ভদ্রলোকের পুরো জীবনটাই দুটো সত্ত্বার মধ্যে দোলায়মান ছিল। একটা সত্ত্বা খাঁটি বাঙালি - স্বয়ং সত্যজিৎ রায় যখন অক্সফোর্ডে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান তখন তিনি নিজে দরজা খুলে সত্যজিৎ রায়কে হাতজোড় করে "আসুন আসুন" বলে অভ্যর্থনা জানান। পরে আছেন ধুতি এবং পাঞ্জাবি, পায়ে বিদ্যাসাগরী চটি। আবার তিনিই তার নিজের লেখা বই "অটোবায়োগ্ৰাফি অফ অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান" এর উৎসর্গ পত্রে লিখছেন "বাঙালির যা কিছু শ্রেষ্ঠ অর্জন সব ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবদান"..(All That Was Good And Living Within Us Was Made, Shaped And Quickened By The Same British Rule).. নিজেকে সাম্রাজ্যবাদী বলতে ও তাঁর কোনো দ্বিধা নেই... লিখছেন তিনি....
১. আমি সাম্রাজ্যবাদী, প্রথমত মানুষ বলিয়া, কেঁচো নই বলিয়া
২. আমি সাম্রাজ্যবাদী, দ্বিতীয়ত, সভ্য মানুষ বলিয়া, অসভ্য পদদলিত, দাসজাতীয় মানুষ নই বলিয়া
৩. আমি সাম্রাজ্যবাদী তৃতীয়ত সত্যকার হিন্দু বলিয়া, মলিন প্যান্ট পরিহিত আধা ট্যাঁস-ফিরিঙ্গি গণৎকারের উপাসক নই বলিয়া।
ক'জন মানুষ... বিশেষতঃ ক'জন বাঙালি এমন স্পষ্টভাবে নিজের জীবন দর্শনের কথা বলতে পারেন?
ওহ্ হো, দেখেছেন, ভদ্রলোকের কথা বলতে গিয়ে এই নিবন্ধ-লেখিকা এতোটাই মগ্ন হয়ে গেছিলেন যে যেই অনন্য মানুষটিকে নিয়ে এই লেখা, তাঁর নামটা লিখতেই ভুলে গিয়েছেন। তাঁর মতো পণ্ডিত অথচ বিতর্কিত বাঙালি তথা ভারতীয় বোধহয় এই দেশে আর জন্মান নি। তিনি হলেন একমেবাদ্বিতীয়ম নীরদ সি চৌধুরী।
নীরদ সি চৌধুরী বা নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর জন্ম ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমান বাংলাদেশের) কিশোরগঞ্জে ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দের ২৩শে নভেম্বর। উপেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী ও সুশীলা দেবী চৌধুরানীর আট সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন নীরদ চন্দ্র। কিশোরগঞ্জে স্কুলের পড়া শেষ করে তিনি প্রথমে কলকাতার রিপন কলেজে এবং পরে স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়াশোনা করেন। মেধাবী নীরদ চন্দ্র সেখান থেকেই ইতিহাসে সাম্মানিক সহ স্নাতক হন এবং মেধা তালিকায় স্থান করে নেন। খুব অল্প বয়সেই তাঁর লেখালিখি শুরু। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে Objective Methods in History শিরোনামে একটি তাত্ত্বিক প্রবন্ধ রচনা করেন|
নীরদ চৌধুরীর কর্মজীবনের শুরু হয় ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর হিসাবরক্ষণ অধিদপ্তরে একজন কেরাণী হিসেবে। চাকরির পাশাপাশি একই সময়ে তিনি বিভিন্ন ধরনের প্রবন্ধ রচনা করতে থাকেন। জনপ্রিয় সাময়িকীগুলোতে নিবন্ধ পাঠানোর মাধ্যমে লেখার জগতে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন। তার প্রথম নিবন্ধটি ছিল অষ্টাদশ শতকের বিখ্যাত বাঙালি কবি ভারত চন্দ্রের উপর। এই নিবন্ধটি ঐ সময়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত ইংরেজি সাময়িকী "মডার্ন রিভিউ"-তে প্রকাশিত হয়।
কিন্তু অল্প কিছুদিন পরই চাকরি ছেড়ে দিয়ে সাংবাদিক ও সম্পাদক হিসেবে নতুন কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি তখনকার সময়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় ইংরেজি ও বাংলা সাময়িকী হিসেবে মডার্ন রিভিউ, প্রবাসী এবং শনিবারের চিঠিতে সম্পাদনার কাজ করতেন।
১৯৩৮ এ বিশিষ্ট নেতা শরৎ চন্দ্র বসুর সেক্রেটারি হিসেবে নিযুক্ত হন। সেই সূত্রে নেতাজি সুভাষচন্দ্র সহ আরো বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসেন । এইসময়ই তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা নিয়ে সন্দিহান হয়ে প্রশ্ন তোলেন। তখন থেকেই তিনি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিরাগভাজন হন। এরপর তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে চাকরি শুরু করেন। কিন্তু ১৯৫১তে তাঁর প্রথম বই "অটোবায়োগ্ৰাফি অফ অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান" এর শুরুতেই ইংরেজদের প্রশস্তি। আর যায় কোথায়? তাঁকে সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলো।
"নীরদচন্দ্র চৌধুরী সর্বদিক থেকে একক ও স্বতন্ত্র। তিনি সেই বিরলতম সাহিত্যবোদ্ধা ইতিহাসপাঠক, যাঁর আগ্রহ অকল্পনীয় রকম সর্বত্রগামী।"...চিন্ময় গুহ
তিনি প্রথম ইংল্যান্ডে যান ১৯৫৫তে। সেই বিদেশযাত্রার অভিজ্ঞতা নিয়েই তিনি লেখেন "আ প্যাসেজ টু ইংল্যান্ড"। তারপর লেখেন ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ‘The Continent of Circe: An Essay on the Peoples of India।’ এই বইটির জন্য "Duff Cooper Memorial" পুরস্কার লাভ করেন তিনি। এরপর আরো বহু পুরস্কার তিনি পেয়েছিলেন তাঁর লেখার জন্য। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিশ্বভারতীর "দেশিকোত্তম" উপাধি এবং "সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার"..
তাঁর অন্যতম বিখ্যাত এবং বিতর্কিত বই হলো "আত্মঘাতী বাঙালি" এবং "আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ"। তাঁর ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত বই এগারোটি এবং বাংলায় পাঁচটি। ১৯৭০এ তিনি আবার ইংল্যান্ডে যান এবং আমৃত্যু অক্সফোর্ড শহরেই তিনি বাস করেছেন।
তিনি বলেছেন...
"একজন মানুষের পক্ষে নিজের দেশকে একভাবে এবং বিদেশকে আরেক ভাবে ভালবাসা খুবই সম্ভব"
নিজের জীবনে সত্যিই তিনি তাইই ছিলেন। ১৯৯৯ খ্রীষ্টাব্দের ১ আগস্ট প্রয়াত হন বিতর্কিত এই অসাধারণ মেধাবী পণ্ডিত মানুষটি। এই অনন্য জ্ঞানী মানুষটিকে তাঁর প্রয়াণ দিবসে প্রণাম জানাই।