচালনা করেন হিন্দি ছবি ‘মহাকবি কালিদাস’ (১৯৪২)। এই ছবিটিও দর্শকের মনোরঞ্জন করে এবং হিন্দি চিত্রজগতে পরিচালক হিসেবে নীরেন লাহিড়ীর একটি জায়গা তৈরি করে দেয়। এই সময় নীরেন গড়ে তোলেন নিজস্ব একটি প্রযোজনা সংস্থা, ‘চিত্রবানী’। নিজের সংস্থার ব্যানারে তৈরি করেন ‘বিজয়িনী’ (১৯৪১), ‘গরমিল’, ‘এই তো জীবন’ (১৯৪৬), ‘রাত্রি’ (১৯৪৭), ‘সাধারণ মেয়ে’ (১৯৪৮)-র মতো সফল ছবি। বিভিন্ন প্রযোজক সংস্থার হয়ে তিনি উত্তম কুমারকে নায়ক করে পরিচালনা করেন ছ’টি ছবি; তার মধ্যে ‘শঙ্করনারায়ণ ব্যাঙ্ক’ (১৯৫৬), ‘পৃথিবী আমারে চায়’ (১৯৫৭), ‘ইন্দ্রাণী’ (১৯৫৮), ‘রাজদ্রোহী’ (১৯৬৬) উল্লেখযোগ্য।

১৯৭২ সালের ২ ডিসেম্বর মাত্র চোষট্টি বছর বয়সে নীরেন লাহিড়ীর সৃষ্টিশীল জীবনের অবসান ঘটে।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...