বাড়িতে বাড়িতে কার্তিক ফেলার রেওয়াজের কথা সব্বার জানা। উনিশ শতকে ছিল বাড়িতে বাড়িতে দুর্গা প্রতিমা ফেলার রেওয়াজ। ১৮৩০ নাগাদ কলকাতার দুর্গাপুজোয় ভাটার টান পড়ে। রাজা, মহারাজা, জমিদারদের বাড়ির পুজোর ঠাটবাট কমে আসে, পাশাপাশি পুজোর সংখ্যাও কমে। কুমোরটুলিও ধাক্কা খেতে আরম্ভ করে। তখনই জাঁকিয়ে বসেছিল দুর্গা ফেলার রেওয়াজ। ১৮৩২ নাগাদ বিপুল হারে বৃদ্ধি পায় 'চাপানো পুজো'র ট্রেন্ড। পাড়ার ছেলেরা দো-মেটে, তিন-মেটে দুর্গা ব্যাপক হারে বিভিন্ন লোকের বাড়িতে ফেলতে আরম্ভ।
ফেলে যাওয়া দুর্গা প্রতিমা পুজো করা উচিত কি-না তা নিয়ে দ্বিমত থাকত। একবার প্রতিমা বাড়ির দোরগোড়ায় ফেলে গেলে, সেই পরিবারকে পুজো করতেই হত। গিন্নির সোনা-দানা বাঁধা দিয়েও কেউ কেউ পুজোর আয়োজন করতেন। এমনকি ঋণ করেও পুজো করতে হত। ধর্মভীরুরা অমঙ্গল থেকে রেহাই পেতে, ফেলে যাওয়া প্রতিমা ঘরে এনে পুজোর আয়োজন করতেন। আশ্বিনের মাঝামাঝি মোটামুটি সম্পন্ন ঘরের লোকেরা বেশ ভয়ে ভয়েই দিন কাটাতেন।
দুর্গাপুজোর সময় অবস্থাপন্ন তবুও কৃপণ এমন মানুষদের বাড়িতেও দুর্গা প্রতিমা ফেলে আসা হত। কেউ কেউ শত্রুর বাড়িতে ইচ্ছে করে দুর্গা প্রতিমা ফেলে আসতেন, খরচের বোঝা চাপাতে। নিছক মজা করেও এ কাজ করা হত। তবে সব্বাই কিন্তু পুজো করতেন না। কেউ কেউ খরচের ভয়ে ফেলে যাওয়া প্রতিমা লুকিয়ে ফেলতেন, বিসর্জনও দিয়ে দিতেন পুজো না করেই।
দুর্গা ফেলা নিয়ে একবার চরম গোল বেঁধে ছিল। বাংলার ১২২৭ সনের ৬ আশ্বিন বেলঘরিয়ার এক বাড়িতে এক দল ছেলে-ছোকরা দুর্গা প্রতিমা ফেলে গিয়েছিল। বাড়ির কর্তা সেই মূর্তি ভেঙে ফেলেছিলেন। প্রতিমা ফেলে যাওয়া ছেলের দল এ জিনিস দেখে বেজায় চটে গন্ডগোল বাঁধিয়ে ফেলেছিল। তা নিয়ে অনেক জলঘোলা হয়।
ফেলে যাওয়া দুর্গা প্রতিমা পুজো করা নিয়ে ঝড় উঠেছিল সে'সময়ের দুই পত্রিকার মধ্যেও। ‘সমাচার দর্পণ’ রুখে দাঁড়িয়ে ছিল এই 'চাপানো পুজোর' বিরুদ্ধে। গোঁড়াদের ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ দুর্গা প্রতিমা ফেলার রেওয়াজের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। সমাচার দর্পণের বক্তব্য ছিল এমনটা যারা করছে তারা ঠিক করছে না। মানুষের দুঃখের কারণ হয়ে ওঠা ঠিক নয়। অন্যদিকে, সমাচার চন্দ্রিকা-র মত, যদি বাড়তি কিছু খরচ হয় হোক। তাতে কারও দারিদ্র নেমে আসবে না। বরং পুজো পরোকালে সুফল মিলবে।
তবে লাগাতার বিরোধ, সমাচার চন্দ্রিকার ঝাঁঝলো একের পর এক প্রতিবেদন এই চাপানো পুজোর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলে। হিন্দু রক্ষণশীলেরা বিরুদ্ধেই ছিলেন, ফলে উনিশ শতকের চারের দশকে অচিরেই বন্ধ হয়ে যায় দুর্গা প্রতিমা ফেলার রেওয়াজ।